আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন পোশাক শ্রমিকের কথ..

জীবন টা একটা বইয়ের পাতার মত যত উল্টাবে ততই জানবে !!!

‘প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে শুরু কইর‌্যা সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কাজ কইর‌্যা মাত্র তিন হাজার ৭০০ টাকা বেতন পাই। কোনো কোনো দিন যদি কামে যাইতে একটু দেরি অয়, তাইলে মাসের বেতন থাইক্যা টাকা কাইট্যা রাখে। আর ওভারটাইম করলে মাঝে মাঝে টাকা পাই। ’ নিজের পরিশ্রমের কথা অকপটে বলছিলেন পোশাকশ্রমিক শাহনাজ বেগম (২৮)। খুব অল্প বয়সেই বাবা মারা যান শাহনাজ বেগমের।

মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংসারের দায়ভার পুরোটা এসে পড়ে শাহনাজের ঘাড়ে। অভাবের কারণে পড়াশোনা করেননি। তাই কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সংসারের অভাবের তাড়নায় অসুস্থ মাকে নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকার পথে।

ঢাকায় এসে পরিচিত এক বোনের সহায়তায় কাজ পেয়ে যান একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। মা-মেয়ের সংসার ভালোই কাটছিল। কিন্তু দেখতে সুন্দর হওয়ায় যে কারখানায় তিনি কাজ করতেন, সেখানকার সহকর্মী, এমনকি সুপারভাইজাররাও তাঁর সঙ্গে অশালীন আচরণ করতেন। এমন সংকটময় মুহূর্তে শাহনাজের সঙ্গে পরিচয় হয় সহকর্মী সেলিমের। পরিচয়ের শেষ পর্যায়ে পরিণয় পর্যন্ত গড়ায়।

১৯৯৮ সালে তাঁরা দুজন ভালোবেসে সংসারজীবন শুরু করেন। তখনো তিনি জানতেন না, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। বিয়ের পর তাঁকে পাঠিয়ে দেন শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে গিয়েই শাহনাজকে হতে হয় চরম বাস্তবতার শিকার। জানতে পারেন ভালোবাসার মানুষটি সম্পর্কে।

সেলিমের আরও এক স্ত্রী আছেন। এত দিন সেলিমের প্রথম স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। তিন বছর পর অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আসেন সেলিমের কাছে। নিঃস্ব শাহনাজকে ফেলে সেলিমও প্রথম স্ত্রীর টাকা-পয়সার লোভে তাঁর কাছে চলে যান। শাহনাজ তখন এক কন্যাসন্তানের জননী।

সেলিম আর তাঁদের নিজের কাছে রাখবেন না—সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন শাহনাজকে। কী করবেন ভেবে না পেয়ে মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে আবার ঢাকায় চলে আসেন শাহনাজ। কোনো খোঁজখবর নিতেন না সেলিম তখন। শুরু হয় আবার শাহনাজের সংগ্রামী জীবন। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঢাকার একটা বায়িং হাউসে পিয়নের চাকরি পান।

ছোট্ট শিশুর সঙ্গে দেখা করার কোনো নিয়ম সে অফিসে ছিল না। তাই মেয়ে জান্নাতকে মায়ের কাছে রেখে কাজ করতে যেতেন। মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন পেতেন। তা দিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল। সেলিম তখন হঠাৎ করে আবার আসা-যাওয়া শুরু করেন।

ইচ্ছে হলে দু-তিন মাস পর পর এসে দেখে যান তাঁদের। আবার মাঝেমধ্যে আসেনও না। তবে দুই সংসারের খরচ চালানোর সামর্থ্য নেই বলে শাহনাজের ভরণপোষণ দিতে পারবেন না বলে জানান সেলিম। কিন্তু হঠাৎ করে বায়িং হাউসটি বন্ধ হয়ে গেলে শাহনাজ ভীষণ বিপদে পড়ে যান। এরপর অনেক কষ্ট করে হেলপারের চাকরি পান একটি তৈরি পোশাক কারখানায়।

সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। আবার রাত আটটা থেকে ১২টা পর্যন্ত কিংবা বন্ধের দিন ওভারটাইম করলে ৪০ টাকা করে প্রতি ঘণ্টায় দেওয়া হয়। তবে ওভারটাইমের টাকা সময়মতো পাওয়া যায় না। মাসের ৫-৬ তারিখে বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় ১০ তারিখের দিকে। ফলে বাড়ি ভাড়া ও মেয়ের স্কুলের বেতন সময়মতো পরিশোধ করতে পারেন না ।

ওভারটাইম করতে গিয়ে টাইফয়েডে অসুস্থ শাহনাজ ১৫ দিন তাঁর কর্মস্থলে যেতে পারেননি। চাকরির মেয়াদ এক বছর না গেলে ছুটি পাস হয় না। যেহেতু তাঁর চাকরির ১১ মাস চলছে, তাই ১৫ দিন অসুস্থতার কারণে ১০ দিনের বেতন কাটবে। তিনি পাবেন মাত্র পাঁচ দিনের বেতন, কারণ অনেক কষ্ট করে হলেও পাঁচ দিন দুই ঘণ্টা করে কাজ করেছেন। তাঁর এই অসুস্থতার মধ্যে একবার বাসায় আসেন স্বামী সেলিম।

তিনি শাহনাজের অসুস্থতার কথা জেনে তাঁর চিকিৎসা না করিয়ে বরং বলেন, ‘তিন দিনের বেশি মানুষ অসুস্থ থাকে না। ’ মেয়ে জান্নাত এখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বাবার কাছে মেয়ে কোনো আবদার করে না। শত অভাবেও মেয়ের মুখে যেন হাসি থাকে, সে চেষ্টাই সব সময় করেন শাহনাজ। তাই মেয়ে ও মায়ের কথা চিন্তা করে তাঁকে তো সুস্থ হতেই হবে।

পুরোপুরি সুস্থ না হয়েও আবার যেতে শুরু করেন কর্মস্থলে, নইলে যে বেতন কাটা যাবে। বাড়ি ভাড়া, মেয়ের স্কুলের বেতন, সংসার খরচ কীভাবে চলবে! অসুস্থ শরীরে কাজ করে ফিরে আসার পথে রাস্তায় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে পা ফুলিয়ে ফেলেন তিনি। প্রচণ্ড ব্যথা শরীরে, তবুও নেই যেন কোনো বিশ্রাম। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে নিজের কষ্টের কথা এভাবেই বলেন শাহনাজ, ‘ছোটবেলায় বাপ মরছে। অভাবে অনেক কষ্ট পাইছি।

জীবনে সুখের লাইগ্যা যারে ভালোবাইস্যা বিয়া করছি, সেও আমার লগে প্রতারণা করল। অভাব-অনটনের সংসারে অসুস্থ হইয়্যা ঘরে বইয়্যা থাকলে তো কেউ আমারে টাকা দিব না। যত কষ্ট হোক, নিজের ব্যবস্থা নিজেরই করতে হইব। দুই ঘণ্টা কাজ কইর‌্যা আবার সুপারভাইজাররে অসুখের কথা কইয়্যা যে কয়ডা টাকা পামু, তা-ই আমার লাভ। ’



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.