আজ জুলাইর প্রথম প্রভাত। ইংরেজি সন ২০১০। বাংলা তারিখ ১৭ আষাঢ় ১৪১৬। জীবন আর মৃত্যুর একেবারে সীমান্তে দাঁড়িয়ে তিরিশটি দিন পার করার পর প্রথমবারের মতো কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করছে। না, কোনো প্রাণঘাতী অসুস্থতায় আক্রান্ত হইনি।
তবে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে কি-না, এ নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক পর্যায় যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন, সেটি এই একটি মাস প্রতিটি মুহূর্তে মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। মনের ভেতরে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি সবিনয়ে সাঙ্গ করে রেখেছিলাম। যে অসহায় মা এবং স্ত্রীকে ঘরে রেখে গ্রেফতার হয়েছি, তাদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না এমন আশঙ্কায় হৃদয় ভেঙে-চুরে গেলেও অনেক চেষ্টায় বাইরে থেকে অবিচল থেকেছি। অবশ্য তাদের সঙ্গে মুক্তজীবনে কতদিন পর আবার দেখা হবে, সেটিও মহান আল্লাহতায়ালাই জানেন। আমাকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনে ক্ষমতাসীনদের বিদেশি মুরব্বি রাষ্ট্রগুলোর শতভাগ সমর্থন থাকলেও একেবারেই শেষ করে দেয়া নিয়ে সম্ভবত তাদের মধ্যে মতদ্বৈধ রয়েছে।
সে কারণেই আমাকে হত্যার কাজটা শুরু করেও সমাপ্তি টানা হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহ এখনও তাঁর এই অকিঞ্চিত্কর বান্দাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নেয়ার সময় নির্ধারণ করেননি।
লেখার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গত তিরিশ দিনে কলম একেবারেই স্পর্শ করিনি, তা নয়। ডাইরি লেখার অভ্যাস আমার কস্মিনকালে না থাকলেও গ্রেফতারের পর থেকেই সময়-সুযোগমত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ভবিষ্যতের রসদ হিসেবে টুকরো টুকরো কাগজে টুকে রাখতে ভুল হয়নি।
রিমান্ড চলাকালে লেখা সম্ভব ছিল না। তবে, সেই বিভীষিকাময় স্থানগুলো থেকে কারাগারে ফেরামাত্র কোনোরকম বিশ্রাম না নিয়ে আগে লেখার টেবিলে কাজে বসে গেছি। কাজেই আজও লিখতে বসে পুঁজির অভাব হচ্ছে না। কিন্তু, সমস্যা অন্যত্র। আমি যে লিখতে জানি না, সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? প্রকৃতি যেমন আপন প্রয়োজনে শূন্যকে পূর্ণ করে, তেমন করেই তো এক-এগারোপরবর্তী এক বিশেষ সময়ের প্রয়োজন মেটাতেই আমি কলাম-লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলাম।
তাগিদটা এসেছিল ভেতর থেকে। কিন্তু নাজিমউদ্দীন রোডের বন্দিশালার সাত নম্বর সেলে বসে কী লিখি? বন্দি জীবনের স্মৃতিচারণ আর পত্রিকার কলাম লেখার মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। ব্যক্তিগতভাবে আত্মজীবনীমূলক লেখায় আমার কোনো উত্সাহ নেই। বাগাড়ম্বর করে নিজেকে মহত্ দেখানো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আত্মজীবনী তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তির মহান খণ্ডিত ও অনেকাংশে কাল্পনিক চিত্র হয়ে ওঠে।
এর মধ্যেও ব্যতিক্রম হয়তো আছে। আমি কোনোক্রমেই সেই ব্যতিক্রমীদের মধ্যে পড়ি না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যথাসম্ভব
নিরাসক্তভাবে ঘটনা বর্ণনা করে যাব। এর মধ্যে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের যে ছবি অবধারিতভাবে ফুটে উঠবে, তার ন্যায্যতা-অন্যায্যতার মূল্যায়ন করার দায়িত্ব আমার নয়। জীবিত থাকি আর না থাকি, যদি কোনোদিন এ লেখাটি পাঠকের কাছে পৌঁছায়, তাহলে সে কাজটি তারাই করবেন।
