শাদা পরচুল অন্ধকার
অনন্যা তার শোবার ঘরের জানলাটা খুলে দিল। তাকিয়ে দেখল বাইরে ক্রোধোন্মত্ত আকাশ। দমকা হাওয়া-তার সাথে অবিরাম বৃষ্টি। হঠাৎ শোনা গেল ঘড়ির ঘণ্টা, রাত্রি একটা বাজে। ঘনায়মান অন্ধকারের সাথে বৃষ্টি অন্যরকম একটা আবেশ তৈরী করছে।
অনন্যার কিছুই ভাল লাগছে না। একঘেয়েমি কাটাতে একটা বই তুলে নিল। দু চার পাতা পড়েই ছুড়ে ফেলে দিল টেবিলে। উদাস মনে ভাবতে লাগল রিমনের কথা।
হয়ত এমন বৃষ্টির দিনে রিমন ফোন করে বলত -অন্য কি করছ? আমি এখন বৃষ্টিতে ভিজছি,তুমি ভিজবে না ? অনন্যা তখন উত্তর করত-এই রাতে,পাগল!রিমন হেসেই উড়িয়ে দিত-কিচ্ছু হবে না,ওঠোতো ছাঁদে যাও।
ভাবতে ভাবতে, চোখে জল চলে এল ওর। হায়, আজও কি রিমন সে রকমই আছে ?
হঠাৎ একটা ফোন আসায় ভাবনায় ছেদ পড়ল। নম্বরটা একদমই অপরিচিত। ফোনটা ধরবে কি ধরবে না,ভাবতে লাগল। এরপর ধরেই ফেলল
হ্যালো! ওপাশ থেকে বেশ শান্ত গলায় কেউ একজন বলে উঠল, হ্যালো,রিমি আছে ? দেয়া যাবে ওকে ?
-সরি,রং নাম্বার।
বিরক্ত হয়ে ফোনটা রাখল ও। কেন যে ফোনটা ধরল সেটাই ওর কাছে অবাক লাগছিল। যাহোক, ওই নাম্বার থেকে আবার ফোন এল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধরল অনন্যা-হ্যালো। ওপাশ থেকে কেমন একটা মোহময় কণ্ঠে শোনা গেল ,
এক্সকিউজ মি! আমি আসলে আমার এক বন্ধু রিমিকে কিছু কথা বলবার জন্যেই ফোন করেছিলাম।
এত রাতে আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখিত , ভীষণ দুঃখিত।
-না,না ঠিক আছে। ইট্স ওকে! দুঃখ পাবারতো কিছু নেই। ভুলতো মানুষেরই হতে পারে।
কথা শেষ হবার আগেই ওপাশ থেকে বলে উঠল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
-কেন ?
রাগ না করবার জন্যে। “ও আচ্ছা” বলে অনন্যা যেই না ফোন রাখতে গেল, ও পাশ থেকে সে শশব্যাস্ত হয়ে বলে উঠল -
আরে আরে, দাড়ান। একটু সবুর করুন। এত ব্যস্ততা কিসের ? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি ?
লোকটার কথাবার্তা সন্দেহজনক ভেবে অনন্যা ওর গলার স্বর কিছুটা গম্ভীর করে বলল - তা জেনে আপনার লাভ ?
না,লাভ তেমন নেই। তবে কী জানেন,আপরিচিত কারো রাতের ঘুম নষ্ট করার মাঝে একটা মজা আছে,আর এ আমার অনেক দিনের শখ।
আজ যদি সেটা পূরণ হয়েই যায়.......
ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে অনন্যা বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলে উঠল-মানে কী এসবের? আপনি কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন। এ রকম বাজে শখ হবার কারণ?
কোন কারণ নেই। আচ্ছা বলুনতো কটা কাজ আমরা কারণ ভেবে, লাভ-ক্ষতি, দেনা-পাওনার হিসাব মিলিয়ে করি ? আমরা কী -
-থামুন, আর কথা বাড়াবেন না।
আপনার সঙ্গে আমার কথা বলতে ভালই লাগছে। সত্যি বলতে কী বেশ আগ্রহ বাড়ছে - আপনার সম্পর্কে জানতে।
কিন্তু আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন?
