বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...
২০১২ সালের ৯ মার্চ। সোমবার। বাংলা একাডেমী'র মাহবুব ভাই (গল্পকার মাহবুব আজাদ)-এর নের্তৃত্বে বকুল আপা, আমার বউ মায়া আর আমি উত্তরা গেলাম। উদ্দেশ্য, সারাদিন মাহবুব ভাইয়ের এক বন্ধু'র বাসায় (এই মুহূর্তে নামটি মনে পড়ছে না বলে দুঃখিত) সারাদিন আমরা কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে আড্ডা দেবো। একেবারে ঘরোয়া আড্ডা।
তো, আমরা উত্তরা সেই ঠিকানায় পৌঁছাতে প্রায় দুপুর বারোটা বাজলো। গিয়ে দেখি, মাহবুব ভাইয়ের সেই বন্ধু'র বাসায় ভরপুর আড্ডা চলছে। আমাদের মতো আরো অনেকে সেই আড্ডায় আগেই সামিল হয়েছেন। কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে ওটাই ছিল আমার প্রথম ও একমাত্র আড্ডা। আর সেই আড্ডার অন্যতম আয়োজক হিসেবে মাহবুব ভাইয়ের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি'র অমর একুশে বইমেলায় আমার প্রথম উপন্যাস 'মা' প্রকাশিত হয়েছিল। বাসায় তখন পর্যন্ত একমাত্র কপি অবশিষ্ট ছিল। 'মা' উপন্যাসের সেই কপিটি আমি কবি বেলাল মোহাম্মদের জন্য সঙ্গে নিলাম। মাহবুব ভাই আর বকুল আপা'র জন্য বইয়ের কপি নেই নি বলে উত্তরা যাবার সারা পথ মাহবুব ভাই নানান খোটা দিলেন। কবি বেলাল মোহাম্মদকে আমার 'মা' উপন্যাসটি হাতে হাতে তুলে দেবার পেছনে একটি কারণ আছে।
আমার 'মা' উপন্যাসে 'মুক্তিযুদ্ধের উপর' একটি অধ্যায় আছে। সেই অধ্যায়ে কবি বেলাল মোহাম্মদের স্বাধীণ বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনেক কথাবার্তাও আছে। বিভিন্ন বই-পুস্তক, ইন্টারনেট, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র এবং কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে ই-মেইল যোগাযোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের একটি চিত্র সেখানে আছে। সেই তথ্যগুলো নিয়ে বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আরো কথা বলে বিষয়টি আরো সঠিক ও সুস্পষ্ট করার প্রয়াস আমার মনে মনে ছিল। সেদিনের সেই আড্ডায় যা আমার কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছিল।
কবি বেলাল মোহাম্মদের কাছ থেকে সেদিনের আড্ডায় বাংলাদেশের ইতিহাসের একেবারের সূচনা লগ্নের যে বিষয়গুলো আমরা শুনেছিলাম তা মোটামুটি এরকম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসা থেকে ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ইপিআর-এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘড়ি'র কাঁটার হিসেবে তখন ২৬ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু'র স্বাধীনতার ঘোষণার সেই ওয়ারলেস বার্তাটি ছিল এরকম- ''Today Bangladesh is a sovereign and independent country. On Thursday night, West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Razarbagh and the EPR headquarters at Pilkhana in Dhaka. Many innocent and unarmed have been killed in Dhaka city and other places of Bangladesh. Violent clashes between E.P.R. and Police on the one hand and the armed forces of Pakistan on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. May Allah aid us in our fight for freedom. Joy Bangla.''