এক মাস ধরে অনেক ভেবে যখন লেখকের ভূমিকাটি উপলব্ধিতে এসেছে, তারপরই কেবল লিখতে বসেছি। রিমান্ডের ফাঁকে ফাঁকে এই এক মাস বহিরাঙ্গে প্রশান্ত কিন্তু ভেতরে সর্বক্ষণ ছটফট করেছি। হাতে বন্ধ্যা কলম নিয়ে সাত নম্বর সেলের দুই নম্বর কুঠুরির লোহার মোটা মোটা শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এখন আমি নির্ভার। এবার শুরু হোক আমার কথকতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আমাকে জেলে পুরবেনই, সেটা আমার জানাই ছিল। ২০০৯-এর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে তার পুত্র এবং জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের আনুষ্ঠানিক, সরকারি কাগজপত্র আমার দেশ-এর সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ হাতে পাওয়ার পর পুরো একটি দিন সেই সংবাদ ছাপানোর ঝুঁকি বিবেচনা করেছি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় পেশা বদল করে সম্পাদক হয়েছি। হয়তো সেজন্যই যে সংবাদ বস্তুনিষ্ঠ, যার সমর্থনে কাগজপত্র রয়েছে, সেই সংবাদ চেপে রেখে নিজে বিপদমুক্ত থাকতে মন সায় দেয়নি। ঘটনার অবধারিত ধারাবাহিকতায় এই বছরের জানুয়ারি মাসে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের তাবত্ অংশে আনুষ্ঠানিক চিঠি যা সরকারি পরিভাষায় ডিও নামে অভিহিত, পাঠানো হয়।
দেশের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এমন চিঠি দিতে পারে কি-না, সেই তাত্ত্বিক অথবা আইনি প্রশ্ন ফ্যাসিবাদকবলিত বাংলাদেশে উত্থাপন করা অর্থহীন। এই রাষ্ট্রে সরকার-পরম্পরায় ক্রসফায়ার পর্ব পেরিয়ে ষাট-সত্তর দশকের চিলি, আর্জেন্টিনার মতো আমরা এখন গুম-খুনের জমানায় প্রবেশ করেছি। জেলের এই তিরিশ দিনেই এ-জাতীয় অসংখ্য লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী জেনেছি, যেগুলো প্রসঙ্গক্রমে ক্রমান্বয়ে বর্ণনা করব। তার আগে আপন অভিজ্ঞতার গল্প। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডিও’র ব্যাপারে জেনে যাওয়ার পরই স্ত্রীকে বলেছিলাম, আমাকে হারানোর মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে।
মাকে বিশেষভাবে না বললেও ঘনায়মান বিপদের ভয়াবহতা সম্পর্কে তিনি একেবারে অন্ধকারে ছিলেন না। তবে গ্রেফতারের রাতের পূর্বপর্যন্ত সরাসরি কখনও আলাপ করিনি, মা আর ছেলের মধ্যে এক ধরনের লুকোচুরি খেলা আর কি! জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পেতাম প্রধানমন্ত্রী নাকি আমার গ্রেফতারে দেরির জন্য ভয়ানক ক্ষুব্ধ। ঘনঘন বিদেশযাত্রার আগে এবং প্রত্যাবর্তনের পরে এ বিষয়ে মনিটর করা তার রুটিনে পরিণত হয়েছিল। বশংবদ দুদক নির্দেশমত ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই আর ধৈর্য রাখতে পারছিলেন না। ঘটনার অন্ত টানতে তাই শেষপর্যন্ত এগিয়ে আসে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা—এনএসআই।
৩১ মে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় পরবর্তী দশ দিনের মধ্যে আমাকে গ্রেফতার এবং ‘আমার দেশ’ বন্ধ করা হবে। একজন সাংবাদিক জুনের এক তারিখ সকাল এগারোটার দিকে ফোনে আমাকে এই সংবাদ দেন। আমি তখন আর্টিজান সিরামিকের উত্তরা অফিসে নিজ কক্ষে বসে কাজ করছিলাম। আগেরদিন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সভাটির স্থান নিয়ে খানিকটা বিতর্ক রয়েছে। দু’টি সম্ভাব্য স্থানের কথা আমাকে জানানো হয়।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কিংবা এনএসআই কার্যালয়ের মধ্যে যে কোনো একস্থানে চূড়ান্ত মিটিংটি অনুষ্ঠিত হয়। আমার স্ত্রী এবং আর্টিজান সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজার অফিসে আগমনের জন্য প্রতীক্ষারত অবস্থাতেই আমার অপর সহকর্মী সাংবাদিক খবর দিলেন, সকাল ৯টায় হাসমত আলীকে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা বাসা থেকে উঠিয়ে এনএসআই কার্যালয়ে নিয়ে গেছে। সংস্থাটির প্রভাবশালী এক পরিচালককে পুরো অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। চাকা যে অতি দ্রুত ঘুরতে শুরু করেছে, সেটি বুঝতে অসুবিধা হলো না। স্ত্রী অফিসে এলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রেস ক্লাবের উদ্দেশে রওনা করলাম।
বিদায়ের সময় আবেগতাড়িত হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না; বরং ঘটনার আকস্মিকতায় দু’জনাই হতবিহ্বল। এ দিনটি আসবে জানতাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি! ঘর থেকে বার হয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রীর মাথায় হাত দিয়ে শেষবারের মতো দোয়া করাও হয়ে ওঠেনি। মনে হয়েছিল, গ্রেফতারের জন্য সরকার আরও কয়েকটা দিন সময় নিতেও পারে। উত্তরা থেকে প্রেস ক্লাব যাত্রাপথেই সর্বশেষ পরিস্থিতির ওপর বেসরকারি সংবাদ সংস্থা শীর্ষ নিউজকে টেলিফোনে সাক্ষাত্কার দিলাম।
