আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মা মানে স্মৃতির গভীর আকুলতা নিয়ে জাবর কাটা।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার। প্রথম যেদিন স্বপ্নে দেখলাম মা বলছে, সবাই কি আর চিরদিন বেঁচে থাকে ? কেন এমন করিস ? সেদিন থেকে মাকে হারানোর দুঃখ আমার অন্য রকম ভাবালুতায় মোড় নিয়েছে। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে নিজকে বড় একা লাগত, অরক্ষিত মনে হতো নিজকে। ভাবতাম পৃথিবীতে আমি বড় একা, নিরাপদ আশ্রয় বলতে আমার আর কিছুই নেই। সে রাতে মাকে স্বপ্ন দেখার পর থেকে মনে হতে লাগল মা আমার কাছ থেকে চির বিদায় নিয়েছে একথা সত্যি, তাই বলে পৃথিবীতে আমি একেবারে একা নই, অরক্ষিত হয়ে যাইনি।

মা আছেন আমার চারপাশে অদৃশ্য শক্তি হয়ে। শুধু সশরীরে মাকে দেখতে পাচ্ছি না আমি। আমার মনে হয় এটাও অতি সাময়িক একটা ঘটনা। মাকে আমি একদিন না একদিন দেখতে পাবই। পত্র-পত্রিকায় মাকে নিয়ে সন্তানদের আবেগতাড়িত যত লেখা বের হয় আমি সেগুলো মনযোগ দিয়ে পড়ি।

মাকে নিয়ে লেখা কোন গান কারও কন্ঠে শুনলে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। নিজকে ধরে রাখতে পারিনা। বুকের নীরব কান্নাগুলো চোখের পানিতে সরব হয়ে উঠে। আমার কেবলই মনে হয়, মাকে নিয়ে বুকের মধ্যে জমে থাকা সবটুকু ভাবাবেগ দিয়ে গানগুলো লেখা হলেও মায়ের বাস্তব প্রতিরূপ হয়ে উঠতে পারেনি কোনটা। আমার আরও মনে হয় যে, শিল্পীরা যত দরদ দিয়ে গাক না কেন গানগুলো, মাকে ঘিরে সন্তানের মনের আর্তির খুব কমই প্রকাশ পাচ্ছে তাতে।

আমি জানি, মাকে নিয়ে আমার অন্তহীন হৃদয়ানুভূতির কারণেই এমনটা মনে হয় আমার । জানিনা আর সবার অনুভূতি এমন হয় কি না। রাস্তায়-বাসে বা অন্য কোথাও আমার মা-বাবার বয়সী কোন বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধাকে দেখলে আমার মা-বাবার মুখ দুটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। মনে হয়, কেন বেঁচে থাকল না আমার মা-বাবা ? আর যদি এই বয়সের কাউকে অন্যের কাছে হাত পাততে দেখি কিংবা অন্য কোনভাবে কষ্ট পেতে দেখি তহিলে আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। আমি মেনে নিতে পারিনা তাদের এহেন অবস্থাকে।

তাদের সন্তান আছে কি না, থাকলে কোথায় কি অবস্থায় আছে ? --এসব প্রশ্নের উত্তরের তোয়াক্কা না করেই আমার মনটা বিষিয়ে উঠে সেই সন্তানদের প্রতি। প্রচন্ড রকম বিদ্রোহী হয়ে উঠে তখন আমার মনটা। অথচ আমরা সাত জন ভাই-বোনের সবাই কিন্তু সমানভাবে আমার মা-বাবার দেখভাল করিনি। আমার যে ভাইটা পরিপূর্ণ সামর্থ থাকা সত্ত্বেও মায়ের দীর্ঘ অসুস্থকালীন সময়ে মায়ের খোঁজ-খবর নিত না, দেখতাম মা ওকে দেখার জন্যই সব সময় উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। এই হচ্ছে মায়ের মন ! সন্তানকে কখনও এপিঠ-ওপিঠ করে দেখতে পারে না।

আর সেই সন্তানরা কত সহজেই না মা-বাবার অমর্যাদা করে ! জানিনা ঐসব সন্তানদের হৃদয়ের তন্ত্রীগুলো কি দিয়ে গড়া ! বিধাতা কি স্বহস্তে ওদের মনে কঠিন কোন প্রলেপ এঁটে দিয়েছেন ? টিভিতে যখন বৃদ্ধ নিবাসের বুড়ো-বুড়িদের দেখায় তখন আমার মনটা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আহার-নিদ্রা, ভরণ-পোষণ, সেবা-যত্ন--কোন দিক দিয়েই উনারা বৃদ্ধ নিবাসে অবহেলিত নন। তা সত্ত্বেও বাইরের এই চাকচিক্যকে ভেদ করে আমি উনাদের বুকের শূণ্যতা হাতড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার কেবলই মনে হয়, যত আদর যত্নেই থাকুক না কেন ? নিজের সন্তান, নাতী-নাতনী কিংবা অন্যান্য আপনজনদের সান্নিধ্যে পারিবারিক আবহে যে মানসিক সুখ উনারা পেতেন তা থেকে উনারা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বৃদ্ধ মানেই শিশু।