বঙ্গবন্ধু'র স্বাধীনতার ঘোষণাটি টেলিগ্রাম বার্তার মাধ্যমে চট্টগ্রাম কয়েকজন ছাত্রের কাছে পৌঁছায়। ছাত্ররা ওই বার্তাটি অনুবাদের জন্য নিয়ে যান ডক্টর মানজুলা আনোয়ার সাহেবের কাছে। ডক্টর আনোয়ার তার বার্তাটি অনুবাদ করেন।
ছাত্ররা সেটি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের রেডিও স্টেশানে নিয়ে যায় প্রচার করার জন্য। কিন্তু পাক উচ্চ অথরিটির পারমিশানের অভাবে সেটি তখন প্রচার করা সম্ভব হয়নি। তখন ছাত্ররা সেই অনুবাদ বার্তা চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান সড়কে মাইকিং করেন।
কবি বেলাল মোহাম্মদ তখন চট্টগ্রাম বেতারের স্ক্রিপ্ট রাইটার। ঢাকার গণ্ডগোলের খবর শোনার পর সকালে আর তিনি আগ্রাবাদের অফিসে যান নি।
তিনি তখন ছিলেন এনায়েতগঞ্জে ডা. শফির বাড়িতে। সেখান থেকে গেলেন জহুরা মার্কেটে আওয়ামী লীগের অফিসে। সেখানে কিছু তরুণরা মিলে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করলেন। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করলেন। কালুরঘাটে বিকল্প একটি রেডিও স্টেশান চালু করবেন বলে জানালেন।
সেটি পাহারা দেবার জন্য ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের কাছে সহযোগিতা চাইলেন। ক্যাপ্টেন রফিক বললেন, 'আপনারা রেডিও স্টেশান চালু করেন। আমি পাহারার ব্যবস্থা করছি। '
কালুরঘাটে রেডিও স্টেশান চালু'র কাজ তখন এগিয়ে চলছে। আবুল কাশেম সন্দীপ তখন চট্টগ্রামের একটা কলেজে পড়াতেন।
মাঝেমাঝে ফ্যামিলি মেম্বারের মতো থাকতেন কবি বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি চট্টগ্রাম বেতারের কেউ নন। আবুল কাশেম সন্দীপ, বেতারের জুনিয়র অফিসার আবদুল্লাহ আল ফারুক, সুলতান আলাউন, মাহমুদ হোসেন, কবি আবদুস ছালাম, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আওয়ামী লীগের এম.এ. হান্নান, বেতারের ইঞ্জিনয়ার বিভাগের কর্মী আমিনুর রহমান এবং বেলাল মোহাম্মদ এঁরা সবাই মিলে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে রেডিও অন করতে সক্ষম হলেন। তখন বঙ্গবন্ধু'র তারবার্তাটির অনুবাদ কপি প্রচার করতে লাগলেন। রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত কিছুক্ষণ পরপর বঙ্গবন্ধু'র সেই তারবার্তার অনুবাদ কপি প্রচার করেন।
ওই সময় বাবর ও সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের কাজে মেজর জিয়া হেড কোয়ার্টারের বাইরে অবস্থান করছিলেন। ২৬ শে মার্চ রাতে পরিস্থিতি অবজার্ভ করার জন্য মেজর জিয়া তখন পটিয়ায় অবস্থান করছিলেন। কবি বেলাল মোহাম্মদকে তাঁর এক বন্ধু টেলিফোনে জানালেন যে ক্যাপ্টেন রফিকের চেয়েও উচ্চ পদের একজন বাঙালি আর্মি অফিসার পটিয়ায় অবস্থান করছেন। ২৭ শে মার্চ সকালে কবি বেলাল মোহাম্মদ পটিয়ায় গিয়ে তাঁর পরিচিত মানিক দারোগার মাধ্যমে মেজর জিয়াকে কালুরঘাট অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রের খবর জানালেন। মেজর জিয়া তখন রেডিও স্টেশান পাহারা দেবার জন্য সৈন্যদের আগে পাঠিয়ে দিলেন।
আর একটা জিপে মেজর জিয়া নিজেও রওনা দিলেন। পেছন পেছন কবি বেলাল মোহাম্মদের গাড়িও কালুরঘাট পৌঁছালো।
২৭ শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে মেজর জিয়া কালুরঘাট অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে আরেকটি ঘোষণা দেন- “আই মেজর জিয়া অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ডু হেয়ার বাই ডিক্লেয়ার ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ। ” তার আগে কয়েকবার এনাউন্স করা হয় যে, মেজর জিয়াউর রহমান একটি জরুরী ঘোষণা দেবেন। মেজর জিয়া তখন বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান না বলে শুধু মেজর জিয়া বলার জন্য।
আবদুল্লাহ আল ফারুকের কণ্ঠস্বর ভালো। তাই মেজর জিয়ার ঘোষণাটি পরে তিনি আবার পাঠ করতে লাগলেন।
পরিদন ২৮ শে মার্চ মেজর জিয়া আরেকটি ভাষণ লিখে আনেন। সেখানে তিনি নিজেকে রিপাবলিকের টেমপোরারি হেড উল্লেখ করেছিলেন। মেজর জিয়া'র ২৮ শে মার্চ ১৯৭১ সালের সেই ঘোষণাটি ছিল এরকম- ''This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, at the direction of Bangobondhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People's Republic of Bangladesh has been established. At his direction, I have taken command as the temporary Head of the Republic. In the name of Sheikh Mujibur Rahman, I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours. Joy Bangla.''
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।