গেদু চাচার খোলা চিঠি।
মা,
আস্সালামু আলাইকুম। এই শেষ বিকালে তোমাকে চিঠি লেখতে বসলাম। কেমন আছ মা? বেহেশ্তের ঐ সুখের জায়গাটায় বসেও জানি তুমি আমার জন্যে চিন্তা করো...আমি কি মা তোমার ছোট গেদুই আছি? তোমার গেদুরে কি বড় হতে দিবানা? মা গো,কালে কালে যে আমার বয়সও ছিয়াশি হয়ে গেল খেয়াল আছে? জানি এই কথাটা দেখে তুমি পানের পিকটা ফেলে একটা হাসি দিয়ে বলবা... ‘ছাওয়াল কয় কি? মায়ের কাছে ছাওয়াল বড় হয় রে?’
মা গো, রেডিও শুনতেছিলাম...সেখানে একটা গান শুনে তোমাকে চিঠি লেখাতে ইচ্ছা করলো,‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়বো না মা’...কিন্তু তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলা। মা গো,আজকালকার মায়েরা কত সুবিধা পায়...জানো মা...ওদের বাচ্চা হবার আগেই টিকা দেয় যেন ওরা পরে সমস্যায় না পরে কিন্তু তার পরেও ওরা হাজারটা কষ্ট আর সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকে।
মা তুমি কি চিনবা বললে?...ঐ যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন আছেনা? যারা নাকি বিশ্বের সব মানুষের স্বাস্থের দায়িত্ব নিছে...ওরা জানো...আমাদের দেশের সব মা আর মেয়েদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের পঙ্গু করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ফেলছে। তারা কি করছে জানো মা?এদেশের মাথা গুলাকে আগে মগজ ধোলাই দিছে...যে জনসংখ্যা কমাতে হলে আপনাদের মেয়েদের জন্ম নিয়ন্ত্রক ওষুধ খাওয়ান...আমরা বিনামুল্যে দেবার ব্যাবস্থা করছি। তারপর তাদের আরেক দোসর ইউনেস্কো, ইউএনএফপিএ আর জাতি সংঘরে দিয়ে পশ্চিমা দেশে তৈরি এসব জন্ম নিয়ন্ত্রক ওষুধ আমাদের দেশে প্রবেশ করাচ্ছে। এরপর এগুলা দেওয়া হয়ছে দেশের বিভিন্ন গ্রামের অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত চেয়াম্যান বা মেম্বরদের...বিপুল পরিমানে। মা গো, দেশের শহরের শিক্ষিত মেয়েরা না হয় জানে কিন্তু গ্রামের মেয়েরা?...কিভাবে?কখন বা কি পরিমানে খেতে হবে?...না তারা তা কিছুই জানেনা অনেক ক্ষেত্রে।
মা তোমাকে তাহলে একটা মজার এবং একই সাথে একটা চিত্র তুলে ধরার জন্যে গল্প বলি... ‘আমাদের গ্রামের সেলিম চেয়ারম্যান এর বউ সেদিন আমারে চা দিতে দিতে বলল চাচাজি, এইবার আমাদের কুকুরটা আর বাচ্চা দেয়নাই...কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলল ভাতের সাথে জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি মিশায় খাওয়াইছে। তা হলে মা তুমিই বলো যে জিনিষটার প্রাচুর্যতা এত বেশি অথচ সেখানকার মহিলারা ঠিক মত তার ব্যাবহার বিধি জানেনা তারা কেমন আছে? কেমন ভবিষ্যৎ আনছে তারা? মা গো,খুব কান্না পায়...আমাদের বাচ্চা মা,কিশোরী মা,যুবতি মা...কিংবা যে কালকেই মা হবে তারা ভাল নেই। আমরা তাদের শিক্ষা,সামাজিক নিরাপত্তা থেকে তো বঞ্চিত করছিই সাথে সাথে তাদের কে বিষ দিয়ে দিন দিন পঙ্গু বানায় ফেলছি। তারা জানেনা যে তারা যেটা খায়...সেটা উন্নত দেশ থেকে আমাদের দেশে আসে পরীক্ষার জন্যে...তারমানে আমাদের মায়েরা হলো তাদের কাছে গিনিপিগ। অথচ মা;যারা তাদের পরিবারটাকে ছোট রাখতে চায় সেই সব পরিবারের মায়েরা ‘লাইগ্রেশন’বা পুরুষেরা ‘ভ্যাসেক্টমি’ নামক ছোট একটা অপারেশন করায় নিলেই এই বিষটা আর খেতে হয় না।
