আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেক্ষাপট বাংলাদেশঃ দিবস ও শ্রমজীবী মানুষ

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

প্রেক্ষাপট বাংলাদেশঃ মে দিবস ও শ্রমজীবী মানুষ মে দিবসকে প্রায়ই ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের আন্দোলনের প্রতীক বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এটি সত্যের খণ্ডিত চিত্র মাত্র। মে দিবস হচ্ছে সকল অমানবিকতা, শোষণ ও শোষকের প্রতি মালিক পক্ষের এবং রাষ্ট্রের নগ্ন সমর্থনের বিপরীতে একটি মানবিক কর্মক্ষেত্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার এবং শ্রমজীবী মানুষের মানুষ হিসেবে বাঁচার স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক। মে দিবসের শক্তি ও আবেদন এখানেই। এজন্য মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।

আর পালন করছে সরকার, মালিক, শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ আপামর জনতা। এটি এখন আর শুধু শ্রমজীবী মানুষের দিবসে সীমাবদ্ধ নেই। অনেককে আলোচনা করতে শুনি-৮ ঘণ্টা কাজের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে আইএলও কনভেনশন গ্রহণ এবং দেশের আইনে ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে মে দিবসের চেতনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। কিন্তু এই ৮ ঘণ্টা কাজের দাবির সঙ্গে ন্যায্য মজুরির এবং মানব উপযোগী নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রমিককে যদি এমন মজুরি দেয়া হয় যে সে অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য উদগ্রীব থাকে বা করতে বাধ্য হয়।

তাহলে ৮ ঘণ্টা কাজের আইন কাগুজে আইনে পরিণত হয়। এই রাজধানীতেই দেশের আইন প্রণেতা ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিবর্গের সামনে আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের সকাল আটটায় লাইন দিয়ে কারখানায় ঢুকতে এবং রাত দশটায় বের হতে দেখি। নির্মাণ শ্রমিকদের সকাল-সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে দেখি। কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করি না যে, এরা কি দুই শিফটে কাজ করছে, নাকি একই শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা? জিজ্ঞাসা করি না। কারণ উত্তরটি আমাদের সবার জানা।

এবারের মে দিবসে অনিবার্যভাবে উঠে আসছে শ্রমিকের মজুরি ও নিরাপত্তার কথা। মজুরির একটি জাতীয় মানদণ্ড নির্ধারণ আজ সময়ের দাবি। শুধু শ্রমিকদের জন্যই এই মানদণ্ড নির্ধারণ জরুরী নয়। দারিদ্র্য বিমোচনসহ সরকারের অসংখ্য কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে মজুরির মানদণ্ডের ওপর। দারিদ্র্য বিমোচনে কর্মসংস্থানের ভূমিকা সবচেয়ে প্রধান এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মানুষকে কাজ করার অধিকার দিয়েই এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিতে হবে। আমাদের দেশে একজন মানুষ যখন কাজ পায় তখন তার গোটা পরিবার সেই কাজকে ঘিরে নির্ভরতা খোঁজে। কিন্তু সেই মানুষটির উপার্জন যখন এমন হয় যে, সে নিজেই দারিদ্র্যসীমা ডিঙাতে পারছে না তখন সে এবং তার পরিবার গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়। যে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল একটি কাজ পেলে সন্তানের চিকিৎসার জন্য আর চিন্তা করতে হবে না, সন্তানকে স্কুলে পাঠাবে সেই মানুষটিই সন্তানকে একটি ঝুড়ি কিনে দিয়ে মুটের কাজে পাঠাচ্ছে। বর্তমানে দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি, যাদের আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে মজুরি।

কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মজুরি সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত দারিদ্র্য সীমার নিচে। গামেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারিত হয়েছে ২৫০০ টাকা (সর্বসাকুল্যে ৫০০০ টাকা)। কাঁচপুর, মিরপুরের ব্রিজের নিচে কার্গো থেকে পাথর তোলার কাজ করে এমন নারী শ্রমিকদের প্রত্যেকে প্রতিদিন ১০ ঝুড়ি পাথর ভেঙে পায় ৮০ টাকা এবং এটাই তাদের সর্বোচ্চ আয়। অর্থাৎ যদি সপ্তাহের প্রতিদিনও কাজ করে তাহলে তাদের মাসিক মজুরি হলো ২৪০০ টাকা। একটি পরিবার কিভাবে এই টাকায় চলছে? ইতিমধ্যে সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে অনেক ঘোষনা দিয়েছেন।