-দেখুন আপনার সাথে কথা বলতে আমার আগ্রহ হচ্ছে না। অপরিচিত কারো সাথে আমি কথা বলি না। রাখছি, বলা মাত্র সে ফোন রেখে দিল।
ফোনটা রেখে দেবার সময় রাগটা যেমন ঝড়ো হাওয়ার মতো এসেছিল,তেমনি করেই সে উবে গেল। মনে হতে লাগল-কথা হচ্ছিল, এইতো! এমন তো কোন ক্ষতি হচ্ছিল না।
ওর এমন ভাববার মাঝেই আবার ফোন এল। অনন্যা বুঝতে পারল না সে কী করবে? ওই যে ফোনটা কেটেছে! পরে অবশ্য কলটা রিসিভ করল।
কী ব্যাপার ভাই? ফোনটা রেখে দিলেন কেন? আবার রাখলেনই যদি তবে কেন রিসিভ করলেন?
-সে আমার ইচ্ছে! আচ্ছা আপনি পরিষ্কার করে বলুনতো, আপনার উদ্দেশ্য কী? এত রাতে কেন একজন মেয়েকে ডিস্টার্ব করছেন?
কোন উদ্দেশ্য নেই,সত্যি! শুধু আপনার সাথে কথা বলতে চাই।
-কেন, আমি আপনার কে? একজন অচেনা, অজানা অপরিচিতের সাথে কেন কথা বলতে চান, আমি মেয়ে বলে? আর আমি যে তা পছন্দ করব, তাই বা ভাবলেন কী করে?
দেখুন চোখের দেখা না হলে,বা চেনা জানা না হলেই কী অজানা হয়? এক কাজ করুন,আমার সাথে অপরিচিত অবস্খায় কথা বলতে অস্বস্তি লাগে তবে নিজেই চিনে নিন আমায়।
-কিভাবে ?
অতি সহজ।
চোখটা বন্ধ করুন আর মনকে প্রসারিত করুন তার সীমা থেকে আরও দূর পর্যন্ত। আর তারপর.....
-ও সব হেয়ালি রাখুন। মানছি আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। দেখুন,আমি অপরিচিত কারো সাথে কথা বলিনা, আর আজও বলব না। আর আপনার সঙ্গে কথা বলছি প্রায় দশ মিনিট হল।
এই যথেষ্ট। এবার ফোনটা রাখুন। নয়ত আমিই রাখি।
কথা শেষ হবার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর বলে উঠল,
আরে,আরে দাড়ান। এক মিনিট please।
আপনার বিরুদ্ধে আমার দুটো অভিযোগ আছে।
-কী অভিযোগ? তাড়াতাড়ি বলুন এবং ফোনটা রাখুন ।
প্রথমত আপনি প্রচন্ড রকমের unsocial, যাকে বলে রীতিমত অসামাজিক ।
কথাটা শেষ হতেই শোনা গেল বিকট শব্দে হো হো হাসি । যেন যুদ্ধজয় হয়ে গেছে এরকম একটা ভাব ।
প্রচন্ড বিরক্তি আড়াল করে অনন্যা বলল
-কেন, হঠাৎ এরকম মনে হবার কারণ?
এই যে আপনাকে আমি এত বার বললাম আপনার সাথে শুধু কথাই বলব আর আপনি রেখে দিচ্ছেন। এভাবে কেউ রাখে।
হেসে অনন্যা বলল, বেশ আপনার প্রথম অভিযোগ মেনে নিলাম এবং তার জন্য দুঃখিত, হল?
জী,এবারে দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে-আমার ধারণা আপনি আমাকে মিথ্যে বলছেন।
-কী,মিথ্যে বলছি,আমি! বাহ, নিজেকে সর্বজ্ঞ ভাবেন দেখছি । তা কেন মনে হল মিথ্যে বলছি?