হাসমত আলীর নিরাপত্তা নিয়ে তখন আমার গভীর উত্কণ্ঠা। প্রেস ক্লাবে পৌঁছে সরাসরি গেলাম সভাপতি শওকত মাহমুদের কক্ষে। সেখান থেকেই আবারও অন্য বেসরকারি সংবাদ সংস্থা বিডি নিউজকেও সাক্ষাত্কার দিলাম। ততক্ষণে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শওকত মাহমুদের সৌজন্যে আহারপর্ব সাঙ্গ করলাম।
সহকর্মী আবদাল, গনি এবং সাংবাদিক রওনাক আর শওকত মাহমুদ খাওয়ার সময় সঙ্গ দিয়েছিলেন স্মরণে আছে। বিকাল তিনটায় প্রেস ক্লাব থেকে আমার দেশ-এর উদ্দেশে যাত্রার আগেই সেখানে বিকাল পাঁচটার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনও সমাপ্ত হয়েছে। গণতন্ত্রের লেবাসধারী সরকারের চরম স্বৈরাচারী আচরণের ইতিহাস জাতির জেনে রাখা দরকার।
আমার দেশ কার্যালয়ে আমার কক্ষে পৌঁছানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই টেলিফোন অপারেটর জানালো হাসমত আলী টেলিফোনে অপেক্ষমাণ। স্বস্তি এবং কৌতূহল নিয়ে ফোন ধরতেই ওপারে ভদ্রলোকের আতঙ্কমিশ্রিত গলার আওয়াজ পেলাম।
তার বক্তব্যের সারাংশ হলো, সকাল ন’টায় সাদা পোশাকধারী লোকজন তাকে বাসা থেকে উঠিয়ে এনে এনএসআই কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তার সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, সেই বর্ণনা পরিষ্কারভাবে না দিয়ে তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে শুধু বললেন, ওখানে মানুষ যায়! এই একটিমাত্র বাক্যে হয়তো তার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। হাসমত আলীর জবানিতেই জানলাম, বন্দিত্বের একপর্যায়ে তার কাছ থেকে দু’টি কাগজে জোর করে সই নেয়া হয়েছে। পরে এই দুই কাগজেরই একটি গেছে ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে এবং অপরটি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হাসমত আলী সরকারের নীলনকশার অংশীদার হতে সম্মত হওয়ার পরই দুপুর দুটোর দিকে এনএসআই অফিস থেকে ছাড়া পেয়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন।
শেখ হাসিনার ইচ্ছানুযায়ী তার পুলিশ যে ওইদিনই আমাকে গ্রেফতার করবে, এ নিয়ে আমার আর কোনো সংশয় থাকল না। ততক্ষণে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমার দেশ-এর খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। শীর্ষ নিউজ ডট কম তাদের ওয়েবসাইটে ঘণ্টায় ঘণ্টায় সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর দিচ্ছে। ফ্যাসিবাদী সরকার যে সর্বদা নির্জলা মিথ্যার ওপরই নির্ভর করে, তার প্রমাণ পেতেও দেরি হলো না। ‘অপারেশন আমার দেশ’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত এনএসআই পরিচালক স্বগৃহ থেকে হাসমত আলীকে অপহরণ করার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের কাছে বেমালুম অস্বীকার করলেন।
এদিকে উদ্বিগ্ন শুভানুধ্যায়ীরা ততক্ষণে ফোন করতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ আমার দেশ কার্যালয়ে এসেও পড়েছেন। সংবাদ সম্মেলন শুরু করার আগেই স্ত্রীকে ফোন করে সাড়ে তিন বছর ধরে আমার সঙ্গে জেলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ কাপড়-চোপড়ের ব্যাগটিকে পাঠাতে বলে একপ্রস্থ বিদায় নিলাম। ফোনের ওপারে কণ্ঠ রুদ্ধ হওয়ার আভাস পেলাম। তিনজন মাত্র মানুষের দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সংসার থেকে একজনের ঝরে যাওয়ার আশঙ্কাপূর্ব মানসিক প্রস্তুতি সত্ত্বেও তাকে ব্যাকুল করে তুলছিল।
সারাদিনের তুমুল উত্তেজনার ফলে সেই মুহূর্তে আবেগশূন্য থাকতে পারলেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাত নম্বর সেলে বসে পাঠকদের গল্প বলার সময় কেবলই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে বারবার চশমার কাচ মুছেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি কই? নিতান্তই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই আমি কর্মজীবনে নানামুখী সাফল্য পেলেও সমস্তটা জীবন ধরে আমার ছোট সংসারের মানুষগুলোকে বড় অবহেলা করার আক্ষেপ জীবনের পড়ন্ত বেলায় অসহনীয় বোধ হচ্ছে। তারাশঙ্করের মতো বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ভালবেসে মিটিল না সাধ, জীবন এত ছোট কেনে?’