কিন্তু এসব ঘোষনা/পদক্ষেপের সুফল চার কোটি শ্রমিকের কাছে পৌঁছবে কিভাবে? যেখানে সরকারের নির্ধারিত মজুরিই একজন মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতে বাধ্য করছে। অধিকাংশ শিল্পখাতে শ্রমিকের জন্য মজুরির কোনো নির্ধারিত মানদণ্ডই নেই। সেখানে শ্রমজীবী মানুষ কিভাবে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করবে? কিভাবে গার্মেন্টস শ্রমিক তার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাবে? চার কোটি পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার নিচে রেখে দারিদ্র্য বিমোচনে কতখানি অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব? এ প্রশ্নগুলো আজ ভেবে দেখার সময় এসেছে। সুতরাং মজুরির প্রশ্ন আজ কেবল শ্রমিক বা তার পরিবারের বিষয় নয়। এর আন্তঃসম্পর্ক অনেক ব্যাপক ও গভীর।

একে শুধু শ্রমিকের সঙ্গে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখলে চলবে না। একে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে। একইভাবে শ্রমিকের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আজ একটি জাতীয় ইস্যু। বিদ্যমান শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণের যা পরিমাণ তা মালিকরাও কম মনে করছেন।

পাঠকদের নিশ্চই মনে থাকার কথা তেজগাওয়ে ফিনিক্স ভবন ধসে পড়ার ঘটনায় আদালত যে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছেন তা ক্ষতিপূরণ আইনের নির্ধারিত পরিমাণের কয়েকগুণ। আদালতের এই প্রাক-রায় প্রমাণ করে যে, বর্তমান আইন শ্রমিকদের সুরক্ষায় কতখানি ব্যর্থ এবং কতখানি অবাস্তব। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে শ্রম আইনের আওতায় রয়েছে ২০ শতাংশেরও কম শ্রমিক। মালিকের বৈরী মনোভাব, শ্রম আইনের দুর্বলতা, বাস্তবায়নকারী সংস্থাসমূহের দুর্বলতা, ট্রেড ইউনিয়নের দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে ঐ ২০ ভাগ শ্রমিকও বিদ্যমান শ্রম আইনের সুরক্ষা পায় না। মজুরির বিনিময়ে কাজ করে এমন শ্রমিকের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত আছে।

অনেকের ক্ষেত্রে এই নির্ধারণের বয়স ১১ বছর, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৪ বছরও পার হয়ে গেছে। আবার এর চেয়েও নির্মম সত্য হলো, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকের মজুরির কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণই নির্ধারিত নেই। মালিকরা সেখানে ইচ্ছেমতো মজুরি দেন। লাখ লাখ নারী-পুরুষ নির্মাণ খাতে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত। এমনিভাবে আমরা উল্লেখ করতে পারি চিংড়িশিল্প, জাহাজ ভাঙাসহ অনেক সেক্টরে অসংখ্য ধরনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের কথা।

এদের জন্য নেই নির্দিষ্ট কোনো মজুরি কাঠামো, কর্মঘণ্টা, ছুটি বা অন্য কিছু। তারা জানে না তাদের মজুরি কত হওয়া উচিত, কত চাওয়া উচিত, কত পাওয়া উচিত। এদের কাছে সাপ্তাহিক ছুটি মানে একদিন না খেয়ে থাকা। কারণ সবেতন কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই এদের জীবনে। ন্যায্য মজুরি না পেলে বা মজুরিই আদৌ না পেলে, ছুটি না পেলে, কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হলে এদের নালিশ করার কোনো জায়গা নেই।

অনেক ক্ষেত্রে আইন তাদের নালিশ করার অধিকার দেয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো নির্দিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ নেই, যেখানে এই অসহায় শ্রমিক যেতে পারে। বিশ্বায়নের কথা বলে ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারের দায়বদ্ধতা যতোই হ্রাস করা হোক। । একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপেক্ষাকৃত সুবিধাপ্রাপ্তদের দ্বারা অধিকাংশ মানুষ যাতে শোষণ-বঞ্চনার শিকার না হয় এবং দেশের উন্নয়নে সবার ভূমিকা যাতে স্বীকৃত হয় ও উন্নয়নের সুফলে সবার ন্যায্য প্রাপ্তি যাতে নিশ্চিত হয় সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের।

রাষ্ট্রের এই ভূমিকার ব্যত্যয় হয়েছিল বলেই মে দিবসের ঘটনা ঘটেছিল। মে দিবসের শিক্ষা নিয়ে এবং মে দিবসের আগের বাস্তবতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাই। যে এগিয়ে যাওয়ার কাফেলায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে মালিক ও শ্রমিক। অবশ্যই জীবন্ত প্রাণবন্ত শ্রমিক।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।