গেদু চাচার খোলা চিঠি।
চিত্র ১- বারিধারা ডিওএইচএসের একটি অভিজাত বাড়ি;সকাল থেকে যেখানে আজকের চিত্র আর সব দিন থেকে আলাদা। আজকে ওখানে ডিজে পার্টি...ঢাকা ক্লাবে টাকা ওড়ানোর কোন ছোয়া পাওয়া যাচ্ছে না...কম্পিউটারে আকাশ বাতাস কাপায় গলা ফাটাচ্ছে না মেটালিকা বা বন জোভির বন্য আওয়াজ...বাসার সবার পোষাক আজকে দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে শাড়ি...থ্রী পিছ...থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট হয়ে গেছে আরং,গ্রামীণ চেক...বা স্বনামধন্য কোন প্রতিষ্ঠানের পাঞ্জাবি আর পায়জামা। মা মানে রবিন আর জেরিনের মাম্মি আজকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছেন চুলের স্পাইক কাট টা বদলে সাধারণ ভাবে বের হতে...তাই আজকে চুল টা সাধারণ ভাবে রাখতে হয়েছে। বিরক্তি চরমে উঠে গেলেও...কোন এক নাম না জানা শিল্পি একটানা গেয়ে যাচ্ছেন ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’
খাবার টেবিলে সে এক বিরল দৃশ্য...ফ্রুট স্যালাদ...জ্যাম জেলি...ফ্রুট জুস...গরম কুকুর মানে আমরা যেটা হট ডগ বলি তা নেই...বদলে আছে অবাক করা বাসমতি চালের সুস্বাদু পান্তা ভাত...পাঁচ হাজার টাকায় বাসায় পৌছে যাওয়া বিশাল আকারে ইলিশ মাছ...আলু ভর্তা।
রবিন বা জেরিনের চোখ কিছুক্ষন কুচকে থাকে খাদ্যের ছিরি ছাদ দেখে। দেশের গোটা দশেক ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকার ঋণে গড়া দশটা কোম্পানির মালিক বাবা ছেলে মেয়ের দিকে স্নেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন...ভাবনা তাকে বিশ বছর পেছনে নিয়ে যায়। সদ্য দেশের ক্ষমতায় থাকা দলের পা চাটতে শুরু করেছেন। পরপর দুই বছরে দুইটা ছেলেমেয়ে হল...গ্রামে থাকা বাবা চিঠিতে বল্লেন ছেলের নাম রাব্বানি আর মেয়ের নাম জরিনা রাখতে...বাবার কথা রেখেছেন তবে একটু পরিবর্তন করে রবিন আর জেরিন রেখে...একটু পাশ্চাত্যের ছোঁয়া না থাকলে হয়?
বাবাকে ছেলে তার বিরক্তি ঢেকে না রেখেই বলেই ফেলল, ‘ইউ পিপল আর রিয়েলি ডিসগাস্টিং...ইজ ইট ফুড?...হাউ ক্যান আই টেক দ্যাট ড্যাড?’...বাবা,ছেলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। কোন ক্রমে রবিন আর জেরিনের কাছে তথাকথিত খাওয়া পর্ব শেষ হল।
যার যার ঘরে ফিরে রবিন ভ্যারন্স আর বাবা জিনের বোতল খুলে বসে। গতকালই এনবিআর থেকে চিঠি এসেছে কর ফাকির মামলার হুমকি...এগুলা কিছুই না...৫০০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিতে গেলে ৫০ লাখ ঘুষ...ব্যাস মামলা ফিনিস। চিঠিটা ড্রয়ারে রেখেই পুরা গ্লাসটা শেষ করে ফেলেন। ঘন্টাখানেক বাদেই বাবা আর ছেলে মেয়েরা আলাদা আলাদা ভাবে বের হয়ে পরে। প্রধান দরজা দিয়ে বের হতেই গাড়ির জানালার ফাঁক দারোয়ান কে কয়েক টা পাঁচ শত টাকা ছুড়ে দেন বাড়ির সাহেব।