তাই নাতী-নাতনীদের সান্নিধ্যে বৃদ্ধ মানুষদের সময় কাটে নিবিড় আনন্দ মুখরতায়। অথচ এই সুখ থেকে বঞ্চিত বৃদ্ধ নিবাসের বাসিন্দারা। এখানে তাদেরকে যত সুখ-সুবিধাই দেয়া হোক না কেন, একটা পারিবারিক জীবনের হাহাকার তাদেরকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায়--যে পরিবারকে বুকের স্বপ্ন-সাধ-ভালবাসা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তারা। সেই পরিবারের কর্তা-কত্রী এবং সিদ্ধান্তদাতা ছিলেন তারাই। এখন সেই পরিবারটা হয়ে গেছে তাদের কাছে দূর অতীতের স্বপ্ন।

সেই স্বপ্নের করিডোড়ে আবারও নিজকে দেখার জন্য তাদের মনে যে হাহাকার, আমার মনে হয় তাদের বুকে কান পাতলে সেই হাহাকারধ্বনি বাইরে থেকে শুনা যাবে। তাদের বুকের এই কষ্ট যাদের উপলব্ধি করার কথা তাদের সেই সন্তানরা কেউ স্ত্রী-পরিজন নিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছে, কেউ হয়ত জীবন সিড়িঁর উচ্চ সোপানটাতে অধিষ্ঠিত হয়ে ভুলে গেছে পেছন ফিরে তাকাবার কথা। ভুলে গেছে যে, বাবা-মায়ের প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা -শুভ কামনা না থাকলে তার পক্ষে এই সোপানটাতে পৌঁছানো কোনদিনই সম্ভব হত না। এরা মনে করতে চায় না যে, বুড়ো বয়সের অসহায়ত্বের কাছে নিজকে সঁপে দেয়ার সময়টাতে সন্তানের সান্নিধ্য একজন মানুষের কত প্রয়োজন ! যদি এক বারের জন্যও এই উপলব্ধিটা তাদের মনে আসত তাহলে আমার মনে হয় কোন সন্তানই তার বাবা-মাকে বৃদ্ধ নিবাসে রেখে সুখে জীবন যাপন করতে পারত না। লেখাটা শুরু করেছিলাম আমার মায়ের প্রসংগ দিয়ে।

আসলে নিজের মা-বাবার জন্য গভীর মমত্ববোধ ও ভালবাসা না থাকলে অন্যের মা-বাবার কষ্ট উপলব্ধি করা যায় না। যাদের ভিতর এই অনুভূতি নেই তারা মা-বাবার স্নেহমধুর সান্নিধ্যে নিজকে আবিস্কার করতে বরাবরই ব্যর্থ হয়। আমি মনে করি পৃথিবীতে চরম হতভাগা শ্রেণীর মানুষ এরা। মা-হীন পৃথিবীতে আমি যখন মায়ের স্নেহমাখা কোলের খোঁজে প্রায় দিশেহারা তখন মনে হয়, আমি অন্তত পেরেছিলাম আমার মায়ের নিবিড় স্নেহের সান্নিধ্যে নিজকে আবিস্কার করতে। তা নাহলে মায়ের স্নেহ-ভালবাসার জন্য এখনও কেন আমার মনটা এতটা বুভুক্ষু ? মা একদিন হয়ে যাবে শুধুই স্মৃতি-এই কথাটা কখনই ভাবেনা কোন সন্তান।

আমার ভাবনার সীমাবদ্ধ প্রাচীর ডিঙিয়ে সেই কঠিন বাস্তবটাই আজ আমার জীবনে সত্যি হয়ে আছে। আমার মা নেই। চলে গেছে পরপাড়ে আমাদের সমস্ত মায়ার বন্ধন কাটিয়ে। আমার মা এখন শুধুই স্মৃতি, স্মৃতির হীরা-চুনি-পান্না। আমার কাছে এখন মা মানে হৃদয়ের গভীর আকুলতা নিয়ে স্মৃতির জাবর কাটা।

এটা যেমন সত্য তেমনি আর একটা সত্য হলো যে, মা-হীন পৃথিবীতে আমরা ঠিকই হেসে-খেলে বেঁচে আছি। এটাকে ঐ সত্যের উল্টো পিঠও বলা যেতে পারে। বললাম এই কারণে যে, আমি এই সত্যটাকে উপলব্ধি করেছি আগের সত্যটার পথ বেয়ে। জানিনা কেন এমন হয়! আমার অবসরের বেশীরভাগ মুহূর্তগুলো আজও মাকে ঘিরে মুখর হয়ে থাকে। বিশেষ করে মায়ের অসুস্থকালীন চার বছরেরও বেশী সময়ের স্মৃতিগুলো আমাকে বড় বেশী আপ্লুত করে রাখে।

