নাজমুল ইসলাম মকবুল
সেই বৈশাখ এই বৈশাখ
স ঞ্জী ব চৌ ধু রী
জীবনের নাট্যমঞ্চে পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায় আমার অবস্থান যে স্থায়ী হয়ে গেছে, তা ইদানীং বেশ ভালোভাবে টের পাই। ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে কোনো উত্সব-পার্বণ এলে। পহেলা বৈশাখের কথা ধরা যাক। অন্য ১০টা বাঙালি পরিবারের মতো আমার বাসায়ও বাংলা নববর্ষে বরাবর আটপৌরে আয়োজনের ঘাটতি থাকে না। ব্যস্ত হয়ে পড়ে বউ-ছেলেমেয়ে সবাই।
ঘরদোর ঘষামাজা, পর্দা-বিছানার চাদর ইত্যাদি ধোয়া-মোছা করে, বাক্স তোরঙ্গ থেকে পাট করা কাপড়চোপড় বের করে রোদে দেয়া, এমন হরেক রুটিন কাজ চলতে থাকে। সাধ্য অনুযায়ী নানান পদের নাড়ু-মোয়া বানানো, চৈত্রের শেষ দিনে (বিষুব সংক্রান্তি) নিরামিষ খাওয়া, নববর্ষের দুপুরে মুগডাল, বেগুন ভাজা, ঝালের মাছ, ঝোলের মাছ, খাসির মাংস, পায়েস সহযোগে ভূরিভোজ—সবই কম-বেশি আগের মতোই আছে। তবু নিজের মধ্যে আগের সেই উত্সাহের সন্ধান পাই না। আমি একজন চাকরিরত সাংবাদিক। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে।
বিশেষ ব্যবস্থাতেও ওইদিন সংবাদপত্র অফিসে কাজ হয় না। এই নির্ভেজাল ছুটিই মূলত দিনটিতে আমার প্রধান আকর্ষণ। গোটা রাজধানী উত্সবের মেজাজে থাকে বলে ছুটির দিনে কিছু বিশেষ কাজ সেরে নেয়ার তাগাদা থাকে না। তাই অখণ্ড অবসর।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন নিয়ে আবার নতুন এক বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলা সন সংস্কারের লক্ষ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে ফর্মুলা দিয়েছিলেন, সেটা যৌক্তিক এবং সর্বজনগ্রাহ্য বিবেচিত হওয়ায় তা এখন সরকারিভাবে স্বীকৃত। সে অনুযায়ী বাংলাদেশে চালু হয়েছে নতুন বিন্যাসে বাংলা সন গণনা। এর আগে বাংলা সন গণনা ছিল পঞ্জিকানির্ভর। এখন সরকারি বাংলা সনের পাশাপাশি পঞ্জিকাভিত্তিক সন গণনার রেওয়াজ কিছুটা ক্ষীণভাবে হলেও চালু আছে। ফলে যারা পঞ্জিকা অনুসারে সন গণনার অভ্যাস এখনও ছাড়েননি, তাদের সঙ্গে সরকারি ও সমাজের বৃহত্তর অংশের কাছে গৃহীত বাংলা নববর্ষের সূচনার তারিখ প্রায়ই একদিন আগে-পিছে হয়ে যায়।
পুরনো ঢাকার বাসিন্দা আমার স্বজনদের অনেকে এবারও আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি বৃহস্পতিবার নাকি শুক্রবার নববর্ষ উদ্যাপন করব? অবশ্য আমার কথা, পঞ্জিকানির্ভর নববর্ষ উদ্যাপনের ধারা বছর বছর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। নিকট ভবিষ্যতে এ ধারা পুরোপুরি শুকিয়ে গিয়ে সবাই একই দিনে বর্ষবরণ করবে বলে ধারণা করা যায়।
তবে আমি মানতে বাধ্য, নিজের মনে উত্সাহের ঘাটতি থাকলেও বাঙালির চলমান জীবনে বর্ষবরণ উত্সবের প্রাসঙ্গিকতা ও বৈচিত্র্য ক্রমেই বাড়ছে। নিজের ঘরেই টের পাই, আমার ছেলেমেয়ে বছরের অন্তত এই একটা দিনে সবার আগে ঘুম থেকে ওঠে। দীর্ঘদিনের রেওয়াজ মেনে কাঁচা হলুদবাটা সর্বাঙ্গে মেখে স্নান সেরে ঠাকুরের আসনে প্রার্থনা করে।
