আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সহজ ইতিহাস: ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরের ইউরোপ

অভিলাসী মন চন্দ্রে না পাক, জোছনায় পাক সামান্য ঠাই

২য় বিশ্বযুদ্ধটা একটা বিরাট ঘটনা। ইউরোপীয়ানদের নিয়মিত যুদ্ধ সিরিজের সর্বশেষ এই যুদ্ধে ব্যাপাক প্রাণহানী ও সম্পদের ধ্বংস এতটাই ছিল যে ইউরোপ আক্ষরিক অর্থে পঙ্গুত্ব বরনের পথে ছিল। শেষে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব/অভিবাবকত্ব মেনে নিয়ে রক্ষা করেছিল নিজেদের। প্রথম বারের মত পৃথিবী গ্লোবাল হয়ে উঠলো আর শুরু হলো নতুন ধারার রাজনীতি। পৃথিবী ২ ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে গেল অনেক বছর।

যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠলো একক শক্তি ,এতটাই একক যা আগে কোনদিন পৃথিবী দেখে নাই। এর সব কিছুর পেছনেই দুনিয়ার শক্তিঘর ইউরোপ তথা ২য় বিশ্বযুদ্ধের তথা যুদ্ধোত্তর রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। আজকে এখানে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে কিছু ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। মুলত তাদের জন্য যাদের ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপীয়ান রাজনৈতিক ইতিহাসে আগ্রহ রয়েছে কিন্তু সময়সুযোগের অভাবে পড়া হয় নাই। সেজন্য যতটুকু ডিটেল না দিলেই নয় ততটুকুই দেয়া হয়েছে।

জার্মানী'র বিমান বাহিনী ব্রিটিশদের ক্ষমতাকে গুরুত্ব না দিয়ে আক্রমন করে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হলেও মুল ধরাটা খায় তারা শীতকালে রাশিয়া আক্রমন করেই। পশ্চিমের ফ্রান্সে চলমান এবং পূবে রাশিয়ায় একই সময়ে আক্রমন করার মত সাহস দেখানো সম্ভব হয়েছে একমাত্র হিটলারের মত নেতার পক্ষেই কারন সেও নিশ্চিত জানতো রাশিয়াই শেষ নয় এর পর অতলান্তিকের দক্ষিন থেকে লালমুখো আমেরিকানরাও আসবে। যাইহোক, জার্মানীর চুড়ান্ত পতনের আগে ও পরে তেহরান,ইয়াল্টা,কুইবেক ও সর্বশেষ পটসড্যাম কনফারেন্সে যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া মিলিত হয়ে পুর্ব ইউরোপ ( পোল্যান্ড,হাঙ্গেরী,চেকোস্লোভাকিয়া,রোমানিয়া,বুলগেরিয়া এবং বলকান দেশগুলো) যাবে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রনে এবং জার্মানীর ভাগ্যে কি ঘটবে সেসব সিদ্ধান্ত নেয়। ফ্রান্স প্রথমে খেলার বাইরে ছিল কিন্তু পরে শার্ল দ্যা গলের জোর গলার দাবীতে তাদেরকেও খেলায় অংশ করে নেয়া হয়। এখানে একটা কথা বলার দরকার যে,বিশ্বের রাজনীতিতে যাই হোক না কেন তার জন্য একটি স্বীকৃত পন্থা অনুসরন করতে হয় আর সেই সকল পন্থা হয় বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে যা মুলত "কনফারেন্সে"র মাধ্যমেই হয়।

তাই আপনি যদি সঠিকভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি অনুসরন করতে চান তবে আপনাকে বিভিন্ন কনফারেন্স ও তাতে সম্পাদিত চুক্তিগুলোই অনুসরন করতে হবে। এর বাইরে স্বীকৃত কোন মাধ্যম নেই যে ফলো করতে পারবেন। স্ট্যালিনের ও ফ্রান্সের দাবি ছিল যে জার্মানীকে নিশ্চিন্হ করে ফেলা হবে মানে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হবে এবং এর সকল ভারী শিল্প বন্ধ করে দেয়া হবে যাতে আগামীতে জার্মানী কোনদিন আর যুদ্ধ লাগাতে না পারে। কিন্তু রুজভেল্ট ও চার্চিলের ছিল ভিন্নমত কারন ওদের ভয় ছিল জার্মানী যদি নিশ্চিন্হ হয়ে যায় তাহলে কন্টিনেন্টাল ইউরোপে(ইউরোপ মহাদেশের মুল ভুমি) কমুনিস্ট রাশিয়া বেশী ছাড় পেয়ে প্রবেশ করবে যা তারা চায় নাই। শেষে ২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপুরনের অর্ধেকটা রাশিয়া পাবে এবং জার্মানীকে ৪ ভাগে ভাগাভাগি করে নেয়।

