আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সহজ ইতিহাস : ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক পুর্ব ইউরোপের হারিয়ে যাওয়া

অভিলাসী মন চন্দ্রে না পাক, জোছনায় পাক সামান্য ঠাই

২য় বিশ্বযুদ্ব পরবর্তী ইউরোপীয়ান ইতিহাস লিখতে বসে এর আগে যুদ্ধত্তর ইউরোপ এবং পশ্চিম ইউরোপের বিষয়ে লিখেছিলাম। আজকে পুর্ব ইউরোপ নিয়ে লিখে এই ৩ পর্বের এই সিরিজটা শেষ করে ফেলি। ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর পরাজয় এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিদ্ধস্ত অবস্থা পূর্ব ইউরোপকে এক অর্থে অভিবাবক শুন্য করে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সম্মতিক্রমে ইয়াল্টা কনফারেন্সের মাধ্যমে স্ট্যালিনের রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের অভিবাবকত্ব পায় । কাঁচামালে সমৃদ্ধ পুর্ব ইউরোপ সোভিয়েত রাশিয়ার জন্য খুব গুরুত্বপুর্ন ছিল।

এটা একই সাথে রাশিয়ার ভারী শিল্পে কাঁচামালের যোগানদাতা ও পশ্চিম ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে বাফার জোন হিসেবেও কাজ করে। প্রথমে স্ট্যালিন সরাসরি পুর্ব ইউরোপে কম্যুনিস্ট শাষন চাপিয়ে দেয় নাই তবে ধাপে ধাপে প্রতিটা দেশেই (পোল্যান্ড,হাঙ্গেরী,চেকোস্লোভাকিয়া,রোমানিয়া,বুলগেরিয়া) কম্যুনিস্ট দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু ঝামেলা বাধে অল্পদিনেই কারন পুর্ব ইউরোপীয়ান কম্যুনিস্টদের মাঝে বিভক্তি! এক দল ছিল যারা জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় মস্কোতে কাটিয়েছে ওদের ধারনায় ছিল শতভাগ মস্কোর আনুগত্য। মস্কো যা করে সেটা ফলো করা এবং মস্কোর উপদেশেই ওদের সব। কিন্তু আরেকদল ছিল,ওরাও কম্যনিস্ট কিন্তু মস্কোর কথাই শেষ বলে না মেনে নিজ দেশের পরিস্থিতি ও সমাজ অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে চেয়েছিল।

যাদের বলা হতো, জাতীয়তাবাদী সোশ্যালিস্ট। জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিকদের আদর্শ হয়ে উঠে, মার্শাল টিটো ! নাৎসি বিরোধী সফল যোদ্ধা টিটোকে অন্যান্যদের মত করে স্ট্যালিন তার নিয়ন্ত্রনে আনতে ব্যার্থ হয়। যুগোস্লাভিয়ার এই নেতাও কম্যুনিস্ট কিন্তু তার আদর্শের সাথে স্ট্যালিনের আদর্শের ছিল পার্থক্য। স্ট্যালিন যেখানে সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হিসেবে ভারী শিল্প এবং কেন্দ্রিয় ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিল,টিটো'র মত ছিল ভিন্ন। সত্যিকারের শ্রমিকদের তথা সাধারন মানুষের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে টিটো ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে সরিয়ে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনে ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং বাজারে ভোক্তা চাহিদা অনুযায়ী পন্য উৎপাদন শুরু করে।

