সবাইকে শুভেচ্ছা...
- চলনা ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে.....
প্রিয় একটা গান হতে নেয়া উপরের কথা গুলো। বাস্তবতা হল, নদীকে বাধ্য হয়েই থামতে হয়। পাহাড়ের উচ্চতায় যার জন্ম, হাট, মাঠ, ঘাট আর নগর বন্দর পেরিয়ে তাকে হার মানতে হয় সাগরের বিশালতার কাছে। নদীর জন্ম-মৃত্যুর এ চিরন্তন স্বরলিপি কারও অজানা থাকার কথা নয়। প্রেমিক প্রেমিকাদের তো নয়ই।
তবু এমন একটা গান না গাইলেই নয়, কারণ নদীর মত প্রেমও চিরন্তন, যা বাস্তবতা দিয়ে খাটো করা যায়না। প্রেম শুধু প্রেমিক প্রেমিকার হূদয়েই দোলা দেয় না, এর বাইরেও প্রেম আছে, যা শুধু চিরন্তন নয়, প্লুটোনিকও বটে। এই যেমন আমাদের দেশপ্রেম। ১৭ কোটি সন্তান তার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালবাসায় যতটা সিক্ত করছে বিশ্ব ভালবাসার ইতিহাসের তা কেবল বিরলই নয় বরং অনন্য ও অশ্রুত। হাতে কিছুটা সময় থাকলে চলুন আমরাও ঘুরে আসি প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা আর দেশপ্রেমে ভরপুর বিরল একটা জায়গায়।
খুব একটা দুরে যেতে হবেনা পাঠকদের। ঢাকা শহরের লালবাগ নামক একটা জায়গা হবে আমাদের শেষ ঠিকানা। এখানকার একটা ঘটনা ও কিছু মানুষের জীবন নিয়ে আমার এ লেখা। নির্দিষ্ট একটা এলাকা দূরে থাক খোদ ঢাকা শহরের জনসংখ্যা কত তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। বলা হয় আনাগোনা সহ প্রায় ২ কোটি।
এক কথায় মেগা শহর। লালবাগ এলাকাও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিদিন হাজারো ঘটনার জন্ম দেয় এ শহর। জন্ম, মৃত্যু, প্রেম ভালবাসা, মিলন, বিরহ ও বিচ্ছেদের মত ঘটনা আর দশটা জনপদের মত এখানেও ঘটে। এসব নিয়েই প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস এ শহরে।
তারপরও এমন কিছু ঘটনা জন্ম নেয় এখানে যার কোন কারণ নেই, ব্যাখ্যা নেই। রজওয়েল নামের একটা শহর আছে আমেরিকার পশ্চিমে। আদর করে এলিয়ন শহর নামে ডাকে দেশটার জনগণ। কথিত আছে ভিন দেশ হতে এলিয়ানরা এসেছিল এ শহরে। লালবাগে সেদিন এলিয়ন এসেছিল কিনা জানিনা, তবে ঘটনার ধরণ ও বৈশিষ্ট এলিয়ানদের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
কোন বিচারেই তা একবিংশ শতাব্দীর মানবজাতির ঘটনা হতে পারেনা।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক দুটো শিশুকে ঘিরে আবর্তিত লালবাগ ঘটনার কাহিনী। তথ্যসূত্রে ওদের কোন নাম নেই। লেখার খাতিরে ধরে নেই ওরা আনু আর মানু। আর দশটা সাধারণ শিশুর মত জীবন নয় ওদের।
বেচে থাকার লড়াই শুরু করতে হয়েছে অল্প বয়সে। প্লুটুনিক ভালবাসার দেশে শিশুদের জীবন হওয়া কথা ’আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ ধাচের। হতে পারে ওরা পিতা আর ঘোষকের স্বপ্নে লালিত হয়নি, তাই জীবনও স্বপ্নের সোনালী বন্দরে নোঙর করেনি। ওরা চোর। যেনতেন চোর নয়, ভাত চোর।
ক্ষুধা মেটাতে ওদের ভাত চুরি করতে হয়। ঘটনার দিনও ওরা ঢুকেছিল ২ কোটি নাগরিকের বাসস্থান শহরের কোন এক রান্নাঘরে। বাকি দিনের মত এদিন ওদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। ধরা পরে যায় দেশপ্রেমিক জনতার হাতে। বাকি কথা আমার না বললে চলবে, ছবিগুলো কথা বলবে আমার হয়ে।