চিত্র ২- ঢাকার কোন এক বস্তি। খুব সকাল বেলায় ঠাশ ঠাশ করে কয়েক টা থাপ্পরের শব্দ...না এটা একজন মানুষ আরেকজন কে থাপ্পর দিচ্ছে এমন না। এটা মশা মারার প্রানন্তকর চেষ্টা। এই মশাও জানে এদের শরীরে চুষে খাবার মত রক্ত নাই কিন্তু এরা এখন এরোসল আর জানালায় নেট এর জন্যে বড়লোকের বাসা ভেদ করে ঢুকতে পারেনা। ।
তাই পুষ্টির একমাত্র মাধ্যম এই বস্তি বাসি। এই বাড়ির কর্তা নেই...আছে নয় থেকে দশ বছরের মেয়ে সুমি আর তার মা যিনি কিনা আজ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। আজকে মা কখন খেতে দেবে সেই অপেক্ষায় থাকে না সুমি...ক্ষিধাতে তার ঘুম হয়নি রাতে।
সুমি তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে নেয়। পাশের ঘরের পিয়া বু তাকে আজকে রমনা পার্কে নিয়ে যাবে...যদি কিছু পেয়ে যায় তাহলে পেট ভরে খেতে পারবে।
কিন্তু কি পরে যাবে সে?যা আছে তা দিয়ে আজকাল লজ্জা ঢাকা দায়...এটা পরে তো আর অত লোকের ভিড়ের ভেতর যাওয়া যায় না...তাই প্রায় দম বন্ধ হয়ে যায় যে জামাটা পরলে সেই অতি আটো পোষাক পরে বের হয়ে যায়।
পিয়ার সাথে হাটতে হাটতে সুমির ক্লান্তি চলে আসে...আর কত দূর? এদিকে রাতের ক্ষিধার সাথে যোগ দিয়েছে সকাল আর প্রায় দুপুরের টা। রাস্তার পাশের চা এর দোকানিকে অনুরোধ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয়। অবশেষে দুর থেকেই বুঝতে পারে মেলা খুব বেশি দুরে নাই...জোরে জোরে পা চালায় সুমি আর পিয়া।
চিত্র ৩- ‘কই যাস?’...দারোয়ান আটকে দেয় সুমি আর পিয়া কে।
ওরা বলে ওঠে ‘ভেতরে যাব বটমুলে’। দারোয়ান ধমক দিয়ে ওঠে...পরে ঢুকবি। ওরা আঁতকে উঠে পাশেই দাঁড়ায় থাকে। ঠিক সেই সময় মার্সিডিজ বেঞ্জ থেকে নামে রবিন...মনে মনে আবহাওয়ার চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে সে। গাড়ি দেখে দারোয়ান জমে যায় তার জায়গায়...আর এই ফাকে সুমি আর পিয়া ঢুকে পরে।
বটমুলের এই জায়গাটা এই দিনেই বোধহয় বেশি সুন্দর। রবিন এর পাশেই দাড়ায় যায় সুমি আর সোনিয়া। একটু পরেই শুরু হয়ে যায় জাতীয় সংগীত...সুমি আর পিয়া অবাক হয়ে খেয়াল করে বড় লোকের এই ছেলেটা জাতীয় সংগীত এর বদলে অনুচ্চ কন্ঠে কি যেন বলছে...যাই হোক তারা পাত্তা দেয় না...তাদের বস্তির পাশের একটা ঘরে আপার শেখান জাতীয় সংগীত গাওয়ার এমন সুযোগ টা তারা খুব ভাল ভাবে নেয়। আর রবিন তার স্মৃতি শক্তির সব দিয়েও যখন এটা পারেনা তখন তার পাশেই দাঁড়ানো গায়ে সাবান আর মাথায় শ্যম্পুর অভাবে প্রকৃতিগত ভাবেই স্পাইক হয়ে যাওয়া চুলের অধিকারীনি দুই শিশু কে স্বগর্বে সেটা গাইতে দেখে অবাক হয়।