আমরা তাদের কে এই তথ্য কতটা জানাচ্ছি সেটাও একটা বিষয়।
মা গো, বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশের মাথায় কি বুদ্ধি দেখ...জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি খাওয়ায় তো জন্ম ঠেকালাম...কিন্তু সাথে সাথে আরেকটা ক্ষতিও করে দিলাম...যেসব মায়েরা এগুলা খাবে তাদের বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্যে বুকের দুধ কমে যাবে...তাহলে কি করা যায়?এবার বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্যে নিউজিল্যান্ড ,অষ্ট্রেলিয়া থেকে গুড়া দুধ আমদানী করো...যা কিনা তাদের দেশের বাচ্চাদের একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে খাওয়ানো নিষেধ...আর বাচ্চা জন্মানোর আগেই আমরা কয়েক কৌটা কিনে রাখি...তা হলে এদেশের শিশুরা কিভাবে বাড়বে?এক শ্রেণীর আমদানীকারকের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ...তারা ভাবছেনা আমাদের আগামি দিনের কান্ডারিরা দুর্বল শরীর আর দুর্বল মেধা নিয়ে বড় হচ্ছে। এদেশের ডাক্তাররা চুপ...দেশের নীতিনির্ধারকরা চুপ...দেশের পুষ্টিবিদেরা চুপ...কারণ সবারই স্বার্থ আছে এতে...দেশ দেশ করে কি লাভ?
মা গো, বড় অদ্ভুত এই দেশের মানুষ আর তার চিকিৎসা ব্যবস্থা। আমরা ছিলাম দশ ভাই আর চার বোন...আল্লাহর রহমতে সবাই সুস্থ আর স্বাভাবিক ছিলাম...কোনদিন তোমাকে দেখিনি অসুখে পরে থাকতে। অথচ মা; এখন ডাক্তাররা সিজার ছাড়া কিছুই বোঝে না...সুস্থ মা কে টুকরা টুকরা করে বাচ্চা আনা লাগবেই তাদের...আবার কত কথা তাদের সিজার করা বাচ্চার নাকি মেধা ভাল হয় তাহলে মা...যারা স্বাভাবিকভাবে বাচ্চার জন্ম দেয় সেইসব বাচ্চা কি পড়ালেখা না জানা গন্ড মুর্খ থাকে?মা গো, দুঃখের কথা কি জানো? এখন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গেলে সিজার ছড়া যেমন বুঝে না তেমনি আজকালকার মায়েরাও এটাকে একটা ফ্যাশানের পর্যায় নিয়ে গেছেন; তারা বুঝতেছেন না যে তার একদম প্রয়োজন ছাড়া সিজার করে বাচ্চা নেওয়াটা কত বড় ক্ষতিকর...সারা জীবনের জন্যে তার একটা শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং সেই বাচ্চাটার উপরে ওষুধের প্রভাব পরা।
মা গো, সেদিন খুব সর্দি লাগছিলো...বাজার থেকে আনা সরিষার তেল নাকে মুখে দিতেই...উল্টা সারা মুখ চোখ জ্বলা শুরু করলো। এক ব্যারেল রাই বা তিষির তেলের মাঝে এক ফোটা সরিষার তেলের ঝাঁঝ আর গন্ধ আনার জন্যে একটা বিশেষ রাসায়নিক দ্রব্য হয়ে গেল সরিষার তেল...কি অবাক কান্ড না মা?জ্বর আসলে তোমার সেই সরিষার তেল,কাঁচা মরিচ আর মুড়ি মাখানোর কথা মনে পরে গেল। মাঠে আব্বাকে খাবার দিয়ে বাড়ি ফেরার পথটা সারা গ্রামের রানা ঘর থেকে সরিষার তেলের রান্নার গন্ধে মঁ মঁ করতো। শীতে সরিষার তেল গায়ে দিয়ে গোসল...