বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক আগের দিন ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি স্বর্ণা ও চায়না ইরি জাতের যে মোটা চালের কেজি ছিল ২৭ টাকা, গতকালের বাজারে তা বিকিয়েছে ৩৬ টাকায়। একই সময়ের ব্যবধানে নাজিরশাইল ও মিনিকেটের মতো সরু চালের দাম ৩৩ টাকা থেকে বেড়ে গতকালের বাজারে বিকিয়েছে ৫২ টাকা কেজি দরে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি’র তথ্যে চালের মূল্যবৃদ্ধির এ পরিসংখ্যান রয়েছে। আর আজ থেকে ঠিক ৫ বছর আগে ২০০৬ সালের ৭ এপ্রিল মোটা চাল বলে পরিচিত স্বর্ণা ও চায়না ইরির দাম ছিল ১৭ টাকা কেজি। আর উন্নতমানের নাজির ও মিনিকেট চালের কেজি ছিল ২২ টাকা।
চালের বাজারদর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ৫ বছরে চালের দাম দ্বিগুণেরও বেশি প্রায় আড়াইগুণ বেড়েছে। সরকারি হিসাবের বাইরে গতকাল সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাজারে দুর্গন্ধমুক্ত মোটা চাল ৩৭/৩৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ভালো মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল ৫৮ টাকা পর্যন্ত কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত মিনিকেট ৬০ টাকা কেজিও আছে। টিসিবির হিসাবে উন্নতমানের নাজির ও মিনিকেট চাল গতকাল বিকিয়েছে ৫২ টাকা দরে, যা এক মাস আগেও একই দাম ছিল।
এক বছর আগে ছিল ৪৪ টাকা কেজি। ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মাঝখানে মোটা চালের দাম বেড়ে ২০০৮ সালে ৩৬ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও ওই সরকার বিদায় নেয়ার আগেই দাম অনেক কমে। তারা ক্ষমতা ছাড়ার দিন ২৭ টাকা কেজিতে দাঁড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় দাম কমে ২০০৯ সালের শেষদিকে মোটা চালের কেজি ২২ টাকায় পৌঁছলেও সরকারের বছর না ঘুরতেই দাম বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তা জরুরি শাসনামলকেও ছাড়িয়ে যায়।
একইভাবে বর্তমান সরকারের আমলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাঝারি ও সরু চালের দাম। চালের পাশাপাশি জরুরি নিত্যপণ্য হিসেবে ঘোষিত সব পণ্যের দামই বর্তমান সরকারের আমলে অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মাসে সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর দেয়া প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমান সরকারের প্রথম দুই বছরে জরুরি নিত্যপণ্যের দাম সর্বনিম্ন ৩২ থেকে সর্বোচ্চ ৪৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
টিসিবি’র তথ্যে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঢাকার বাজারে মোটা চাল ৩৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। যারা নিয়মিত বাজার করেন তারা জানিয়েছেন, ওই সময় মোটা চালের কেজি ৪০ টাকায় পৌঁছে ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ মার্চ গফরগাঁওয়ে এক জনসভায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে চালের কেজি ৪০ টাকা, বিএনপি থাকলে ৯০ টাকা হতো। নির্বাচনের আগে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতির কথা তিনি বেমালুম অস্বীকার করে চলেছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রতিশ্রুতির ভিডিওচিত্র, একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট এরই মধ্যে পুনঃপ্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে, তাতে তার ওই বক্তব্যের প্রমাণ রয়েছে।
গত ৬ মার্চ বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান জাতীয় সংসদে বিএনপিদলীয় এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে (বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসে) মোটা চালের কেজি ছিল ২৪ থেকে ৩০ টাকা। ২০১০-এর জানুয়ারিতে ছিল ২৫ থেকে ২৮ টাকা এবং ২০১১ সালের জানুয়ারিতে হয়েছে ৩৪ থেকে ৩৭ টাকা কেজি।