মধ্য দুপুর; ঢাকার অভিজাত রেস্তোরা ধানমন্ডির ষ্টারের সামনে এসে গাড়ি এসে থামে জেরিনের।
ঝটপট আজকে আর গাড়ি থেকে নামতে পারেনা আজকে তবুও যেন শাড়ি সে নিয়মিতই পরে এমন একটা ভাব নিয়ে তার আগের থেকেই অপেক্ষা করা বন্ধু বান্ধব্দের সাথে মিলিত হয়। খাবার চলে আসে সামনে...জেরিন শুধু অল্প একটু মুখে দেয়...আর বাকিটা নষ্ট হয়। একটা স্প্রাইট খেয়েই বিল দিতে উঠে যায়...কাউন্টারে এসে ফিস ফিস করে ম্যানেজার কে বাবার নাম বলতেই...ম্যানেজারের মুখের রং তিনবার পরিবর্তন হয়...হাসি মুখে বলে, ‘ম্যাডাম, আপনি আসছেন আমাকে বলবেন্না? আপনার জন্যে উপরে বসার জায়গা করে দিতাম’। ‘ইটস ওকে’ বলেই জেরিন গাড়ির উদ্দ্যেশে হাটা শুরু করে দেয়।
পিজা হাটসের ভেতরে অন্ধকার মত একটা জায়গা...যেখানে গোটা তিনেক বড় আকারের প্যান পিজা নিয়ে
বসে আছে রবিন আর আর দুই বান্ধবী।
একটা কামড় দিয়েই সে সকালের খাবারের উপর খিস্তি খেউর করে ওঠে। । সাথে সাথে একটা হাসির রোল পরে যায় টেবিল টায়।
রমনা বটমুলের চারপাশ দিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে শুরু করে দেয় সুমি আর পিয়া। মাঝে মাঝে সুমির খুব রাগ লাগে এই পেটের উপর...সময় নাই অসময় নাই খালি খিধা লাগে।
এত খাবার সে কোথা থেকে দেবে?। । ইদানিং সে বেশ বুঝতে পারে তার শরীরে কোথাও কোথাও পরিবর্তনের ছোয়া লাগছে...আর এই জন্যেই হয়ত মা তাকে বাইরে বের হতে নিষেধ করে। ওরা অবাক হয়ে খেয়াল করে সবাই যতটা ভাত মাখাচ্ছে তার থেকে সামান্য খাচ্ছে...অথচ কেউ বলছে না আয় আমাদের সাথে একটু ভাত খা!! সত্যি বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর...যার অঢেল আছে তার হিসাব নাই...আর যার হিসাব আছে তার খাওয়া নাই। ওদের খাওয়া দেখে সুমির পেটের খিধা যেন আরো বেড়ে যায়...কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো গরীবের অহংকার বেশি...অপমান বোধ বেশি তাই তাদের আর খাওয়ার চাওয়া হয় না।
চিত্র ৪- ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে সুমি আর পিয়া একটা গাছের ছায়ায় বসে পরে। একটু পর পাশেই দেখে তিনটা খাবার এর বক্স। ওরা কি করবে একটু দ্বিধাতে পরে যায়। সামান্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করে খাবারের দিকে আগাতে থাকে। বক্সটা খুলবে ঠিক এই সময় পেছন থেকে কেউ ওদের সজোরে লাথি মারে...অনাহারে থাকা সুমি আর পিয়া ছিটকে পরে সামনে।