স্ট্যালিনের বিপক্ষে টিটো ক্রমেই সমৃদ্ধ চরিত্র হয়ে উঠছিল এবং পোল্যান্ড,হাঙ্গেরীর মত দেশে জাতীয়তাবাদী সোশ্যালিস্ট নেতাদের কাছে টিটোর যুগোস্লাভিয়া ক্রমেই একটি সফল বিকল্প ধারা হয়ে উঠছিল। এই পর্যায়ে সোভিয়েত দেশগুলোর মাঝে একটি অর্থনৈতিক জোট গঠন করা হয় "কমেকন"। এবং স্ট্যালিন শাস্তি স্বরুপ টিটোর যুগোস্লাভিয়াকে এই জোটে নিষিদ্ধ করে এবং অন্যান্য সদস্যদের সাথে যুগোস্লাভিয়ার বানিজ্য বন্ধ করে দেয়। ফলে প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে যুগোস্লাভিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য শুরু করে এবং বেশ কিছু আর্থিক সাহায্যও পায়। সমাজতন্ত্রের পথে দুটি ধারার সৃষ্ঠি হয়, স্ট্যালিনিজম এবং টিটোইজম।

পোল্যান্ড,হাঙ্গেরী,চেকোস্লোভাকিয়া,পুর্ব জার্মানী এই দেশগুলোতেও অনেক নেতাই মস্কোকে শতভাগ অনুসরনের বিপক্ষে ছিল। তাদের কথা হলো যে, রাশিয়া আর আমাদের দেশ আলাদা এবং চাহিদাও আলাদা সুতরাং আমাদের নিজস্ব চিন্তা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবাই তো আর টিটো না। তাই এদের অধিকাংশকেই নির্মমভাবে দমন করা হয়। এরই মাঝে স্ট্যালিন মারা গেলে রাশিয়া তথা পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুর্ব ইউরোপে তৈরী হয় ভয়াবহ নেতৃত্বের সংকট।

নতুন নেতৃত্ব নিয়ে অনেক ঝামেলার পর মালেন্কোভ মস্কো'তে ক্ষমতায় আসে,কিন্তু অল্পদিনের মাঝেই কম্যুনিস্ট দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাকে সরিয়ে দিলে নিকিতা ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতার বসে এবং কিছু নতুন নীতি গ্রহন করে। যেমন স্ট্যালিনের লৌহ শাষনের চরম ক্রিটিসিজম করে,অনেক কঠোর নীতিমালা শিথিল করে,যুগোস্লাভিয়ার ভিন্নমত মেনে নেয় এই বলে যে, আমাদের পথ আলাদা হলেও লক্ষ্য এক। মানে অতীতের কঠোর অবস্থান অনেকটাই শিথিল করে দেয় ক্রশ্চেভ। তবুও ঝামেলা বাড়তেই থাকে, পোল্যান্ডের শ্রমিকরা বিদ্রোহ করে বসে। তখন জেল থেকে বিদ্রোহী জাতীয়তাবাদী নেতা গোমুল্কাকে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় বসানো হয়।

এবং কৃষি'র যৌথ উৎপাদন ব্যাবস্থা উঠিয়ে দেয়া হয় এবং শ্রমিক সংগঠনের কাছে বিপুল ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। পোল্যান্ড জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র অনুসরন শুরু করে। পোল্যান্ডের সংস্কার মেনে নেয়ার মুল কারন ছিল যে, কম্যুনিজমে বিশ্বাসীদের নিজেদের মাঝে ভিন্নমত থাকতেই পারে তবে সবার উদ্দেশ্য অভিন্ন মানে সমাজতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিতে সবাই এক জোট। এরই মাঝে হাঙ্গেরীতে শুরু হয় বিদ্রোহ। বিদ্রোহ দমনে হাঙ্গেরীর সরকার সোভিয়েত আর্মি তলব করলে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায় এবং এমরে নাজি'র নেতৃত্বে বিদ্রোহে হাঙ্গেরীয়ান আর্মির একাংশও যোগ দিয়ে বিদ্রোহ সফল করে।