বিকেল পাঁচটার সংবাদ সম্মেলনে আমার দেশ নিয়ে প্রশাসনের বেআইনি কার্যকলাপের বিবরণী সপ্রমাণ তুলে ধরলাম। প্রাসঙ্গিক সব কাগজপত্রের অনুলিপি তুলে দিলাম সংবাদমাধ্যমের উপস্থিত সহকর্মীদের হাতে। উপস্থিত সাংবাদিকরা সহজেই বুঝতে পারলেন তথ্য মন্ত্রণালয় আমাকে প্রকাশক হিসেবে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিলেও ঢাকা জেলা প্রশাসক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে অসত্ উদ্দেশ্যে সামান্য দাফতরিক একটি রুটিন কাজ মাসের পর মাস ফেলে রেখেছেন।
এই গর্হিত অপরাধের জন্য জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে এখন আমাকে জেলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। বলে রাখা দরকার, সংবাদ সম্মেলন চলাকালীনই আমার দেশ কার্যালয় যে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার মালিকানাধীন ইমারতে অবস্থিত, তার নিচতলায় সাদা পোশাকে অসংখ্য পুলিশ অবস্থান নিতে শুরু করেছে। তখন পর্যন্ত ঢাকার জেলা প্রশাসক পত্রিকার ডিক্লারেশনও বাতিল করেননি কিংবা শিল্পাঞ্চল থানায় আমার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়নি। অথচ সর্বশেষ ব্যবস্থায় শত শত পুলিশ আসতে শুরু করেছে। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে অফিস কক্ষে ফিরে এলাম।
আমার দেশ পত্রিকা অফিস ততক্ষণে অন্যান্য সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদকর্মীতে ভরে গেছে। নিজের ঘরে ফিরেই শুনলাম, আমার গাড়িসহ এগারোতলা ইমারতের নিচতলা পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। শুরু হলো দীর্ঘ অবরোধ। বাংলাদেশে সম্পাদক গ্রেফতারের পরম্পরা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতা শেখ মুজিবুর রহমান চালু করেছিলেন। কবি আল মাহমুদ, এনায়েতুল্লাহ খান, আবদুস সালাম, ইরফানুল বারী প্রমুখ গ্রেফতার হয়েছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে।
পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক এরশাদ গ্রেফতার করেছিলেন আতাউস সামাদকে এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে তোয়াব খান ও বোরহান আহমেদও গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু প্লাটুনের পর প্লাটুন দাঙ্গা পুলিশ পাঠিয়ে একটি পত্রিকা অফিসকে এমন করে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেনি কোনো সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলগত মিত্র এবং পূর্বসূরি জেনারেল মইনের প্রচ্ছন্ন সামরিক সরকারের পাইক-বরকন্দাজদের বুটের আঘাত অবশ্য অনেক পত্রিকা অফিসকেই এক-এগারোপরবর্তী সময়ে সইতে হয়েছে। আজ যারা আমার দেশ বলাত্কারের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করছেন, তাদের অনেককেই চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মহাজোটের আন্দোলনের ফসল সরকারের দুর্নীতি দমন অভিযানের অংশ হিসেবে। এদের দুর্বল স্মৃতিশক্তি দেখে করুণা হয়।
যা-ই হোক, কী ঘটতে চলেছে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আমরা প্রতি সন্ধ্যার মতো পত্রিকার মেকআপের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। রাত আটটার দিকে নিচ থেকে সংবাদ পেলাম, গাড়ির পর গাড়ি দাঙ্গা পুলিশ এসে চত্বর ভরে ফেলেছে। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগল। অবরোধকারী পুলিশ সাংবাদিকদেরও আর এগারোতলায় উঠতে দিচ্ছিল না। এদিকে টেলিভিশন চ্যানেলে তখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছে।
আমরা সবাই মিলে কাজে লেগে গেলাম যাতে যত দ্রুত সম্ভব সেলোফেন ছাপাখানায় পাঠানো সম্ভব হয়। ধারণা করছিলাম, যে কোনো সময় সেখানেও পুলিশ পৌঁছে যাবে। রাত দশটার মধ্যেই প্রথম সংস্করণের সেলোফেন পাঠিয়েও দেয়া গেল। সোয়া দশটায় খবর পেলাম ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। আনন্দিত হয়ে ভাবলাম, অন্তত পরদিনের সংবাদপত্র পাঠকদের হাতে দিতে পারব।
পৌনে এগারোটায় প্রেস মহাব্যবস্থাপক আহমদ হোসেন মানিক ফোন করে জানালেন, কয়েকশ’ পুলিশ প্রেস ঘিরে ফেলেছে। প্রায় একই সময় প্রধান কার্যালয়ের নিচতলা থেকে খবর এলো দাঙ্গা পুলিশ সিঁড়ি বেয়ে এগারোতলার উদ্দেশে উঠতে শুরু করেছে। কম্পিউটার বিভাগকে তাত্ক্ষণিক নির্দেশ দিলাম সংবাদপত্রের সফট কপি ওয়েবে তুলে দেয়ার জন্য, যাতে বিশ্ববাসী তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের চরম ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। এর মধ্যেই অগ্রজপ্রতিম ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আসন্ন গ্রেফতারের সংবাদ দিয়ে আইনি লড়াইয়ে তার সহযোগিতা চাইলাম। তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার সাধ্যমত চেষ্টা চালানোর দৃঢ় সঙ্কল্পের আশ্বাসটুকুই কেবল দিতে পারলেন।
