জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ অমৃত চায়।
আরজ আলী মাতুব্বর বরিশাল শহর থেকে প্রায় সাত আট কিলোমিটার দুরে লামচরী নামক এক গ্রামে ১৩০৭ বঙ্গাব্দে (১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ) এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। সেই গ্রামটি বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের মতোই সুন্দর প্রকৃতি, নিষ্ঠুর সমাজ, দরদী মানুষ, নির্মম বঞ্চনা ইত্যাদি সবকিছুই ছিলো স্বাভাবিক ভাবেই। ছোট বেলায তাঁর বাবা মারা যান।
মাকে নিয়ে কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়াই করতে বাধ্য হয়েছেন নিয়তঃই। মহাজনী ঋণের চক্র-জালে তাঁর বাবার কৃষি জমি চলে যায়। যে ঘরটিতে তিনি বসবাস করতেন সে ঘরের বর্ননা তিনি স্বয়ং দিয়েছিলেন এভাবে ঃ ‘দৈর্ঘ্যে পাঁচ হাত ও প্রস্থে চার হাত। ঘরখানা তৈরীর সরঞ্জাম ছিল ধৈঞ্চার চাল, গুয়াপাতার ছাউণী, মাদারের খাম, খেজুর পাতার বেড়া ও ঢেঁকি লতার বাঁধ। আর তারই মধ্যে ছিল ভাতের হাঁড়ি, পানির কলসী, পাকের চুলো, কাঁথা-বালিশ সবই।
রাতে শুতে হতো পা গুটিয়ে । ঘুমের ঘোরে কখনো পা মেলে ফেললে হয়তো ভাতের হাঁড়ি কাৎ হয়ে পড়তো বা জলের কলসী পড়ে গিয়ে কাঁথা বালিশ ভিজে যেতো। একটি এঁটেকলা দ্বারা তখন আমরা মায়ে-পুতে পান্তাভাত খেতাম দুবেলা। ’
এহেন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিক লেখা-পড়া করা কতো কষ্টকর তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু জ্ঞানের সন্ধানে অদম্য অসাধারন স্পৃহা থেকেই আরজ আলী মাতুব্বর হারিয়ে যাননি।
তাঁর কথায়, বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই। জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন। সেই অসীম জ্ঞানার্জনের মাধ্যম স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তা হচ্ছে লাইব্রেরী। ’ লাইব্রেরী ছিল তাঁর জীবনের প্রধান আনন্দক্ষেত্র। অন্যের নামে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বই এনে তিনি পড়তেন।
আমাদের সমাজ প্রশ্ন উত্থাপনকারী কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে। তাদের বিশ্বাস, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ’ শৈশব থেকে বেড়ে উঠা মত ও পথ নিয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে অস্বস্তি ও ভয় কাজ করে। কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বর এই ঘেরাটোপ থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন। মানুষের জীবনযাপন, বিশ্বাস, প্রথা, অনুশাসনকে ঘিরে তিনি প্রশ্ন করতেন।
এর প্রায় সব কটিই ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও সব ধর্মগ্রন্থে তা ছিলো অনুপস্থিত। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে তিনি লিখেন ‘সত্যের সন্ধান’। কিন্তু পাকিস্তান কাঠামোতে তাঁর সত্যের সন্ধান প্রকাশ করা সুযোগ হয়নি। তাঁর চিন্তা ও চেতনায় উত্থিত প্রশ্নগুলো নিয়ে শুধু যে তিনিই অক’ল সাগরে ভেসে যাচ্ছিলেন তা নয়, তার আশেপাশের মানুষকেও তা ভয়ানক ভাবে নাড়া দিয়েছিল। আর এসব প্রচলিত মত ও পথের বিরুদ্ধ প্রশ্নের কারণে তাঁর নামে ইস্যু হয় ফৌজদারি মামালার ওয়ারেন্ট।
আরজ আলী মাতুব্বর বলেন, ‘‘ ‘সত্যের সন্ধান’ - এর পান্ডুলিপিখানার বদৌলতে সে মামলায় আমি দৈহিক নিষ্কৃতি পেলাম বটে, কিন্তু মানসিক শাস্তি ভোগ করতে হলো বহু বছর। কেননা,তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা আমি প্রকাশ করতে পারবো না। ধর্মীয় সনাতন মতবাদের সমালোচনামূলক অন্য কোনো বই লিখতে পারেবো না এবং পারবো না কোনো সভা-সমিতি- বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বীয় মত প্রচার করতে। অগত্যা কলম ও কালাম বন্ধ করে আমাকে বসে থাকতে হলো ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ’’
বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান যতগুলো ধর্ম আছে, সেগুলোর চাইতে অনেক বেশি সংখ্যক ধর্ম মানুয় পার হয়ে এসেছে।