প্রথমে ফ্রান্সের ভাগ ছিল না পরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নিজেদের ভাগ থেকে ফ্রান্সকে কিছু অংশ দেয়। ফ্রান্স এবং রাশিয়া তাদের নিজেদের দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে জার্মানীর প্রায় সকল শিল্পই ধ্বংস করে নিজেরা নিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভাগে পরা পশ্চিম জার্মানী ছিল শিল্প সমৃদ্ধ এবং রাশিয়ার ভাগের পুর্বাঞ্চল ছিল খাদ্য সমৃদ্ধ। তারা নিজেদের মাঝে এসব বিনিময় করতো কিন্তু সমস্যা দেখা দিল বিনিময় হার নির্ধারনে। এ নিয়ে ক্যাচালের এক পর্যায়ে পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি ও সোশ্যাল আনরেস্ট দেখা যায়।

পরে সুশাষন এবং অর্থনৈতিক মেরুদন্ড সোজা করতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নিজেদের অংশ একত্রিত করে একটি কমন জোন গঠন করে ফেলে,তখন ফ্রান্স যেকোন প্রকারের একত্রিত জার্মানীর তীব্র বিরোধীতা করেছে,কিন্তু ওদের কথা শুনার কোন প্রয়োজন বাকী ২ দেশের ছিল না। পশ্চিম অংশ থেকে রাশিয়াকে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপুরন দেয়াও বন্ধ করে দেয়া হয় বিনিময় মুল্য নিয়ে মতপার্থক্য হবার কারনে। যুদ্ধের পরেই নীতিনির্ধারকদের মাথায় চলে আসে আগামীর ভাবনা। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধান এ্যাডভোকেট যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই পুরো ইউরোপকে নিজেদের বাজার হিসেবে চাইছিল। অপরদিকে সোশালিস্ট রাশিয়ারও তাদের স্বপ্ন কম্যুনিজমে পৌছানোর জন্য প্রয়োজন ছিল ইউরোপের দেশগুলোকে।

তাই শুরু হয় মতাদর্শ বিলি করার যুদ্ধের! যার প্রথম ব্যাটল গ্রাউন্ড এই ইউরোপ। আর্থিক শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র তথা মুক্তবাজারের এ্যাডভোকেটদের সুবিধা বেশী ছিল যুদ্ধ বিদ্ধস্ত রাশিয়ার তুলনায়। তাই বিভিন্ন আর্থিক সাহায্য প্যাকেজ ছিল প্রায়োরিটি অর্জনের হাতিয়ার। এরই মধ্যে খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আবির্ভাব হলো ট্রুম্যান ডকট্রিনের। গ্রীস এবং তুরস্কের মত সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে যেন কম্যুনিজম ছড়ানো বন্ধ করা যায় সেই লক্ষ্যে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের একটি আর্থিক সাহায্য প্যাকেজ ঘোষনা দেয়।

ট্রুম্যানের যুক্তি ছিল বিশ্বের "স্বাধীনতা" রক্ষায় এই সাহায্য প্রয়োজন। কম্যুনিজম প্রসারের জন্য গ্রীস এবং তুরস্ক ছিল অন্যতম উর্বর ভুমি এবং তারাই ছিল লক্ষ্য কিন্তু ট্রুম্যানের এই বিশাল আর্থিক সাহায্যের কারনে ২টি দেশই তথাকথিত মুক্তবিশ্বের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এবং এই ট্রুম্যান ডকট্রিনের ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ প্রথম প্রকাশ্যে এসে যায়। কারন মতবাদ প্রসারের লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করে এই ডকট্রিন। কিন্তু ট্রুম্যান ডকট্রিনের চেয়েও বড় জিনিস অপেক্ষায় ছিল তা হলো মার্শাল প্ল্যান! যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ তখন অর্থনৈতিক চাপে ধুকছে,পুরো সামাজিক ব্যাবস্থা বিপর্যয়ের মুখে।

ইটালি,ফ্রান্সের মত দেশেও কম্যুনিজম মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ মার্শাল নিয়ে এলো মার্শাল প্ল্যান। এটা ট্রুম্যান ডকট্রিনের মত নিদৃষ্ট দেশের জন্য না তবে সামগ্রিক ভাবে "ক্ষুধা,দারিদ্র,বিশৃংখলা" মোকাবেলার উদ্দেশ্যে। সোভিয়াত কন্ট্রোলে থাকা পুর্ব ইউরোপ এবং রাশিয়া নিজেও এই প্ল্যানের বাইরে ছিল না। কিন্তু স্ট্যালিন এই প্ল্যান নাকচ করে দেয় কারন এর একটি শর্ত ছিল যে আভ্যন্তরীন সকল আর্থনৈতিক ডাটা প্রকাশ করতে হবে।