কদিন আগে আমাদের সরকার প্রধান অভিযোগ এনেছেন এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে চালের ডিমান্ড অত্যাধিক বেড়ে গেছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত বাঘা বাঘা গোয়েন্দা সংস্থা গুলো তাদের গোপন রিপোর্টের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছে দুবেলার স্থলে জনগণ এখন চার বেলা ভাত খাচ্ছে। আর এ কারণেই প্রতিশ্রুত ১০ টাকা কেজির চাল যোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। আনু মানুদের ঘরে হয়ত চার বেলা রান্না করার মত যথেষ্ট গ্যাস নেই। হতে পারে রান্নাঘর বলতে কিছু নেই তাদের।
সরকার প্রধানের কথা বিশ্বাস করলে আমাদের ধরে নিতে হবে এই শিশুদ্বয়ও খাই খাই রোগে আক্রান্ত, এবং চাহিদা মেটাতে চুরি করতে বাধ্য হচ্ছে। ’আমাদের দেশটা ডিজিটাল স্বপ্নপূরী’তে রূপান্তরিত করার সরকারী কর্মসূচীতে এই আনু মানুরাও বাধা, তাই ওদের উত্তম মধ্যম দিয়েছে নিউক্লিয়ার ভালবাসার ’দেশপ্রেমী’ জনগণ।
’স্বাধীনতা তুমি শানিত কথার ঝলসানি লাগা সতেজ ভাষন’ - কথাগুলো আমার নয়, ডিজিটাল যুগের নতুন মাধ্যম ব্লগীয় দুনিয়ার ভাষা। আজকাল এ ভাষাতেই বর্ণিত হচ্ছে আমাদের দেশপ্রেম। হতে পারে একদল ভাত চোরকে ধোলাই দেয়াও এর অংশ।
চোর তো চোরই হোক তা শিশু। সুদখোর হতে ভাত খোর, আইন সবার বেলায় সমান প্রযোজ্য, জাতি হিসাবে এমন একটা প্রাপ্তি নিয়ে চাইলে আমরা গর্ব করতে পারি। সম্মিলিত গণধোলাইও আমাদের আইন। আইনী শাসনের নতুন এ অধ্যায় দেশের বিচার ব্যবস্থায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছে নীরবে নিভৃতে। একদিকে গণধোলাই পাশাপাশি ক্রসফায়ার, খোদ ঈশ্বরের বিচার এখন মর্ত্যলোকে।
গর্ব করার মতই বাস্তবতা।
এবার আসুন ভাতচোর আনু মানুদের বিচারকদের নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি। মেঘা শহরের এসব সিজনাল বিচারকদের নিয়ে মাথা ঘামাতে গোয়েন্দা রিপোর্টের দরকার হয়না, দরকার হয় না বিশেষ কোন ডসিয়ের। নিকট অতীতের একজন সরকার প্রধান বিরাষ্ট্রীয়করণ করে গেছেন এদের পরিচয়। মানসিক প্রতিবন্ধি না হলে ওরা কেউ নিরপেক্ষ নয়।
হয় এ ক্যাম্পের নয়তো ঐ ক্যাম্পের। যে কোন বিচারেই হোক ওরা ক্যাম্পের বাসিন্দা। ক্যাম্পই ওদের নিশ্বাস বিশ্বাস এবং ক্যাম্পেই ভাত যোগায় অনেকের পেটে। লেখার খাতিরে চুলে খয়েরি রং করা বিচারকের কথাই ধরা যাক। একটা নামও দেয়া যাক গণ আদালতের এ বিচারকের, সাইফ উল মুলক বদিউজ্জামান।
সংক্ষেপে বদি। বদি ব্যবসায়ী এবং সরকারী ক্যাম্পের বাসিন্দা, মিউনিসিপ্যালটির তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। টেন্ডার দিয়ে কাজ যোগার করতে হয় যার জন্যে পকেটে পিস্তল রাখতে হয় সর্বক্ষণ। মাঝে মধ্যে ব্যবহার করতে হয় কামিয়াভির জন্যে। বদির একজন ওস্তাদ আছে, ওয়ার্ড কমিশনার তার পরিচয়।
ক্যাম্পের রক্ষক এই ওস্তাদকে নিয়মিত বখরা দিতে হয় বদির। ওস্তাদের হাত হয়ে এ বখরার সিংহভাগ চলে যায় বড় ওস্তাদের ক্যাম্পে। বড় ওস্তাদের ক্যাম্পের আবার অনেক অলিগলি। এসব অলিগলি পার হয়ে বখরাকে পাড়ি দিতে হয় লম্বা পথ। থানা পুলিশ, মেম্বার চেয়ারম্যান, ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার, এমপি মন্ত্রী হয়ে তাকে যেতে হয় গুরুর দুয়ারে।
এ বখরা দিয়েই গুরুকে বিদেশ বিভূঁইয়ে সন্তানাদি পালতে হয়। বদির ৩৫ টাকা কেজির গন্ধযুক্ত ভাত হজম হয়না তাই তাকেও কিনতে হয় ৫০ টাকা কেজির চাল। বদির পাশেই নাদুস নুদুস একজন বিচারক, চেহারায় তার ছাত্র ভাব। ধরে নেই ক্ষমতাসীন ক্যাম্পের ছাত্রদের একজন সে। ছাত্র হলেও তার একটা পেশা আছে, চাঁদাবাজী।