অর্থাৎ, যতো ধর্ম জীবিত আছে, তার থেকে মৃত ধর্মের সংখ্যা অনেক বেশি। একদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, তার সমাজ ও সংস্কৃতির আদলে ধর্ম গড়ে উঠে; অন্যদিকে প্রকৃতপক্ষে সমাজ-রাষ্ট্রের অভিব্যক্তি হয়ে উঠে ধর্ম। ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা মূলতঃ সমাজ-র্ষ্ট্রা নিয়েই আলোচনা। কেননা সমাজ-রাষ্ট্র বাদ দিয়ে ধর্মের অস্তিত্ব নেই। আমরা ইতিহাসে দেখি, মানুষের সমাজ জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের রূপও পরিবির্তত হয়ে গেছে।
গোত্রজীবন থেকে মানুষ যখন রাষ্ট্রজীবনে প্রবেশ করেছে, তখন ধর্মও গোত্রীয় পরিচয় থেকে রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে। যে সব জনগোষ্ঠী রাষ্টীক-সামরিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়েছে, তাদের ধর্মের প্রভাবও পড়েছে ততো বেশি। মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও ঈশ্বরের জ্ঞানেরও বৃদ্ধি ঘটে। সে জন্যই আগের ঈশ্বরের চেয়ে পরের ঈশ্বর অর্থাৎ আধুনিক ঈশ্বর অনেক পরিণত ও বুদ্ধি সম্পন্ন। বহু জতি, বহু গোত্র যেভাবে বিলুপ্ত হয়েছে, তেমনি বিলুপ্ত হয়েছে অনেক ধর্ম, অনেক ঈশ্বর, অনেক দেবদেবী, প্রতিনিধি।
এই কালে যে আর কোনো ধর্মের উদ্ভব হয় না, সেটাও মানুরের ক্রমবিবর্তিত সমাজের ‘ইচ্ছা’।
এক ধর্ম কখনোই আসলে একক ধর্ম নয়। সমাজে মানুষের মধ্যকার বৈষম্য, ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থান, নিপীড়ক ও নিপীড়িত এসবেরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ‘একই’ ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি, চর্চা ও ব্যাখ্যার মধ্যে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী নারকীয় ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে (তথাকথিত) আল্লাহ আর রাসুলের নামে; আবার, নিপীড়িত অসংখ্য নারী-পুরুষ বুক চিরে আর্তনাদ করেছে, জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেই একই আল্লাহর আর রাসুলের নামেই।
বিজ্ঞান ও সভ্যতা নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বরের মনোষোগ ও আগ্রহ ছিলো সরল রৈখিক।
সেটি স্পষ্ট হয় তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে। পারমানবিক শক্তি নিয়ে তাঁর উদ্বেগ ছিলে খুব বেশি। ‘ পারমানবিক শক্তি মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অর্জন। কিন্তু এই বিশাল শক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় না। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যদি জনগণের কাছে না থাকে , তাহলে বিজ্ঞানের এই বিশাল শক্তিই একদিন মানুষের ধ্বংেসের উপকরণ হয়ে উঠতে পারে।
’ তাঁর বক্তব্যের সার কথা হচ্ছে - দানবের কাছে বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব থাকলে বিজ্ঞানও হয়ে উঠতে পারে দানবীয়।
জন্ম-মৃত্যুর চক্রাবর্তে কোনো প্রজাতির চিরজীবী হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। প্রকৃতিই প্রাণের ¯্রষ্টা ও বিনষ্টকারী এবং তা বিবর্তন ক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত। আমরা নিজেরাই এখন বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটাচ্ছি। অথচ, আমাদের নিজেদেরও যে এই বিলুপ্তির পাকচক্রে পড়তে হবে, সে বিষয়ে আমার উদসীন।
মানুষ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলে তিনি এ বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করতেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজস্ব ধরনের চিন্তা ভাবনা শুরু করতেন। স্বশিক্ষিত আরজ আলী মাতুব্বর ১৩৯২ বঙ্গাব্দে (১৯৮৫ খ্রীষ্টাব্দ) ৮৬ বছর বয়সে তিনি মুত্যুবরন করেন। মৃত্যু পরবর্তীতে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তার মরদেহ হাসপাতালে দান করা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।