শহীদের খুন লেগে, কিশোর তোমার দুই হাতে দুই, সূর্য উঠেছে জেগে। -------হাসান হাফিজ
**০০১-অন্তর মম বিকশিত করো**
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর কর হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো,
অন্তরতর হে।
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
নন্দিত করো, নন্দিত করো,
নন্দিত করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
শিলাইদহ
২৭ অগ্রাহায়ণ ১৩১৪
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৫
ভিডিওটি দেখুন
Ontoro Momo Bikoshito Koro
**০০২---মুক্ত করো ভয়**
সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।
দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়, নিজের ’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়॥
(চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য হতে)
**০০৩---দুই বিঘা জমি**
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে ।
বাবু বলিলেন , ‘ বুঝেছ উপেন , এ জমি লইব কিনে ।
কহিলাম আমি , ‘ তুমি ভূস্বামী , ভূমির অন্ত নাই ।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো – জোর মরিবার মতো ঠাঁই ।
শুনি রাজা কহে , ‘ বাপু , জানো তো হে , করেছি বাগানখান
পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা —
ওটা দিতে হবে । ‘ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে , ‘ করুণ বক্ষে গরিবের ভিটেখানি ।
সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া ,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া !
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে ,
কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে , ‘ আচ্ছা , সে দেখা যাবে ।
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে —
করিল ডিক্রি , সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে ।
এ জগতে , হায় , সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি —
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি ।
মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে ,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে ।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য
কত হেরিলাম মনোহর ধাম , কত মনোরম দৃশ্য !
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি ।
হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো – ষোলো —
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়ই বাসনা হল ।
নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি !
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর , জীবন জুড়ালে তুমি ।
অবারিত মাঠ , গগনললাট চুমে তব পদধূলি ,
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি ।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল — নিশীথশীতল স্নেহ ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে —
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান , চোখে আসে জল ভরে ।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে —
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে ,
রাখি হাটখোলা , নন্দীর গোলা , মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে ।
ধিক্ ধিক্ ওরে , শতধিক্ তোরে , নিলাজ কুলটা ভূমি !
যখনি যাহার তখনি তাহার , এই কি জননী তুমি !
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফল ফুল শাক পাতা !
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ —
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা , পুষ্পে খচিত কেশ !
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন —
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী , হাসিয়া কাটাস দিন !
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন !
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি , ক্ষুধাহরা সুধারাশি !
যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী , হলে দাসী ।
বিদীর্ণ হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি —
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে , সেই আমগাছ একি !
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা ,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক – কালের কথা ।
সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম ,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম ।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর , পাঠশালা – পলায়ন —
ভাবিলাম হায় আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন !
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে ,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে ।
ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা ,
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা ।
হেনকালে হায় যমদূত – প্রায় কোথা হতে এল মালী ,
ঝুঁটি – বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি ।
কহিলাম তবে , ‘ আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব —
দুটি ফল তার করি অধিকার , এত তারি কলরব !
চিনিল না মোরে , নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ —
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ – সাথে ধরিতেছিলেন মাছ ।
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন , ‘ মারিয়া করিব খুন !
বাবু যত বলে পারিষদ – দলে বলে তার শতগুণ ।
আমি কহিলাম , ‘ শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয় !
বাবু কহে হেসে , ‘ বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয় ।
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি , এই ছিল মোর ঘটে —
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ , আমি আজ চোর বটে !
**০০৪---বোঝাপড়া**
তোমার মাপে হয়নি সবাই
তুমিও হওনি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ-বা মরে তোমার চাপে ||
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি,
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি ||
আকাশ তবু সুনীল থাকে
মধুর ঠেকে ভোরের আলো---
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো ||
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রু সাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর ||
মনেরে তাই কহ যে,---
ভালোমন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
যাহার লাগি চক্ষু বুঁজি
তাহারে বাদ দিয়াও দেখি
বিশ্ব-ভূবন মস্ত ডাঙ্গর ||
খুব খানিকটা কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সাথে কোনরকম
করে নে ভাই বোঝাপড়া ||
**০০৫---স্মরণ**
“যখন রব না আমি মর্তকায়ায়
তখন স্মরিতে যদি হয় মন
তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়
যেথা এই চৈত্রের শালবন। ............
মাঝে মাঝে পেয়েছিল আহবান পাঁতি
যেখানে কালের সীমারেখা নেই-
খেলা করে চলে যায় খেলিবার সাথি
গিয়েছিল দায়হীন সেখানেই। ............
সে আমারে কে চিনেছ মর্তকায়ায়,
কখনো স্মরিতে যদি হয় মন,
ডেকো না ডেকো না সভা- এসো এ ছায়ায়।
যেথা এই চৈত্রের শাল বন।
”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।