বাংলাদেশের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এই আইনজীবীকে দীর্ঘদিন ধরে চেনার সুযোগ হয়েছে। এদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে তার সহানুভূতি সেক্যুলারদের প্রতিই অধিকতর মনে হয়েছে। বিএনপি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সামরিক সংযোগের বিষয়টি তিনি কখনোই সর্বান্তঃকরণে অনুমোদন করেননি। অবশ্য জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের অসাধারণ সত্ ব্যক্তিচরিত্রের প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করেন। তার তুলনামূলক পছন্দের দলের এই অগণতান্ত্রিক এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারবিরোধী আচরণ তাকে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত করেছে বলেই মনে হলো।
এক-এগারোর অপশাসনের দুই বছরে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে দু’জনা দিনের পর দিন আলাপ-আলোচনা করেছি। তার পুরানা পল্টনের চেম্বারে বসে থাকার সময় আজকের ক্ষমতাবানদের আত্মীয়-স্বজনের কত অশ্রুজলের সাক্ষী আমি নিজে।
দরজার ওপারে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র আর এপারে সাংবাদিকদের ক্যামেরা
দাঙ্গা পুলিশের এগারোতলার দিকে ধেয়ে আসা এবং আমার আসন্ন গ্রেফতার নিয়ে আমি কোনো উদ্বেগ অনুভব করছিলাম না। কিন্তু আমার দেশ যে পরদিন পাঠকের কাছে পৌঁছানো গেল না, এ কারণে উপস্থিত সবাই বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। আমার দেশ নিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের এই সম্পূর্ণ আইনবিরোধী কার্যকলাপ যে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিচার বিভাগেও শেষ পর্যন্ত টেকানো যাবে না, আমার মনে এই দৃঢ়বিশ্বাস সত্ত্বেও এতগুলো সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় বড় বিষণ্ন বোধ করতে লাগলাম।
এর মধ্যে পত্রিকার সকল সহকর্মী তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের কথা আমাকে জানাতে এলেন। তারা নিজেদের মধ্যে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথমটি, আমার সঙ্গে গণগ্রেফতার বরণ করবেন এবং দ্বিতীয়টি, কোনো পরিস্থিতিতেই ফজরের নামাজের আগে আমাকে গ্রেফতার হতে দেবেন না। বিদেশি প্রভুদের অন্ধ সমর্থনে যে বেপরোয়া সরকার ক্রমেই গুম-খুনে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠছে, তাদের হাতে রাতের অন্ধকারে আমাকে কোনো অবস্থাতেই সমর্পণ করা হবে না। সহকর্মীদের এমন ভালোবাসার প্রকাশে চোখ শুকনো রাখব এমন সাধ্য কই? এদিকে এগারোতলায় তখন খাদ্য ও পানির সঙ্কট চলছে।
নিচতলায় পুলিশের অবরোধের মধ্য দিয়ে কারও পক্ষে হেঁটেও উপরে ওঠা সম্ভব নয়। সরকার আমাদের ভাতে এবং পানিতে মারার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। রাত ১২টার মধ্যে এগারোতলার প্রবেশদ্বারের বাইরেটা সাদা পোশাকধারী এবং দাঙ্গা পুলিশে ভরে গেছে। দরজার ওপারে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র আর এপারে সাংবাদিকদের হাতে হাতে ক্যামেরা। এ এক অসম লড়াই।
সন্ধ্যা থেকে আমার অফিসে উপস্থিত ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপি এবং অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজলকে অনুরোধ করলাম ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্যে, যাতে সাংবাদিকরা কেউ হতাহত না হয়ে আমার গ্রেফতারপর্ব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা যায়। তারা প্রশ্ন করে জানলেন পুলিশের কাছে আদালতের কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা নেই। ঢাকার জেলা প্রশাসক উপরের নির্দেশে রাত ১০টা পর্যন্ত তার কার্যালয় ‘বিশেষ প্রয়োজনে’ খোলা রেখে আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিলের যে আদেশনামায় স্বাক্ষর করেছেন, তার কোনো অনুলিপি পর্যন্ত নেই। আছে কেবল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় হাসমত আলীর দায়ের করা কথিত এজাহার। আগেই উল্লেখ করেছি, দুপুর দুটো পর্যন্ত এনএসআই কার্যালয়ে হাসমত আলীকে আটকে রেখে দুটি কাগজে সই নেয়া হয়েছিল।
তারই একটি গেছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়। কোনো থানায় এজাহার দায়ের করতে হলে অভিযোগকারীকে সেখানে উপস্থিত হয়ে জিডি অথবা এফআইআর রুজু করা আইনত বাধ্যতামূলক। হাসমত আলী তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সারাদিনের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন এমন দাবি আমাকে গ্রেফতার করতে আসা পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ করেননি। এদেশে আদালত থেকে জারি করা হাজার হাজার গ্রেফতারি পরোয়ানা মাসের পর মাস কোর্টে এবং থানায় পড়ে থাকে। বিশেষ তদবির ছাড়া সেগুলো বাস্তবায়নে পুলিশের কোনো আগ্রহ থাকে না।
