গেলো সপ্তাহে একটি জাতীয় দৈনিকের বক্স স্টোরি ছিল, "ধর্মবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে ২৮ বাউলকে দাঁড়ি ও গোঁফ কেটে তওবা পড়িয়েছে স্থানীয় কাঠমোল্লারা!"
এক) বাউল মানে কী? এ প্রশ্ন নিরন্তর; বাংলার হাজার বছরের চিরায়ত লোকসংস্কৃতি এখনও আঁকড়ে ধরে আছে বাউল নামের বাংলামাটির এই শিল্পীরা। তাঁদের কন্ঠে ওঠে আসে লোকজ সুর। এরা হয়তো আষ্টেপৃষ্টে আধুনিক বা স্মার্ট বেশভূষার কোনো পপ তারকাদের মতো মোহনীয় শিল্পী নয়; তবে এই ভাটিবাংলার মাটির গানগুলোকে এরা আঁকড়ে ধরে আছেন মনের গভীরে। যাতে নিখাঁদ মানবীয় প্রেম, মানবতা, দেহতত্ত্ব, শিল্পসত্ত্বা, সাধু'র সাধনা, ধ্যান-জ্ঞান আর মহাত্নার প্রেম নিবেদনসহ অনেক জাগতিক গানের লোকসুর ফুটে ওঠে। দেশের আনাচে-কানাচে,পথে-প্রান্তরে ঘুরেফিরে জনসাধারণকে এখনও দেহতত্ত্ব, শরিয়তি-মারফতিসহ শত শত গান শুনিয়ে জনমানুষকে মুগ্ধ করে চলেছেন শ্বাশ্বতকাল ধরে।
এমনকী ধর্মের অনেক মধুর কেচ্ছা-কাহিনিগুলোকেও তারা ফুটিয়ে তুলছেন সহজ সাবলীল ভংগীতে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে; যেখানে নেই কোনো ধূর্তামি। রাধা-কৃষ্ণ, ইউসুফ-জুলেখা, লায়লা-মজনুর প্রেম উপাখ্যান, রাবনের যুদ্ধ, বুদ্ধের ধ্যানমগ্নতা অথবা কারবালায় হাসান-হোসেন উপাখ্যান... কী নেই এসব লোকজ সংগীতের মাঝে? বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক এসব বাউল সম্প্রদায়।
দুই) লালন, হাসান, আব্দুল করীমের লোকজ গানের আবহ কখনও কী শেষ হওয়ার? কখনোই না। বরং এ ভাটি মুল্লুকের মাটি-মানুষের সংগে এই বাউল সাধকরা যেনো মিশে আছেন, তাঁদের চাহিডা কখনো দমে যাওয়ার নয়। বিশেষ করে গত এক দশকে নতুন নতুন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আর এফএম রেডিওর কল্যানে লালন, হাসন, করীমদের গান এখন মানুষের মুখে মুখে।
নতুন প্রজন্ম লালনদের গানে জীবনের নানা চেতনা খুঁজে পায়। তাঁদের অজেয় প্রেমের গান উদ্বেলিত করে এদেশের কোটি কোটি সংস্কৃত পাগল মানুষকে। সম্প্রতি ধর্মবিরোধী(!) কর্মকান্ডের অভিযোগে ২৮ জন বাউলকে দাঁড়ি ও গোঁফ কেটে তওবা পড়িয়েছে স্থানীয় কাঠমোল্লারা। একটি জাতীয় দৈনিকের খবর মারফত জানতে পারলাম স্থানীয় এক শ্রেণীর ধান্দাবাজ অসাধু রাজনৈতিক, ধর্মের নামে সোচ্চারী হিসেবে ঐসব বাউলকে মারধর করেছেন! এমনকী তাঁদেরকে জোরপূর্বক দাঁড়ি-গোঁফ কেটে দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে মসজিদে উঠিয়ে তওবা পড়িয়েছেন।
৩) বাংলাভাষা রক্ত দিয়ে কেনা।
এ ভাষার জন্যই ১৯৫২ সালে রক্ত ঝরিয়েছেন সালাম, রফিক, জব্বার, শফিকরা। আর রক্ত দিয়ে অর্জিত বাংলা ভাষার লোকজ গতিময়তাকে আপামর জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন এসব বাউলরা। তাঁরা তাঁদের লোকজ কন্ঠের দ্যোতনায় গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এসব লোকগানকে। বাংলা গানের সাধনায় যারা নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে দিয়েছেন, যারা নি:স্বার্থভাবে বাংলাভাষার গতিময়তাকে টিকিয়ে রেখেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে কেন এ ধরণের পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে পশুসদৃশ এক শ্রেণীর অসাধু রাজনৈতিক, তাদের পেছনে কারা? এই প্রশ্ন এখন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাছেই। যারা রাজবাড়ীতে বাউল সাধকদের উপর এ ধরনের ঘৃণ্য নির্যাতন চালিয়েছে, টারা বাঙালি হতে পারে না।
হয় তারা ধর্ম ব্যবসায়ী নতুবা পাকিস্তানি দোসরদের প্রেতাত্না। এর আগেও ২০০৮ সালে এসব প্রেতাত্না বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে অপমান করেছে, বিমান বন্দরের সামনে স্থাপিত লালনের ভাস্কর্য ভেংগে ফেলেছে। ধর্মের নাম ব্যবহার করে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানিরা বাঙালির ওপর যে শোষণ চালিয়েছিলো, স্বাধিনতা অর্জনের পরে ৪০ বছর পরেও সেসব প্রেতাত্না আজও যদি ধর্মের লেবাসে পশুবৃত্তি চালিয়ে যায় তবে স্বাধীনতার মাহাত্নটা কোথায়???
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের নতুন প্রজন্মের মাঝে লোকসংস্কৃতি নিয়ে যে গতিধারা সৃষ্টি হয়েছে, আমি ও আমরা সবাই সেই নতুনধারারই অংশীদার। যারা এদেশের লোকায়ত সংস্কৃতি, লালন, হাসন, করীম ও তাঁদের উত্তরসুরীদের মাঝে আমাদের শিকর খুঁজে পাই। আজ বিশ্বের অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলার লোকজ সংস্কৃতি, লোকগান নিয়ে গবেষণা করছে।
তারা যে দলেরই হোক অথবা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, শিগগিরই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু বিচারটা করবে কে, কারা????
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।