তারপর সামান্য কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে যায়। হয়ে ওঠে উত্সবমুখর জনতার অংশ। দুপুরে পারিবারিক ভোজে অংশ নেয়ার জন্য তারা যখন বাসায় ফেরে, তখন শরীরে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও চেহারা শুকনো থাকে না। বরং এত সময় ধরে কোথায় কী ঘটল, তার বিরামহীন বর্ণনা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। বলে রাখা ভালো, ছেলেবেলায় আমার নববর্ষ শুরু হতো পহেলা বৈশাখের ভোরে।
আমার ছেলেমেয়ে বাংলা নববর্ষের সূচনা করে আগের রাত ১২টা এক মিনিটে মোবাইল ফোনে বন্ধু-বান্ধবকে ‘উইশ’ করার মধ্য দিয়ে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সকালে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার উদ্যম একসময় আমার মাঝেও ছিল। এক বছর এমনি করে ভোরবেলায় হাঁটতে হাঁটতে হাজির হয়েছিলাম রমনা বটমূলে। সময়টা ছিল ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ। পুরনো রমনা রেস্তোরাঁ তখনও চালু ছিল।
ছায়ানটের সুচারু আয়োজনে চলছে সঙ্গীতানুষ্ঠান। প্রবীণ নজরুল সঙ্গীতশিল্পী সোহরাব হোসেন দরদী গলায় গান ধরেছেন, ‘মেঘবিহীন খর বৈশাখে...। ’ আকাশে সেদিন মেঘের আনাগোনা ছিল। হঠাত্ ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। আমি পড়িমরি করে ছুটে ঠাঁই নিলাম রমনা রেস্তোরাঁর বারান্দায়।
সঙ্গে আরও অনেকে। সোহরাব হোসেনের কিন্তু নড়ার উপায় নেই। কারণ গান তখনও শেষ হয়নি। তিনি কাকভেজা হয়ে গেয়েই চলেছেন খর দাবদাহের গান। এখনও দৃশ্যটা মনে পড়লে আমি এক ধরনের নির্মল আনন্দ অনুভব করি।
ছেলেবেলায় তো বটেই, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সূচনাপর্বেও আমার বাংলা নববর্ষের স্মৃতি চট্টগ্রামকে ঘিরে আবর্তিত। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন ছিল একান্তভাবেই ঘরোয়া। উত্সব শুরু হয় চৈত্রসংক্রান্তির এক দিন আগে থেকে। চট্টগ্রামে দিনটি ফুল বিহু নামে পরিচিত। ওইদিন ফুলের মালা গেঁথে দরজায় এবং জানালায় টানিয়ে দেয়া হয়।
এর মধ্যে থাকে খালপাড়ে ঝোপ জাতীয় গাছে বেড়ে ওঠা বিহু ফুল নামের এক ধরনের ফুলের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য।
ফুল বিহুর পরদিন চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলা বছরের শেষ দিবস। দিনটি চট্টগ্রামে বড় বিহু নামে পরিচিত। কেউ কেউ ফুল বিহুর সঙ্গে মিলিয়ে দিনটিকে মূল বিহু বলে থাকে।
এদিন অনেকে, বিশেষ করে হিন্দু ও বৌদ্ধরা নিরামিষ আহার করে। পাচন নামে পরিচিত এই নিরামিষ তরকারির রন্ধন প্রণালী ও স্বাদ আলাদা। পরদিন পহেলা বৈশাখ নববর্ষের প্রথম সূর্যোদয় থেকে শুরু হয় ঘরে ঘরে পারিবারিকভাবে বর্ষবরণের আয়োজন। এদিন স্নান এবং যার যার মতো করে প্রার্থনার আগে সাধারণত কেউ কিছু মুখে দেয় না। এমনকি এক ঢোক পানি পর্যন্ত না।
নতুন, নিদেনপক্ষে পরিপাটি পোশাক পরে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, পরস্পর কোলাকুলি, কটু কথা থেকে বিরত থাকার আন্তরিক চেষ্টা, অন্তত দুপুর বেলা পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে সাধ্যমত রাজসিক ভোজ ইত্যাদিতে যে আবহ সৃষ্টি হতো তার, সঙ্গে ঈদ অথবা পূজার আনন্দের তুলনা করা চলে।