লালবাগ এলাকার তাবৎ ব্যবসা বাণিজ্যের তোলা উঠানোর দায়িত্ব তার। তোলার একটা অংশ ব্যায় করতে হয় ওস্তাদের পেছনে। ওস্তাদের আছে বড় ওস্তাদ, বড় ওস্তাদের গুরু। সবাইকে খুশি রাখতে হয় চাঁদাবাজির ব্যবসা ধরে রাখতে গিয়ে। কোটি মানুষের এ শহরে এভাবেই পেটে ভাত যোগায় অনেকে।
আনু মানুদের বিচারকরাও এর বাইরে নয়। পকেটে অস্ত্র আর হাতে ফুল, ২১ শে ফেব্রুয়ারীর প্রথম প্রহর এদের অনেককেই দেখা যায় শহীদ মিনারে। এরা গুরুর বিদেশ ভ্রমণকে স্বাগত জানাতে এয়ারপোর্টে ভীর জমায়, জন্মদিনে মাজার জিয়ারত করে। টেন্ডার আর চাঁদাবাজির বখরায় অনেকে আবার ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয় আনু মানুদের চুরি হতে নিরাপদ থাকার জন্যে। ’স্বাধীনতা তুমি শানিত কথার ঝলসানি লাগা সতেজ ভাষন’, হয়ত ১৬ই ডিসেম্বরের কোন এক বিজয় উৎসবে এরাই এসব বুলি আওড়ায়।
এ কোন মানবতা? এ কোন বর্বর দেশপ্রেম? এ কেমন সভ্যতা? ক্ষুধার্ত শিশুকে ভাত চুরির দায়ে গণধোলাই! এ কোন শতাব্দীর বাসিন্দা আমরা? বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচে দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে সরকার। কোথায় সে টাকা? নাকি সে টাকা গুরু, বড় ওস্তাদ আর ওস্তাদের হাত হয়ে চলে যাচ্ছে বদিদের হাতে? লেখার ছবিগুলো পশ্চিমা দুনিয়ায় কোথাও প্রকাশ পেলে আঁতকে উঠবে সভ্যতা। সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে অনেক মা-বাবা। স্বাধীনতা কি শুধু শানিত কথার ঝলসানি লাগা সতেজ ভাষন? দুবেলা দুমুঠো ভাত নিশ্চিত করার নাম কি স্বাধীনতা নয়? ৫০ হাজার কোটি টাকার বিমানবন্দর, ৫ হাজার কোটি টাকার স্যাটেলাইটের চাইতে একজন শিশুকে ভাত খাওয়ানো কি বেশি জনগুরুত্বপূর্ণ নয়? ৫০০ কোটি টাকা খরচে দরিদ্র ঢাকতে হয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ঢাকা প্রদর্শন করতে গিয়ে। হয়ত তা করা গেছে কদিনের জন্যে, কিন্তু আসলে দরিদ্র বেরিয়ে এসেছে মাঠের খেলায়।
বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশেও খাবার ব্যবস্থা থাকে শিশুদের জন্যে। সরকারের পাশাপাশি এ কাজে এগিয়ে আসে চার্চ গুলো। ইসলামকে কমপ্লিট লাইফস্টাইল বলতে যাদের বুকের পাটা ইনক্রেডিবল হাল্কের মত বেরিয়ে আসে তারাও কেন নীরব এ কাজে? ইহুদি নাসারা যাদের গলায় পাপিষ্ঠের তকমা ঝুলাতে আমরা বেফানা, এই তারাই দেশে বিদেশে শিশুদের ক্ষুধা আর পুষ্টি মেটাতে খাবারের ব্যবস্থা করছে। কোথায় আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ? নাকি এগুলোও নিউক্লিয়ার দেশপ্রেমের মত ফাঁপা বেলুন? একজনের লেখায় পড়লাম আগামী ক'বছরের ভেতর বাংলাদেশে দেখা দেবে সোমালিয়া সিনড্রম। মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি, জাপানি ভূমিকম্প, নজিরবিহীন দুর্নীতি আর রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার জাতি হিসাবে আমাদের কোন গলিতে নিয়ে যাবে তার সামান্যতম হদিস নেই আমাদের ধারণায়।
সোমালিয়ান সিনড্রমে ভাত চুরির অধ্যায় এখনো তালিকাভুক্তি হয়নি যা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। পিতা আর ঘোষকের বানিজ্য দুই পরিবারের ৫২ টাকা কেজির সরু চাল নিশ্চিত করলেও বাকি জনগণের জন্যে তা ভাতযুদ্ধ বয়ে আনতে বাধ্য। এ শুধু সময়ের ব্যাপার।
সূত্রঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।