তারপর সরিষার তেলে কাঁটাআলা বড় বড় বেগুন পোড়ানো ভর্তা আর মাছের ঝোল...সেই কাঁটাআলা বেগুন নাই আর নাই খাটি সরিষার তেল কিন্তু তোমার হাতের রান্নার স্বাদ এখনও অনুভব করতে পারি। মা,আমাদের দেশের কৃষিবিদরা দেশীয় বেগুন কে রক্ষা করেন্নি তারা শুধু ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ধ্বংস করে গেছেন এই দেশের দেশীয় জাতের সব ফসল।
এখন তুমি থাকলে একটা বেগুন দিয়ে সারা পরিবাবের রান্না সারতে পারতা কিন্তু স্বাদ নামের সেই বস্তুটা থাকতো না। যে দেশের নিজস্ব নীতিমালা থাকেনা তারা কি দেবে আগামী প্রজন্ম কে আমার ভাবতে বড় কষ্ট হয়। মা কি আশ্চর্য্য ব্যাপার জানো? সয়াবিন তেল বাইরে থেকে দেশে ঢোকাতে হবে...তাই কি করা যায়?দেশের সব মিডিয়াকে দিয়ে সরকার আর এই দেশের নিমকহারাম কৃষিবিদ,ডাক্তার আর বড় বড় আমলারা প্রচার করালো সরিষার তেলে ইরাইথ্রিক এসিড আছে...যা আমাদের শরীরের জন্যে ক্ষতিকর;ব্যাস লেগে গেল ধুন্দুমার কান্ড; রাখো সরিষার তেল খাও সয়াবিন। অথচ নীতিমালায় কিন্তু লেখে নেওয়া হলনা আমরা এই সয়াবিন নিয়ে গভেষনা করতে পারব কিনা?... এখন সয়াবিন তেলের দাম দিন দিন লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ছে...কিন্তু অসহয়ায় সরকার আর সাথে দেশের মানুষ। কেন? যারা সয়াবিন এদেশে প্রবেশ করায়ছে তাদের নীতিমালা অনুযায়ী তুমি দেশে এইটা নিয়ে গভেষনা করতে পারবানা...বড় পরিসরে চাষ করে কাঁচামাল উৎপাদন করতে পারবানা...শুধুমাত্র বাইরে থেকে কাঁচামাল কিনে এনে সেটা দেশে প্রক্রিয়াজাত করতে পারবা।
তাই আজকে আমেরিকা,ব্রিটেন বা বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশ বলছে ডলারের দাম বাড়ছে তাই কাঁচামাল এই দামে কিনতে হবে...কিনলে কিনো...না কিনলে পানি দিয়ে তরকারি রান্না করে খাও। তুমি তো সরিষার বীজ সংরক্ষন করে রাখনি ...তাই কি চাষ করবা? সুতরাং যা বলবে তাই দিয়ে কিনতে হবে। এরপর আছে দেশের মালিকদের বিশ্ববাজারে এক টাকা বাড়লে জিনিষপত্রের দাম পাঁচগুন বাড়ানোর প্রবনতা...তাই দুয়ে দুয়ে চার...সয়াবিন তেলের দাম এখন ১২০ টাকা লিটার। মা গো, এদেশে যার দাম একবার বাড়বে তা আর কমবে না...তাই ডিমের হালি যখন ২২টাকা ছিল তখন হোটেলে ডিম খেলে দিতাম ৬ টাকা...এই ডিম যখন হয়ে গেল ৩০-৩৫ টাকা তখন দিলাম ১০ টাকা আর এখন আবার সেই ২২ টাকা হালি...কিন্তু ডিম খাই ১০ টাকাই...বলার কেউ নাই...দেখার কেউ নাই। যারা বলবে তারা জীবনে কখনো বাজারে যায়নি...তাদের বাজার করতে টাকা লাগেনা তাই তারা এখন ভোল পালটায় আগে ভাগেই ক্ষমা চেয়ে রাখে...বড় অদ্ভুত এই মানুষ গুলা।