তিনি জানান, দুই বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে শতকরা ৩১ দশমিক ৪৮ ভাগ। বাণিজ্যমন্ত্রী সংসদে আরও জানান, ২০০৯ সালে সরু চালের কেজি ছিল ৩২ থেকে ৪২ টাকা, ২০১০-এ ছিল ৩১ থেকে ৪৫ টাকা, ২০১১ সালে তা ৩৮ থেকে ৫০ টাকায় পৌঁছায়। মন্ত্রীর তথ্য মতে, দুই বছরে সরু চালের দাম বেড়েছে ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। সংসদে দেয়া বাণিজ্যমন্ত্রীর তথ্যমতে, বর্তমান সরকারের প্রথম দুই বছরে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে সর্বনিম্ন ৩২ থেকে সর্বোচ্চ ৪৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে রসুন ও হলুদের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে বলে তার দেয়া তথ্যে জানা যায়।
টিসিবি’র বাজারদর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, স্বর্ণা ও চায়না ইরি জাতের প্রতি কেজি মোটা চাল গতকাল ৩৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঠিক এক মাস আগে এই চাল ছিল ৩৭ টাকা এবং ঠিক এক বছর আগে ২৮ টাকা। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে এই চালের দাম টিসিবির হিসাবে ২৭ টাকা থাকলেও সেদিন ২৪ টাকা কেজিতেও মোটা চাল বাজারে বিক্রি হয়েছে বলে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে। প্রথম আলো ও আমার দেশ-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি খুলনায় ২৪ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি হয়েছে। আর বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন ৭ জানুয়ারি নওগাঁর পাইকারি বাজারে চালের দাম বিশ্লেষণে দেখা যায় ওইদিন প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ২১ টাকা ৪৪ পয়সা থেকে ২১ টাকা ৯৭ পয়সা।
অন্যদিকে আজ থেকে ঠিক ৫ বছর আগে ২০০৬ সালের ৭ এপ্রিল (খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের শাসনামলের শেষ বছরে) দৈনিক ইত্তেফাক ও প্রথম আলো পত্রিকায় টিসিবি ও নিজস্ব অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যতালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম আলোর ওইদিনের রিপোর্টে দেখা যায়, ওইদিন বাদামতলী ও বাবুবাজারে স্বর্ণা জাতের মোটা চাল ৬০০ টাকা মণ দরে, পারি জাতের মোটা চাল ৬৩০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। আর মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকা মণ দরে। নাজিরশাইল মানভেদে ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা মণ দরে। ৪০ কেজির হিসাবে ধরলে স্বর্ণার দাম দাঁড়ায় প্রতি কেজি মাত্র ১৫ টাকা, পারির কেজি ১৫ টাকা ৭৫ পয়সা, মিনিকেট ২২ টাকা ৫০ পয়সা এবং নাজিরশাইল মানভেদে সাড়ে ১৭ টাকা থেকে ২১ টাকা ২৫ পয়সা।
অন্যদিকে ২০০৬ সালের ৭ এপ্রিলের ইত্তেফাকে বলা হয়েছে ঢাকার খুচরা বাজারে আগের দিন প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ১৭ টাকা কেজি দরে। ২০০৬ সালের ৫ এপ্রিলের মানবজমিনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাতিরপুল বাজারে আগের দিন প্রতি কেজি নাজিরশাইল বিক্রি হয়েছে ২২ টাকা । ২০০৬ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘গতকাল ঢাকার বাজারে পাইকারি চালের দাম মিনিকেট প্রতি কেজি ২২ থেকে ২৪ টাকা, কালিজিরা প্রতি কেজি ২৭.৭০ টাকা, চিনিগুঁড়া ২৮.২০ টাকা, স্বর্ণা প্রতি কেজি ১৫.৫০, মোমপালিম প্রতি কেজি ১৭.৭০ টাকা, লতা প্রতি কেজি ১৮.৬০ টাকা, লতা মোটা প্রতি কেজি ১৫.৫০ পয়সা, পারিজা প্রতি কেজি ১৭.৩৫ টাকা, নাজিরশাইল প্রতি কেজি ১৮ থেকে ২২ টাকা এবং আটইশ চাল প্রতি কেজি ১৭.৯০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ’
এদিকে ঠিক পাঁচ বছর পর গতকালের (৬ এপ্রিল/২০১১) টিসিবির বাজারদরের তালিকায় দেখা যায়, মোটা চাল স্বর্ণা/চায়না ইরি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩২ থেকে ৩৬ টাকা, উত্তম মানের পাইজাম/লতা প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪২ টাকা, সাধারণ মানের পাইজাম/লতা প্রতি কেজি ৩৭ থেকে ৪০ টাকা, নাজির/মিনিকেট উত্তম মানের প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫২ টাকা এবং সাধারণ মানের নাজির/মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৫২ টাকায়।