অথচ আমার ক্ষেত্রে একটি বানোয়াট অভিযোগ উত্থাপন করামাত্র শত শত পুলিশ কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই জামিনযোগ্য ধারার মামলায় কোর্টের নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই গ্রেফতারের জন্যে ছুটে এসেছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা পুরো অপারেশন মনিটর করছে। হয়তো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। সর্বক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন তত্পর হলে দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোনো সমস্যাই হতো না।
প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদকে ফোন করলাম।
তিনিই যে আমাকে এই পত্রিকাটি রক্ষার জন্যে অনেকটা জোর করে মিডিয়া জগতে নিয়ে এসেছিলেন, সে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমার অবর্তমানে পত্রিকা দেখা-শোনার দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানালাম। তার এবং তার স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও আমার অনুরোধ সামাদ ভাই ফেললেন না। কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম।
রাত ১টার দিকে বাসা থেকে ফোন এলো। মা এবং স্ত্রীর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিলাম।
পুরনো ঢাকা থেকে শেফালী নামের আমার এক খালা সেদিন বেড়াতে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গেণ্ডারিয়ায় আমরা একসঙ্গে থাকতাম। তিনিও অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে আমাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে বিদায় জানালেন। আমার মা সমস্তটা জীবন শিক্ষকতা করে একমাত্র সন্তানকে মানুষ করেছেন। তিনি জানেন বিনা অপরাধে জালিম সরকারের পুলিশ তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে।
সেই নৈতিক শক্তিতেই বোধহয় সেই দুঃখিনী মা নিষ্কম্প গলায় আমাকে মাথা উঁচু করে সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে সাহস জোগালেন। শাশুড়ি এবং খালা-শাশুড়ির সামনে টেলিফোনে কথা বলার সময় আমার স্ত্রীর যথাসাধ্য আবেগ চেপে রাখার চেষ্টা বুকফাটা কান্নার চেয়েও করুণ শোনাল। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে তাকে তেমন একটা সময় দিইনি। নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি। আর আজ চলেছি অজানার উদ্দেশে।
কবে আবার দেখা হবে, আদৌ দেখা হবে কি-না জানা নেই। আমার ঘরভর্তি সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী। বিদায়ের মুহূর্তে নিজের আবেগ নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ করব এমন পরিবেশ নেই। মাকে দেখার ভার স্ত্রীর কাঁধে অর্পণ করে মনে মনে ভাবলাম—ওর দায়িত্ব দেব সেই মানুষ কই? আমাদের সন্তান নেই, ওর কোনো ভাই নেই। পিতা থাকলেও অনেক বয়স হয়েছে।
কন্যাকে দেখার জন্যে তার আর কত সময় অবশিষ্ট রয়েছে, সেটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। এবার সহকর্মীদের ডেকে আমাকে বিদায় দেয়ার অনুরোধ জানালাম। কিন্তু তারা কোনো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। আমার পরম সুহৃদ, অগ্রজপ্রতিম কবি ফরহাদ মজহার সেই সন্ধ্যা থেকে একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। বিএনপির চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল সোহেল, ব্যক্তিগত সচিব শিমুল বিশ্বাস, শাম্মী আখতার এমপি এবং আরও পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দীর্ঘক্ষণ ধরে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন।
সবারই অভিন্ন বক্তব্য, এই রাতের আঁধারে আমার গ্রেফতার হওয়া নিরাপদ নয়। ক্রসফায়ার এবং গুম-খুন যে রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য আচরণ, সেখানে ফজরের নামাজের আগে আমার কোনো অবস্থাতেই যাওয়া চলবে না। সহকর্মী সাংবাদিকরা আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সম্পাদকের দরজা আগলে ঘরের বাইরে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে পড়ল। ওদিকে মূল প্রবেশদ্বারের বাইরে পুলিশের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। রাত ৩টায় বিবিসি থেকে ফোন পেয়ে বেশ অবাক হলাম।
বেশ কিছুদিন ধরে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির সংবাদ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচারে ক্ষমতাসীনদের প্রতি পক্ষপাত সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচারে প্রিন্ট মিডিয়ায় যে বিজ্ঞাপন দেয়, সেখানেও আমার দেশ পত্রিকার জন্যে বরাদ্দ প্রায় থাকে না বললেই চলে। কিন্তু ফোনের ওপারের মহিলার কণ্ঠস্বর এবং প্রশ্ন করার ধরন আজ যথেষ্ট সহানুভূতিশীল মনে হলো। ফ্যাসিবাদ ও মানবাধিকারের প্রশ্নে আমার দেশ পত্রিকার নৈতিক অবস্থান তুলে ধরলাম। আমাদের অবরুদ্ধ অবস্থার যথাসম্ভব বর্ণনা দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার লড়াইয়ে বিবিসিসহ মুক্তবিশ্বের সকল গণমাধ্যম এবং মানবাধিকারে বিশ্বাসী মানুষের সমর্থনের আহ্বান জানালাম।