মা গো, মাঝে মাঝে তোমার সেই মিষ্টি স্বাদের লাল চালের ভাতের কথা খুব মনে পড়ে। যা ছিল আমাদের প্রায় নিত্য দিনের খাবার তাকে আমরা খুব সুন্দর ভাবে এদেশ থেকে প্রায় বিদায় করে দিছি। বলা হচ্ছে দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা বাড়ছে তাই উৎপাদন বাড়াও। উৎপাদন বৃদ্ধি পাক তা আমিও চাই কিন্তু তাই বলে কি দেশীয় জাত কে সংরক্ষন না করে ? এদেশে বিএডিসি নামক একটা সরকারী প্রতিষ্ঠান আছে যাদের দায়িত্ব দেশের প্রয়োজনীয় বীজ উৎপাদন করা...ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সরকারকে বলেছে বন্ধ করে দাও সেটা...না হলে ঋণ দেব না...আসলে ঋণ না আসল উদ্দেশ্য অন্য জায়গায়। এদেশের বীজ তারা দেবে...কিভাবে? দেশের কিছু কিছু এনজিও যারা কিনা আমেরিকা বা অন্যান্য দেশের মদদ পুষ্ট বলা হচ্ছে তাদের কে বীজ উৎপাদন এর জন্য অনুমতি দেবার জন্যে...তারা কি করছে? দেশের গন্ডমুর্খ আর সহজ সরল চাষীদের বুঝাচ্ছে হাইব্রীড ধান লাগাও ফলন বেশি পাবা...সাথে সাথে আমাদের কৃষিবিদেরাও।
কিন্তু এতে দোষের কি হলো?...আছে মা খেলা তো অন্য জায়গায়...ধরো প্রথম প্রথম তোমাকে দেওয়া হলো এক আঁটি ধান বীজ ২৫০-৩০০ টাকায়...তুমি দেখলা আরে এতো বিশাল লাভ...শুরু করে দিলা চাষ...নিজেদের কাছে কিন্তু বীজের মজুদ নাই। এই হাইব্রীড ধানের বৈশিষ্ট কি জানো মা ? আমরা যেমন একবার ধান লাগায় সেটার ভাতও খেতাম আবার বীজও রেখে দিতাম...কিন্তু হাইব্রীড ধানের ক্ষেত্রে তুমি তা করতে পারবানা এর কারন হলো প্রথম বারে(এফ ওয়ান প্রজেনি) এই বীজ দেবে সব একই ধরনের ধান কিন্তু যেই প্রথম বারের ধান নিয়ে দ্বিতীয় বার জমিতে লাগাবা...সব ধান এক রকম হবে না এবং তার উৎপাদনও কাংখিত মাত্রায় আসবে না। এখন তোমার কাছে দিন দিন কমে গেছে বীজের মজুদ...তাই তুমি বাধ্য ওদের কাছ থেকে ধান কিন্তে। এখন ওরা যেই দেখল দেশের চাষীদের কাছে বীজ নাই এবার তারা ইচ্ছামত দাম বাড়িয়ে দিল...কিনবা না মা?...ধান না লাগালে খাবা কি?...আমরা দেশের চালের দাম ১০০ টাকা কেন চিৎকার করছি কিন্তু এটা যে ভবিষ্যতে ১০০০ টাকা হবে তা কিন্তু ভাবছিনা। তাই শুধু সরকারের দোষ না দেশের অন্ন যোগানের কারিগর এইসব সহজ সরল চাষীদের এখনই বুঝাতে হবে যে বীজের ষ্টক যেন তারা নিজেরাই সংরক্ষন করেন আর যেন ভবিষ্যতে আন্দোলনে গেলে দেশের মানুষ কে না খেয়ে যেন থাকতে না হয়।
মা গো, তুমি তোমার গেদুরে যেমন রেখে গেছিলা...তার ছিটেফোটা আছে বলে আমি আজকে লিখতে পারলাম...কিন্তু সারা বাংলাদেশে ছড়ায় ছিটায় থাকা তোমার আর সব ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিরা বড় অসহায়। ওরা শারীরিক ভাবে অসুস্থ মায়ের পেট থেকে অসুস্থ অবস্থায় বের হয়...সারাজিবন ভ্যাজাল খেয়ে আরো অসুস্থ হয়...কিন্তু এই নিয়েও ওদের জীবনিশক্তি দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবা...ওরা রাত জেগে দেশকে ভালবাসে...দেশের জন্যে রাজপথে প্রতিবাদ করে...বাইরে থেকে বাংলাদেশের জন্যে সম্মান কুড়ায় আনে তাই আমি বলি তোরাই আসল বীর...।
ভাল থাক মা,আবার লেখবো তোমাকে...আমার জন্যে দোয়া করো।
ইতি,
তোমার গেদু।
মা কে লেখা গেদু চাচার খোলা চিঠি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।