কিন্তু পরবর্তীতে নাজি হাঙ্গেরীকে ওয়ার স প্যাক্ট (ন্যাটোর মত সোভিয়েত ও পুর্ব ইউরোপের সামরিক জোট) থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিরপেক্ষ ঘোষনা দিয়ে বসে। এটা একটা অনেক বড় পদক্ষেপ হয়ে যায়। কারন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত না হলেও পুর্ব ইউরোপীয়ান এই দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নেরই স্যাটেলাইট বলে পরিচিত। এই অবস্থায় চলতে দিলে অন্যান্য দেশে যেমন, চেকোস্লোভাকিয়া,রোমানিয়া,বুলগেরিয়াতেও বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে তাই সোভিয়েত আর্মি এবার পুরো শক্তিতে বিদ্রোহ দমন করে নাজিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। পরে হাঙ্গেরী পোল্যান্ডের মত জাতীয়তাবাদি সমাজতন্ত্রের পথ ধরে।

কিন্তু পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরীতে এমন ঝামলা তৈরীর কারন হিসেবে ক্রুশ্চেভের উদারনীতি'র সমালোচনা শুরু হয়। এবং ২ বার বরখাস্ত হতে হয় তাকে। ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া বিদ্রোহ করে বসলে ওয়ার স প্যাক্টের সদস্য দেশগুলোর সামরিক বাহিনী সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ দমনে গেলে এবার রোমানিয়া নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর থেকেই পুর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের দুরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্ক তৈরী হয়।

সবশেষে ১৯৮৯এ সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ভেঙ্গে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পুর্ব ইউরোপকে ধরে রাখতে ব্যার্থ হবার পেছনে একটা মুল ও বড় কারন ছিল,রাশিয়ান আদর্শ মতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিগুলোকে অতি দ্রুততার সাথে ভারী শিল্প নির্ভর করে ফেলায় শহরগুলোতে মানুষের প্রচন্ড চাঁপ এবং জীবনযাত্রার মান অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়া। ২য় বিশ্বযুদ্ধ জয়ী দলে থেকেও এমন জীবনমান অনেকের মনেই ক্ষোভ সঞ্চার করলেও স্ট্যালিনের সামনে অভিযোগ জানানোর সাহস ছিল না করোই। ফলে মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়েছে। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর থেকেই আস্তে আস্তে আওয়াজ বের হতে শুরু হয়।

টিটোর দেখানো ভিন্ন পথ শুরুতেই সমাজতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় একতাটা নষ্ট করে ফেলে। পরে মস্কোতেই বিভিন্ন সংস্কারপন্থীদের উত্থান,পুর্ব ইউরোপে জাতীয়তাবাদী সোশ্যালিজম,চায়না ও আলবেনিয়ায় কট্টোর পন্থার উত্থান। এসব মিলিয়েই সমাজতন্ত্রের একতা নষ্ট হয়ে যায়। আরো একটি মুল কারন ছিল যে পশ্চিম ইউরোপের অত্যন্ত সফল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। ফলে পুর্ব ইউরোপের দেশগুলো ধীরে ধীরে পশ্চিমা আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে যায়।

আর পুরো সময়টাতেই যুক্তরাষ্ট্র ,পশ্চিম ইউরোপীয়ান দেশগুলোর ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির চমকানো দুনিয়ার বিজ্ঞাপনী প্ররোচনা তো ছিলই। আর ব্যাক্তিগতভাবে বলকান তথা পুর্ব ইউরোপের ইতিহাস পড়ে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে বলকান দেশগুলোতে শতভাগ সফলতা কোনদিনই সম্ভব নয়। আর যেকোন আদর্শবাদী জীবনই আদর্শহীন জীবনের তুলনায় কঠোর ও কম আকর্ষনীয়। তাই এসব মিলেই যেই সময়টাতে পশ্চিম ইউরোপ দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে ঠিক সেই সময়টাতেই সমাজতান্ত্রিক পুর্ব ইউরোপের পতন দেখি আমরা। সমাপ্ত।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ইউরোপের ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়া এবং তাদের পরিনতি নিয়ে লেখা এই সিরিজের এখানেই আপাতত সমাপ্তি। কষ্ট করে পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। প্রথম পর্ব :সহজ ইতিহাস: ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরের ইউরোপ Click This Link দ্বিতীয় পর্ব : সহজ ইতিহাস : ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের ফিরে আসা Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৩৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।