সেই সাক্ষাত্কার বিবিসি থেকে প্রচারিত হয়েছিল কি-না আমার জানা নেই। সাক্ষাত্কারপর্ব শেষ না হতেই শেষবারের জন্যে স্ত্রীর ফোন পেলাম। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশের হেফাজতে চলে যাব জানাতেই পারভীন স্তব্ধ হয়ে গেল। থানায়, আদালতে কিংবা কারাগারে মা এবং সে যেন কোনোদিন আমাকে দেখতে না যায়, মিনতিভরে সেই অনুরোধ করলাম। ফ্যাসিবাদী সরকারের সব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করার মতো মনোবল আমার রয়েছে।
কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আমার প্রিয়জনের অপমান সইতে পারব না। দেড় বছরের শাসনামলে প্রমাণিত হয়েছে ন্যূনতম শালীনতা, সৌজন্যবোধও এদের মধ্যে নেই। বারবার করে পারভীনকে বললাম, তোমাদের কষ্ট হবে জানি, তবু আমার এই শেষ অনুরোধটুকু রক্ষা কোরো।
নিরস্ত্র মানুষের সব বাধা শেষরাত সাড়ে ৩টার মধ্যেই ভেঙে গেল। ঘরের বাইরে চেয়ার ছুড়ে ফেলা, সাংবাদিকদের লাঠিপেটা এবং অগ্রসরমাণ বুটের আওয়াজ পেলাম।
কয়েকজন বোধহয় দরজা আগলে রাখার শেষ চেষ্টা করেছিল। দাঙ্গা পুলিশের সবল ধাক্কায় সবাই ছিটকে পড়ল ঘরের ভেতরে। ডজন দুয়েক পুলিশের চাপে আমার সামনের টেবিলটা প্রায় গায়ের ওপর উঠে এলো। ফরহাদ ভাই সামান্য আহত হলে বললাম, আর নয়। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
চারদিক থেকে পুলিশের আগ্রাসী হাত এগিয়ে এলো আমার দিকে। সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ তখনও ফজরের নামাজ পর্যন্ত সময় চাইছে। অনুরোধ রক্ষা হবে না বুঝতে পেরে আমি কেবল শেষবারের জন্যে অজু করতে চাইলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সংলগ্ন বাথরুম থেকে অজু করে এসে বললাম, আমি তৈরি। চারদিকে অশ্রুর বন্যা।
অগুনতি পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে এগিয়ে গেলাম লিফটের দিকে। মুখে হাসি ধরে রেখেছি। নইলে সহকর্মীরা আরও ভেঙে পড়বে। লিফট বন্ধ হলো। চালকের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখেও পানি।
লিফট নিচতলায় নামলো। সেখানেও অত রাতে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষ অপেক্ষা করে আছে। এমপি পাপিয়া, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলনেত্রী শিরিন এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সোহেলকে বোধহয় চিনতে পারলাম। তখনও স্লোগান চলছে। গাড়িবারান্দার সামনেই একটি সাদা, দরজা খোলা, মাইক্রোবাস আমার জন্যে অপেক্ষমাণ।
কাছে এগোতেই ভেতর থেকে একজন হাত বাড়িয়ে সজোরে ভেতরে টেনে নিল। আমাকে মাঝখানে ঠেলে দিয়ে আরও একজন মাইক্রোবাসে উঠল। চালকের পাশেও দেখলাম অপর এক কর্মকর্তা। মুহূর্তের মধ্যে মাইক্রোবাস ছুটে চলল শেরাটন হোটেলের দিকে। কোথায় যাচ্ছি জানা নেই।
কেউ কোনো কথা বলছে না। জিজ্ঞাসা করাও অর্থহীন। বাংলামোটরের মোড়ে ইউটার্ন নেয়ার পর ওয়্যারলেসে কথা শুরু হলো। আবারও সোনারগাঁও হোটেল পেরিয়ে এবার উত্তরে ছুটতে লাগলাম। ছুটন্ত গাড়ির ভেতর থেকে মনে হলো বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার ইমারতের নিচতলায় তখনও বেশ লোকজন।
আমাকে কি দেখতে পেয়েছে তারা? ভাবছিলাম, থানায় নিচ্ছে নাকি দেশবাসী কালই ক্রসফায়ারের মিছিলে আরও একজন বেড়ে যাওয়ার একঘেয়ে গল্প শুনবে? মিনিট দশেকের মধ্যেই জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করলাম। সঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তারা ওয়্যারলেস অথবা মোবাইল ফোনে নির্দেশ দেয়া-নেয়া ছাড়া আমার সঙ্গে একটি বাক্যও বিনিময় করেনি। ভোর ৪টার দিকে একবার ভুলের পর চালক গাড়ি নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় প্রবেশ করল। জায়গাটি অপরিচিত। আগে কখনও এখানে আসার কারণ ঘটেনি।
মাইক্রোবাস থেকে নামলাম। কেউ কোনো কথা বলছে না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেই এগিয়ে গেলাম ডিউটি অফিসারের ঘরের দিকে। চেয়ার টেনে বসেও পড়লাম। ডিউটি অফিসার এবং শিল্পাঞ্চল থানা থেকে আগত আমার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) আবদুল আহাদ প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় নিল পারস্পরিক কাগজপত্র লেখা এবং সই-সাবুদ সমাপ্ত করতে।