স্ট্যালিন সোভিয়েত রাশিয়ার ভেতরের দুর্বল আর্থিক দৈন্যতা প্রকাশে রাজী হলেন না এবং পুর্ব ইউরোপীয়ান দেশগুলোকেও এতে অংশ নিতে বিরত রাখলেন। কিন্তু ফল হলো যে, ট্রুম্যান ডকট্রিনে গ্রীস ও তুরস্ক আগে থেকেই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের আওতায় আর মার্শাল প্ল্যানের দ্বারা ফ্রান্স সহ সকল পশ্চিম ইউরোপীয়ান দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে চলে এলো। আর অর্থনৈতিক সাহায্যের আশায় থাকা স্ট্যালিন এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে প্রচন্ড ক্রোধান্বিত এবং কট্টর হয়ে পুর্ব ইউরোপীয়ান দেশগুলোকে নিয়ে বাকীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরই মাঝে প্রচন্ড অর্থনৈতিক সংকটের ফলে পুরো ইউরোপ জুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ,বিক্ষোভ। কম্যুনিস্ট দলগুলোই ছিল এসব বিক্ষোভের চালক।

চেকোস্লোভাকিয়ায় হয়ে যায় কম্যুনিস্ট ক্যু। এসবের ফলে ১৯৪৮ এই পশ্চিম ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন গঠন করতে হয় যার উদ্দেশ্য ছিল যেকোন রকম সামরিক আক্রমনের মিলিত জবাব দেয়া হবে। এই পদক্ষেপকে যুদ্ধোত্তর প্রথম ইউনিটি ধরা যায়। পশ্চিমা দেশগুলো লন্ডনে এক কনফারেন্সে ঘোষনা দেয় যে উন্নত অর্থনীতির লক্ষ্যে তাদের অংশের জার্মানী একত্রিত করে ফেলবে। স্ট্যালিন এতে ভয়ানক রাগ করে কারন তার উদ্দেশ্য ছিল জার্মানীকে যতটুকু সম্ভব দুর্বল করে রাখা।

ফ্রান্স ততদিনে মার্শাল প্ল্যানের লাভের গুড়ে আকৃষ্ট হয়ে গেছে এবং বুঝতে পেরেছে যে কন্টিনেন্টাল ইউরোপে প্রবেশে পুর্ব দিক থেকে রাশিয়াকে আটকানোর উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য জার্মানীকে পুনর্গঠন করতে চায়। তাই ফ্রান্সকে হারিয়ে রাশিয়া তার শক্তিমত্তায় আরো দুর্বল হয়ে যায়। স্ট্যালিন তখন পশ্চিমাদের চাপে ফেলার উদ্দেশ্যে বার্লিনে সকল প্রকারের যোগাযোগ স্থগিত করে দেয় ( বার্লিন ছিল রাশিয়ান এলাকর ভেতর) এখন প্রায় ১ বছরের মত সময় পশ্চিমারা আকাশ পথে খাদ্য-তেল ও ঔষধের মত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চালান দেয়। এই ব্লকেডের ফলে বাস্তবতা উপলব্ধি করে পশ্চিম জার্মানী গঠন তরান্বিত হয় এবং যেখানে জার্মানীকে নিশ্চিন্হ করে ফেলার কথা ছিল সেখানে ১৯৪৯ সালেই ২ টি জার্মানীর জন্ম হয়! ট্রুম্যান ও মার্শাল প্ল্যান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের অর্থনীতির লাগাম ধরে আর্থিক ভাবে ইউরোপকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই এবার তারা পরিকল্পনা নিল সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। ১৯৪৯ সালে ১১ টা দেশ নিয়ে গঠন করা হয় ন্যাটো।

গ্রীস,তুর্কী এবং পশ্চিম জার্মানীও পরে যোগ দেয়। যাদের মুল নীতি হচ্ছে একের উপর হামলা সকলের উপর হামলা বলে গণ্য হবে। এবং স্বাভাবিকভাবেই হামলার আশংকা ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার তরফ থেকেই। যার ফলে যুদ্ধে মিত্ররা সরাসরি সামরিক জোট গঠনের মাধ্যমে নিজেদের দ্বন্দ প্রকাশিত করলো। আর সোভিয়েতরা জবাব দেয় নিজেদের মাঝে একই রকম আরেকটি চুক্তি সম্পন্ন করে যার নাম "ওয়ার স প্যাক্ট"! তাদেরও লক্ষ্য ছিল ন্যাটোর তরফ থেকে যেকোন হামলা প্রতিরোধ করা।

যার ফলে ইউরোপ আক্ষরিক অর্থেই দুটো স্পষ্ট সামরিক জোটে বিভক্ত হয়ে যায়। এবং স্ট্যালিন সকল পুর্ব ইউরোপীয়ান দেশগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, যার জন্য চার্চিল হাভার্ডে দেয়া এক বক্তৃতায় সঠিক একটি নাম দেয় " আয়রন কার্টেইন" মানে লৌহ পর্দা! যেই পর্দা ইউরোপকে ১৯৮৯ পর্যন্ত ইউরোপকে বিভক্ত করে রাখে। ছবিতে বিভক্ত জার্মানী চলবে.......... আপনাদের ভাল লাগলে ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের ইতিহাস নিয়ে একটি সিরিজ করার ইচ্ছা আছে। এই পর্ব যুদ্ধপরবর্তী প্রথম ৪-৫ বছরের কথা বলছে যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ের ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়। আগামীতে পরবর্তী সময়ের ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আভ্যন্তরীন রাজনীতির ধারা বিবরনী থাকবে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     বুকমার্ক হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।