ওদিকে বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগের দিন ও ১/১১ সরকারের শেষদিনের টিসিবির বাজারদর অনুযায়ী ঢাকার বাজারে স্বর্ণা ও চায়না ইরি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ২৭ থেকে ২৯ টাকা, সাধারণ মানের পাইজাম/লতা ৩২ থেকে ৩৩ টাকা, উত্তম মানের পাইজাম/লতা ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা, সাধারণ মানের নাজির ও মিনিকেট ৩৩ থেকে ৩৮ টাকা এবং উন্নত মানের মিনিকেট চাল ওইদিন বিক্রি হয়েছে ৩৮ থেকে সর্বোচ্চ ৪২ টাকা কেজি দরে।
২০১০ সালে টিসিবির বাজারদর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এক বছরে নাজির, মিনিকেট, পাইজাম, লতা, স্বর্ণা, চায়না ইরিসহ সব ধরনের চালের মূল্য বেড়েছে গড়ে প্রায় ৩২ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন মোটা চাল। এ সময়ে মোটা চালের দর বেড়েছে গড়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ।
খুচরা বিক্রেতারা চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেট ও পাইকারি বিক্রেতাদের দায়ী করছেন। অন্যদিকে পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, চালকল মালিকরা বেশি দামে তাদের কাছে চাল বিক্রি করছেন বলেই তারা দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে একাধিক বিক্রেতা বলছেন, অসাধু চালকল মালিকরা অতিমুনাফার আশায় চাল মজুত করছেন। এর সঙ্গে সরকারি মদতপুষ্ট ব্যক্তিদের জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য চালের দাম বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দাম এত বেশি হওয়ার কথা নয়।
এর পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কিছু দিন আগে সংসদে দাঁড়িয়েও চালের দামবৃদ্ধির পেছনে ষড়যন্ত্রকারীরা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারের তরফ থেকেও চালকল মালিকদের দায়ী করা হয়েছে। কিছু দিন আগে সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক অভিযোগ করেন, অনেক চালকল মালিক অতিরিক্ত মুনাফার জন্য চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে বৈঠকে চালকল মালিকরা খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, চালকল মালিকদের কাছে চালের মজুত নেই।
অবৈধ ও খণ্ডকালীন মজুতের জন্য ব্যবসায়ীরাই দায়ী। প্রধানমন্ত্রীও প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, মাত্র ১২ থেকে ১৫ মিলারের কাছে জিম্মি চালের বাজার। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরেও চাল নিয়ে চলছে চালবাজি। মিলাররা ইচ্ছামতো চাল সরবরাহ করেন আবার ইচ্ছামতোই দাম বাড়ান—এমন অভিযোগ পাইকারি চাল ব্যবসায়ীদের।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে বোরো চালের উত্পাদন হয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ টন। আমন হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ টন আর আউশ ২৫ লাখ টন। মোট উত্পাদন হয়েছে ৩ কোটি ৪৭ লাখ টন চাল। এর মধ্যে ১২ ভাগ খাদ্যশস্য বীজ হিসেবে সংরক্ষণ এবং মাঠ থেকে আনা ও মাড়াই প্রক্রিয়ায় নষ্ট হয় বলে ধরা হয়। ফলে এ পরিমাণ খাদ্যশস্য বাজারে আসে না।
তাদের দেয়া তথ্যমতে, মোট খাদ্যশস্যের উত্পাদন ৩ কোটি ৫ লাখ ৩৬ হাজার টন। এর সঙ্গে দেশে উত্পাদিত ১০ লাখ টন গম ও আমদানি করা ৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য যোগ করলে মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৩৬ হাজার টন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত অর্থবছরে (২০০৯-১০) বোরো চাল ১ কোটি ৮৩ লাখ টন, আমন ১ কোটি ২২ লাখ টন, আউশ ১৭ লাখ টন এবং গমের উত্পাদন ছিল ৯ লাখ ৬৯ হাজার টন। মোট খাদ্যশস্যের উত্পাদন ছিল ৩ কোটি ৩১ লাখ ৬৯ হাজার টন।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।