এই যে,আপনার ব্যস্ততা দেখে।
মনে হয় আপনি অন্য কারো ফোনের জন্য অপেক্ষা করছেন। বোধহয় ডিস্টার্ব হচ্ছে আমি ফোন করায়।
-আপনি শতভাগ ভুল। আমি কারা ফোনের জন্যেই অপেক্ষা করছি না। বোঝার চেষ্টা করুন আমি অপরিচিতের সাথে কথা বলি না।
এটা আমার একটা রেকর্ড বলতে পারেন।
একটু অহঙ্কারের ভাব চলে এল অনন্যার মনে । তার মনে পড়ে যায় গত দু বছরে সে রাতে কারো সাথে কোনদিন পাচ মিনিটও কথা বলেনি । একটু আনমনা হতেই আবার শুরু ওপাশের কর্কশ কন্ঠের রেলগাড়িটা,
হাহ্ রেকডের্র কথা বলছেন? আচ্ছা বলুনতো, রেকর্ড কেন গড়া হয়? সেতো ভাঙবার জন্যেই। এই যে দেখুন ৬ মাসও রেকর্ডটা ওয়ার্নের হাতে রইল না, মুরালি কেড়ে নিল।
তাই বলে ওয়ার্নি তো আর ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করে কাঁদেনি।
-আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। কী বলতে চাইছেন আপনি? রেকর্ড ভেঙে গেলে আমি কাঁদতে শুরু করব বলে আপনার মনে হয়?
অনেকটা সে রকমই। মনে হওয়াটা স্বাভাবিক কী নয়? আপনিই বলুন।
-না মোটেই স্বাভাবিক নয়।
আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি রেকর্ড ভেঙে গেলে আমি কোন কষ্টই পাবো না। না,হয়ত মিথ্যে বললাম হয়তবা কষ্ট পাবো,কিন্তু কাঁদব না। আমি খুব শক্ত একটা মেয়ে। এটা আমার কথা না। আমার বন্ধুবান্ধব সবাই একথা বলে।
একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। এরপর সে বলে উঠল-বুঝলাম। দুঃখ এই-রেকর্ডটা তো একদিন ভেঙেই যাবে,কিন্তু আফসোস, আমি তার সুযোগ পাবো না। ভাবতেই খারাপ লাগছে। আপনি যখন কথা বলবেন না তখন রাখি।
ওর এমন কথা শুনে হেসে উঠল অনন্যা। হাসি চাপিয়ে ও বলল
- আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার হাতেই রেকর্ডটা ভাঙল। অপরিচিত আপনার সাথেই কথা বললাম। তা বলুন কী বলবেন?
যাক এতক্ষণে তাহলে রাজি হলেন। বরফ গলল তাহলে......
-ঠিক আছে।
আমি রাখছি।
যাহ্ বাবা, আপনি যে এত ব্যস্ত জানতাম না তো, ঠিক হরলিকসের অ্যাডের বাচ্চাটার মত। আচ্ছা ভাই দু:খিত। আর এভাবে বলব না।
-বেশ তো বলুন কী বলবেন ?
কী যে বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না
-না পারার তো কিছু নেই।
আপনি বেশ বাকপটু। সত্যি বলতে আপনি বেশ সুন্দর, বেশ মজা করে কথা বলেন।
হ্যা,তা আমি জানি। সে আপনার না বললেও চলবে।
-এ কী? এতো দেখি নিজের ঢোল নিজেই পেটায়।
তাতো একটু পেটাতেই হয়। না হলে আজকাল আর পাত্তা পাওয়া যায় না। এখন তো সবাই শক্তের ভক্ত নরমের যম, আগে ছিল পাতি, এখন স্বয়ং আযরাইল।
হেসে অনন্যা বলল, জোকার একটা। সেই শুরু থেকে অনবরত কথা বলেই যাচ্ছেন,বলেই যাচ্ছেন।
এত কথা বলেন কি করে! অবাক কান্ড ।
তা আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার বন্ধুরা মাঝে মাঝে বলে এক কাজ কর,পড়ালেখা বাদ দিয়ে জোকার হ্। উন্নতি করতে পারবি। দেশের বিশিষ্ট জোকার হবি।
-আমারও তাই ধারণা।
কি বললেন? আপনি কী আমায় অপমান করতে চাইছেন।
- না তা করব কেন? অবশ্য সত্য কথা বললে আনেকেরই গায়ে লাগে।
আচ্ছা এসব বাদ দিন। কথা বলছি প্রায় আধঘন্টা হল।
এখন আসুন নাম পরিচয়ের কাজটা সেরে ফেলি। তা বলুন কী নাম আপনার মহারাণী?
-মহারাণী? কোন মহারাণী?
যে কেউ, যাকে আপনার পছন্দ। এই যেমন ভিক্টোরিয়া।
-ভিক্টোরিয়া বেশ!