একেবারে অবুঝ শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন আমার মা। নানা রকম বায়না করতেন আমার কাছে। মায়ের সেই কথাগুলো আজও কানে বাজে আমার। একবার মাঘ মাসের পূর্ণিমা রাতে বায়না ধরলেন উঠোনে বসে চাঁদ দেখবেন। গ্রামে এই সময়টাতে শীত রীতিমতো ঝাঁকিয়ে বসে, বিশেষ করে রাতের বেলা।

কিন্তু মায়ের ইচ্ছে বলে কথা ! হাতে-পায়ে মোজা পরিয়ে, সুয়েটার শাল গায়ে জড়িয়ে, কম্বল দিয়ে হুইল চেয়ারসহ ঢেকে আম্মাকে নিয়ে বসালাম উঠোনে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তখন ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। হুইল চেয়ারে বসে আম্মা কিছুণ চাঁদের দিকে চেয়ে থেকে বললেন চাঁদ ত দুইটা। আমি বলললাম আম্মা, ভাল করে চেয়ে দেখেন কয়টা চাঁদ। আচ্ছা, বলে আবার কিছুণ চাঁদের দিকে চেয়ে থেকে আম্মা বললেন চাঁদ তিনটা।

আমি হেসে বললাম, বুঝেছি। এরপর আরও বাড়বে চাঁদের সংখ্যা। সাথে সাথে আম্মা বললেন ঠিক কইছস। ঐ ত চারটা চাঁদ। এভাবে প্রচন্ড শীতের মধ্যে বসে ঘন্টাখানেক সময় ধরে চাঁদ দেখলেন আম্মা।

তারপর আম্মাকে অনেকটা জোড় করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম আমি। আমি জানিনা আমার মা সেদিন চাঁদের মধ্যে কি খোঁজে পেয়েছিলেন ? হয়তো কিছুই খোঁজে পাননি। মায়ের একটা অবিনশ্বর স্মৃতি আমাকে উপহার দেবার জন্য হয়তো বিধাতাই ইচ্ছে করে এমনটি ঘটিয়েছিলেন। তাই আজ আমি প্রতি পূর্ণিমার রাতে আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে মায়ের মুখটি খোঁজে পাই। আমার নয় তলা ফ্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পূব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।

ঝলঝলে পূর্ণিমার চাঁদটা আমার চোখের সামনে হয়ে যায় মায়ের উদ্ভাসিত মুখ। আমি হাত বাড়াই মায়ের মুখটি একবার ছুঁয়ে দেখার লোভে। কিন্তু বারান্দায় গ্রীলে আটকে যায় আমার হাত। তবুও কঠিন বাস্তব আমাকে তার কাছে টানতে পারে না। আমি আবারও ধ্যানমগ্ন হই।

মায়ের সেদিনের কথাগুলো কানে বাজে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলি কোথায় হারিয়ে গেলে মা তুমি আমাকে একা ফেলে ? ঐ চাঁদের বুকে মুখ লুকালে বুঝি ? সে জন্যই এত উজ্জল ঐ চাঁদ। আমি টের পাই আমার বুকের কান্নাগুলো জলের ধারা হয়ে নেমে আসছে দু’গাল বেয়ে। আমি অনেকক্ষণ ধরে কাঁদি আর মনে মনে মাকে ডাকি। এক সময় হালকা হয় বুকটা।

কিন্তু আমি জানি মায়ের জন্য আমার এই দীর্ঘশ্বাস থামবার নয়। আকাশে চাঁদ উঠবে চিরকাল। চিরকাল পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় ভাসবে রাত, সাজবে নব সাজে। আমি সেই রাতের বুকে আমার মায়ের অস্তিত্ব খোঁজে পাব চাঁদের হাসিতে। চাঁদ হাসবে, সাথে সাথে আমার মায়ের হাসিমাখা মুখটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে।

আমার মা আমার কাছে স্মৃতি হয়ে গেছে। কিন্তু এমন ঝলঝলে আলো বিধৌত শ্বাশত স্মৃতি ক’টি হতে পারে ? তাই তো স্মৃতি হয়ে গিয়েও আমার মা আমার চারপাশে জীবন্ত। মাঝে মাঝে অদম্য হয়ে উঠে আমার মনটা। বিদ্রোহ করতে চায় বিধাতার প্রতি। মনে প্রশ্ন জাগে, আমার মাকে এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে উঠিয়ে না নিলে কি চলত না ? কোন উত্তর পাইনা এই প্রশ্নের।

নিজে নিজে স্বান্তনা খুঁজি, অনেকের মা তো আরও আগে মারা যায়। তারা কি করে তখন ? বিধাতার বিচার হচ্ছে সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ বিচার। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন চলে না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।