এবার যে লাথি মারছে সে এসে ওদের দুই জনের চুলের মুঠি ধরে চিৎকার শুরু করে দেয়, ‘চুরি করতে আইছো না?খারাও মজা ট্যার পাওয়াইতাছি’...লোক টা সমানে চেঁচাতে থেকে ‘চোর চোর’...সুমি আর পিয়ার না খাওয়া হাল্কা শরীর তখন ঐ লোক টার চুল ধরে থাকার কারণে বাতাসে ঝুলছে...অনেক প্রতিবাদেও সেখান থেকে মুক্ত হতে পারে না তারা। এবারে লোকটা অনেক কে আগায় আসতে দেখে সুমি আর পিয়া কে এক চেটিয়া থাপ্পর দিতে থাকে...সুমি আর পিয়া তখন ব্যাথায় দিশেহারা। শুরু হয়ে জনতার বিচার...একেক জনের মার খেতে খেতে সুমি আর পিয়া এক সময় বোধ হারায় ফেলে...শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে একেক জন আসছে মারছে আর বলছে, ‘......পুলা চুরি করা হিকা গ্যাচোছ?’...সাথে সমানে লাথি। আরেকজন আগায় আসে...চুলের মুঠি ধরে শুন্যে তুলে ধরে...তারপর সজোরে মাটিতে আছাড় দেয়...পিয়া শুধু এক পলক দেখে সুমির জ্ঞান নাই...সে নিজেও জ্ঞান হারায় ফেলে।
চিত্র ৫- তীব্র একটা ঝাকুনিতে যেন ঘুম ভাংলো সুমির...সাথে সাথে একসাথে অনেকেই বলে ওঠে...,‘কইচিলামনা...কিছু হয় নাইক্কা...এগোরে কিচ্চু অয় না।
অর মাইরে বাপ...এলা চাইয়া রইচছ ক্যা?’...শুরু হয়ে যায় আবার মার পর্ব। কেউ কেউ বলে ওঠে ভাই বাদ দেন...পুলিশে দিয়ে দেন। অনেক মারছেন। সাথে সাথে জনতার মাঝে শোর গোল পরে যায়...পুলিশে দিমু মানে? রমনা বটমুল পর্যন্ত যাবার সময় সুমি আর পিয়ার সময় লাগছিল অনেক...ক্ষুধার্ত পেটে হাটতে অনেক কষ্ট কিন্তু বাইরে বের হয়ে আসল যেন বুলেটের বেগে...কখনও মানুষের লাথিতে উড়তে উড়তে কখনও চুলের মুঠি ধরে থাকার কারণে বাতাসে ভাসতে ভাসতে। জনরোষে এক সময় ওদের কে রিকশায় তুলে দেওয়া হল কিন্তু এবারে যেন শেষ পরিচর্যা...মানুষের ভরা পেটের মুষ্ঠির আঘাত...কখনও মাথায়...কখনও পায়ে...কখনও আবার তা ক্ষুধার্ত পেটের উপরে।
‘ও ভাই মাইরেন্না আমগো...ক্ষিধা পাইছিল ভাই...আমরা চুর না...সকাল থেইক্কা খাই নাইক্কা’...মানুষের মুখে জন্তুর শব্দের তোড়ে ওদের দুর্বল এই শব্দ গুলা চাপা পরে যায়। কারও একটা তীব্র ঘুষির আঘাতে চোখে আধার দেখে সুমি...জ্ঞান হারানোর আগেই ঝাপসা চোখে দেখে...অনেক দূরে হাজার হাজার মানুষের হাতে উচুতে একটা বিশাল কুমিরের প্রতিকৃতি আর ভেতরে খেয়ে ফেলা মানূষের হাত পা।
**এইটা বাঙ্গালীর একটা বিশেষ দিন....চেতনার দিন...বছর শুরুর দিন ‘বাংলা নববর্ষ’ দিনের চিত্র। আমরা ভুলে গেছি আমাদের ভেতরের অনুভুতি বোধ...আমরা ভুলে গেছি মানুষ কে মানুষ হিসেবে ভাবার অনুভুতি বোধ...যা জাতি হিসেবে আমাদের কে লজ্জায় ডোবায়...হয়ত আগামি বাংলা ১৪১৯ সালের প্রথম প্রহরের চিত্র আলাদা হবে...যেদিন সুমি আর পিয়ার মত কোন বাচ্চা কে না খেয়ে পথে পথে হাটতে হবেনা**
ভাত দে!!!!...গেদু চাচার খোলা চিঠি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।