জানেন তো ভিক্টোরিয়ার স্বামী কজন ছিলেন? আপনিও কী সেই আদর্শে হাটতে চান?।
-আপনি তো মহা ধাড়িবাজ।
কি বলতে চাইছেন।
না না, তেমন কিছুই না। আসলে কি জানেন একটা কথা আছে। ইংরেজীতে, tit for tat। ঢিলটি মারলেন পাটকেলটি তো খেতেই হবে নাকি? আপনি যা করলেন তাই করবার চেষ্টা করলাম মাত্র।
-ওফ্ বাবা, এত কথা বলেন কেন আপনি? ওসব মান অপমানের কথা রেখে কাজের কথায় আসুন। জানতে চেয়েছিলেন তো নাম,না কি?
হ্যা,হ্যা মহারাণী অধম আপনার নাম জানতে চায়! ধন্য করুন আমায়।
-মুচকি হেসে অনন্যা বলল, আমার নাম রিয়া। অবশ্য আরেকটা নামও আছে,বৃষ্টি। তা আপনার নাম?
যাক অধমের পানে মহারাণীর কৃপা হল।
জন্মের পরে বাবা মা নাম রেখেছিলেন তন্ময়। দুঃখের ব্যাপার কি জানেন,সারা জীবন খুঁজেও আমার মধ্যে তন্ময় হবার মত কিছু পেলাম না। বলুন কী বিচিত্র?কী দেখেই যে তারা নাম রেখেছিলেন......
-কেন কেন? আপনি খুজে পাননি মাত্র আধঘন্টার কিছু বেশি সময় কথা বলেই তো আমি বুঝে গেছি। খুব বেশি দূর না গিয়ে নিজের ভেতরটা নিয়ে ভাবুন। আপনার বাকপটুতার কাছে রেডিও ফেল।
আপনি তো একটা টেপ রেকর্ডার! কথা দিয়েই তো আপনি সবাইকে মন্ত্র মুগ্ধ করে ফেলতে পারেন।
শুকরিয়া শুকরিয়া,কেয়া বাত কারতেহে তুম, মহারাণী! আপ মুঝে কামাল কার দিয়া! কেয়া বাত, কেয়া বাত!
-আচ্ছা আপনার সাথে আমি এত সহজ হয়ে কথা বলছি কেন? আপনার উদ্দেশ্য কী বলুনতো ? আপনি কী আমাকে নিয়ে কোন ধরণের খেলা খেলতে চাইছেন। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আপনি কী আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছেন ? কোন রকম ফায়দা লুটতে চাচ্ছেন ??
মাঝে মাঝে কী হয় আপনার,বলুনতো? কেন মনে হল আপনাকে প্রতারিত করতে চাইছি? আমিতো আপনাকে কোন তোষামোদ করা কথা বলিনি। এতক্ষণ কথা বললাম,একবারও তো বলিনি-আপনার আওয়াজ কোকিলের চেয়েও মধুর, কথা বলার স্টাইল সবার আইকন হবার যোগ্য, আপনার হাসির মধ্যে একটা আশ্চর্য ধরণের মায়া আছে।
-আমি হাসলাম, কখন?
কেন এর মধ্যে আপনি তিন চার বার হেসেছেন। অবশ্য মুচকি হাসি।
-তাও লক্ষ্য করেছেন। আপনার সঙ্গে আমি কথায় পারব না। তা কি করেন আপনি?
অনন্যা এই প্রশ্ন করার পরই হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল।
ও ভাবল কী হল। কিন্তু ও পাশ থেকে কোন কল এল না। ও ফোন ধরার জন্যে অধীর হয়ে বসে আছে। আশ্চর্য! ঘন্টা খানেক আগেও যে ফোন ধরতে চাইছিল না, কথা বলতে ছিল নিদারুন অনাগ্রহ-সেই এখন কথা বলার তৃষ্ণায় পাগল হয়ে উঠেছে। নিজেকে সামলে নিতে পারল না অনন্যা।
দু মিনিট যেতেই নিজেই ফোন করে বসল-
আগামী পর্বে সমাপ্য.......................
হি হি হি, গল্প রেডিই আছে । এটা হইল সাসপেন্স । আর অধৈর্য্য ব্লগারদের সুবিধার্থে।
কেমন লাগল জানাইবেন ।
পরবর্তী পর্ব : এক রাত্রির গল্প এবং রিয়া (পর্ব-২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।