ফজরের আজান শুনতেই পাশে মেঝেতে নামাজ পড়ার জন্যে দাঁড়িয়ে গেলাম। একজন কনস্টেবল দয়াপরবশ হয়ে একটি জায়নামাজ নিয়ে এলো। নামাজ শেষ হলে আইও আহাদ দুই-একটি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করল। আমার গ্রেফতারে বিলম্ব নিয়ে বেশ অনুযোগও শুনলাম। কর্মকর্তাটির কথা বলার ভঙ্গি যথেষ্ট তির্যক।
অভদ্র হয়তো বলা যাবে না তবে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ছিল প্রতিটি বাক্যে। সাড়ে ৫টার মধ্যেই আমাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো। জীবনে প্রথমবারের মতো থানার হাজতে পা রাখলাম।
হাজতটি বেশ বড়। এক কোণে আধা-মানুষ সমান উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা প্রাতঃকৃত্যের জায়গা।
পাশে ধূলি-ধূসরিত কালো রঙের ময়লা কম্বল পড়ে আছে। ওই কম্বল পেতে বসার চেয়ে নোংরা মেঝেতে বসা অনেক ভালো। যতক্ষণ শরীরে কুলায় পায়চারি করে সময় কাটানোই মনস্থ করলাম। আমার দিকে একবার তাকিয়ে ডিউটি অফিসার চলে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ফিরে এলো একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে করে।
তার হাতে একটা চেয়ার। গারদের তালা খুলে চেয়ারটা দিয়ে বলল—স্যার, এখানে বসে সময় কাটান। প্রত্যুত্তরে ধন্যবাদ জানালাম। বসার আয়োজন তো হলো। কিন্তু মশা এবং ভ্যাপসা গরমের যুগপত্ আক্রমণে সময় কাটানো কঠিন।
ডিউটি অফিসার খানিক বাদে একটা মশার কয়েল এনে গারদের লোহার দরজার ওপারে জ্বালিয়ে আমাকে বলল—স্যার, দরজার কাছে এসে বসেন, গরম এবং মশা দুটোই কম লাগবে। আমাদের গারদের ভেতরে কয়েল দেয়ার নিয়ম নেই। পুলিশ কর্মকর্তাটির সৌজন্যে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ বোধ করলাম। আমাকে পাহারা দেয়ার জন্যে একজন সেন্ট্রি গারদের বাইরে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। ছেলেটির সঙ্গে টুকটাক গল্প করতে করতে ৮টা বাজল।
কৌতূহলবশত থানার অন্যান্য সেন্ট্রিও উঁকি দিয়ে আমাকে দেখে গেল। এর মধ্যেই ক্যান্টিন থেকে নাস্তা এলো। দুটো ছোট পরোটা, ডিমভাজি এবং লেবু দেয়া এককাপ রঙ চা। আগের রাত থেকে প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। ডিমভাজি দিয়ে একটা পরোটা এবং চা খেলাম।
চায়ের স্বাদটা চমত্কার লাগল।
সময় আর কাটতে চায় না। ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হচ্ছি। গেঞ্জি-শার্ট ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। দেয়ালঘেরা প্রাতঃকৃত্যের জায়গায় গোসল হয়তো করা যেত; কিন্তু সঙ্গে দ্বিতীয় কোনো কাপড় নেই।
ঘামের গন্ধে নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগছে। এর মধ্যেই দুপুরে ভাত খাওয়ার প্রস্তাব এলো। এ অবস্থায় খাওয়ার রুচি হলো না। আরও এককাপ লেবু চা চেয়ে খেলাম। বসে বসে ভাবছিলাম আইন অনুযায়ী তো আমাকে আজই কোর্টে হাজির করার কথা।
জামিন না পাই, আপনজনরা অন্তত জানবে আমি এখনও বেঁচে আছি। পরক্ষণেই মনে হলো, এক-এগারোর সরকার অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ আদালতে সোপর্দ না করেই অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখেছিল। অসহায় আত্মীয়স্বজন তখনকার ক্ষমতাবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছে প্রিয়জনের হদিসের জন্যে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সেই অবৈধ সরকারেরই ফসল। চোখ বুজে একমনে আল্লাহর কাছে সবরের প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম।
বিকাল সাড়ে ৩টায় গারদের তালা খোলা হলো। শুনলাম আমাকে আদালতে নেয়ার জন্যে প্রিজন ভ্যান এসেছে। প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয় সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের অপরাধে দায়ের করা মানহানি মামলার হাজিরা দিতে গ্রেফতার হওয়ার দু’সপ্তাহ আগে সিএমএম আদালতে গিয়েছিলাম। সেদিন সহকর্মী সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান সঙ্গে ছিল। আদালতে প্রিজন ভ্যানে আসামিদের গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বড় কষ্ট লেগেছিল।
এক আসামির স্ত্রীকে দেখেছিলাম কোলের ছেলেটিকে উঁচু করে ধরে আছে যাতে প্রিজন ভ্যানের মধ্যে থাকা পিতা তার সন্তানকে একটু স্পষ্ট করে একনজর দেখতে পায়। দৃশ্যটি বিশ্ববিখ্যাত ‘স্পার্টাকাস’ ছবির মতো লেগেছিল, যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী, ক্রুশবিদ্ধ স্পার্টাকাসের সামনে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী সদ্যোজাত পুত্রকে দু’হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে ছিল। যতবার ছবিটি দেখেছি, অবধারিতভাবে ওই দৃশ্যে চোখে পানি এসেছে। আমি নোমানকে ভাঙাচোরা প্রিজন ভ্যানে আসামিদের অসুবিধা নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখতে বলেছিলাম। তখন কি জানতাম এত শিগগির আমাকেই প্রিজন ভ্য।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।