কলেজ জীবনের দ্বিতীয় বছর থেকে আমি বিহু উত্সব রাঙামাটিতে কাটাতে শুরু করি। বিহুর আগের দিন সন্ধ্যায় রাঙামাটি গিয়ে অবস্থান, পরদিন বিহু উত্সবে চাকমা বন্ধুদের নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে যাওয়া, পহেলা বৈশাখ ভোরে চট্টগ্রামে গিয়ে নববর্ষ পালন—এসব আমার বার্ষিক রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক বছর আমার বিয়ের পরের ঘটনা, ছেলে সাগর তখন হাঁটতে শিখেছে। বৌ ছেলেকে চট্টগ্রাম শহরের বাসায় রেখে আমি এসেছি রাঙামাটিতে বিহু উদ্যাপন করতে।
পরদিন ভোরে চট্টগ্রাম ফিরে দেখি তারা বাসায় নেই! আমার অতিপ্রিয় বন্ধু, সহপাঠী ও দূর সম্পর্কের আত্মীয় কালী শংকরের বাসায় গেছে নববর্ষের নেমন্তন্ন খেতে। আমাকেও যেতে হবে, এ কথা বাবা জানিয়ে দিলেন বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে। আমি গিয়ে দেখি, কালী শংকর একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে অন্দর-বাহির করছে। ব্যাপারটা আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকল। আমি সাংবাদিক।
মানুষের পেটের খবর বের করার কায়দা-কানুন জানা আছে। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, আমরা যে সেদিন তার বাসায় খেতে যাব তা কালী শংকর জানতই না। তার বাবা (আমার ঈশ্বর কাকা) আমাদের বাসায় গিয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছেন। কিন্তু এ কথা বাসায় জানাতে তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। তাই তাদের বাসায় আমাদের জন্য আবার চুলায় হাঁড়ি চড়াতে হয়েছিল।
এরকম বহু স্মৃতি মনে জাগলে এখনও প্রফুল্ল বোধ করি।
নিকট-অতীতের একটা ঘটনা বলে ইতি টানা যাক। আমি বেহিসাবীর চূড়ান্ত। ফলে অনটন আমার নিত্যসঙ্গী। বছর দুই আগের কথা।
বাংলা নববর্ষের আগমন লগ্নে আমার পকেট গড়ের মাঠ। আগের দিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে গিন্নিকে বললাম, চিন্তা করো না। যেভাবেই হোক, টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। বিকালের দিকে বউ জানতে চাইল, টাকা আনতে ছেলেকে আমার অফিসে পাঠাবে কিনা! আমি কমনীয়তা ও গাম্ভীর্যের ককটেল গলায় ঢেলে টাকা জোগাড় না হওয়ার দুঃসংবাদ তাকে জানালাম। সে যেভাবে মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দিল, তাতে বুঝলাম আজ রাতে বাসায় ঝড় উঠবে।
রাতে কাজ সেরে অফিস থেকে বেরিয়েছি। প্রচণ্ড ভিড়ে বাসে ওঠা দায়। একটায় কোনোরকমে চড়তে পারলেও গণ-দেবতার জুতার চাপে পায়ের আঙুল থেঁতলে গিয়ে ততক্ষণে গলগল করে রক্ত ঝরছে। পায়ে চপ্পলে রক্ত মাখামাখি অবস্থায় বাসায় ফিরলাম। আমার দশা দেখে বউ-ছেলেমেয়ে আমাকে নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, টাকা জোগাড় করতে না পারার বেদনা সবাই ভুলে গেল বেমালুম।
পরদিন অবশ্য চিতল মাছের দশাসই পেটি, গাদার কোপ্তা, আলুবোখারার অম্বল আর পায়েস-সহযোগে মধ্যাহ্ন ভোজন নববর্ষের সঙ্গে বেশ মানানসই হয়েছিল। ওহ, বলতে ভুলে গেছি; প্রথম পাতে মুগডাল, বেগুন ভাজা, সুক্তো তো ছিলই, সঙ্গে ছিল ভাজা ইলিশের উপস্থিতি। সাধে কী সংস্কৃত কবিরা গৃহিণীকে অন্নপূর্ণার সঙ্গে তুলনা করেছেন! হ
সুত্র: আমার দেশ
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।