সব বিষয়ে জানতে ও শিখতে আগ্রহী একজন উদার মনের মানুষ।
সব ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পড়ন্ত পানি, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল কিংবা পারমাণবিক জ্বালানীর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেনারটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয় (ব্যতিক্রম: সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র)। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মূলত দুই প্রকার। হাইড্রলিক বা জলবিদুৎ এবং থার্মাল বা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এছাড়া সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জিও-থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও এখন দেখা যায়।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আবার জ্বালানীর উৎস ভিত্তিতে দুই রকম - জীবাশ্ম জ্বালানী বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি পুড়িয়ে তাপ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি কেন্দ্রগুলোতে কয়লা, তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পারমাণবিক চুল্লিতে (Nuclear Reactor) তেজস্ক্রিয় আইসোটেপের দহনে তাপ উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন তাপ বয়লার সিস্টেমের মাধ্যমে পানিকে বাষ্পীভূত করে।
উৎপাদিত বাষ্প স্টিম টারবাইনকে সক্রিয় করে। টারবাইনের সঙ্গে যুক্ত অলটারনেটর (এক ধরনের জেনারেটর) বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। অলটারনেটরের একটি বিশেষ অংশ মোটর, ইজ্ঞিন বা অন্য কোনো উপায়ে ঘোরালে পরিবর্তী বৈদ্যুতিক ভোল্টেজ (alternating current) সৃষ্টি হয়। এই ব্যবস্থা যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপাণ্তরিত করে।
প্রচলিত অর্থে নিওক্লিয়ার পাওয়ার বা কেন্দ্রীণ ক্ষমতা হলো পারমাণবিক চুল্লিতে কেন্দ্রীণ বিভাজন থেকে প্রাপ্ত শক্তির ব্যবহার।
এই তাপ শক্তি দিয়ে পানিকে বাষ্পে পরিণত করা হয়। বিভাজন বিক্রিয়া (Fission) ঘটে ভারি পরমাণুর কেন্দ্রীণ ভাঙ্গনের ফলে এবং তার ফলে যে শক্তি অবমুক্ত হয় তা রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত শক্তির দশলক্ষ গুণ বেশি যেখানে শুধু জ্বালানি পোড়ানো হয়।
আমরা জানি প্রত্যেক পদার্থ পরমাণু নামক অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত। সব মৌলের পরমাণুতে থাকে ইলেকট্টন, প্রোটন এবং নিউট্রন - এই তিনটি মূল কণিকা। নিউট্রন ও প্রোটন পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে।
ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থান করে। পরমাণু সামগ্রিকভাবে কোনরূপ চার্জযুক্ত থাকে না। যেহেতু নিউট্রন চার্জবিহীন, সেহেতু পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা অবশ্যই সমান হবে। কেননা, প্রোটন ও ইলেকট্রনের আধান বিপরীতধর্মী ও সমপরিমাণের।
একই মৌলের বিভিন্ন পরমাণুর কয়েক প্রকারের ভর হতে পারে।
(ভর = প্রোটন ও নিউট্রনের সর্বমোট সংখ্যা) যে সব পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সমান কিন্তু ভর সংখ্যা ভিন্ন হয়, সে সব পরমাণুকে পরস্পরের আইসোটোপ বলা হয়। অর্থাৎ নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্যের জন্যই আইসোটপের সৃষ্টি। একই মৌলের সব আইসোটপের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম একই থাকে। কোন কোন পরমাণুতে পারমাণবিক কেন্দ্রীণের অস্থায়িত্ব থেকে যে প্রতিভাসের সৃষ্টি হয় তার নাম তেজস্ক্রীয়তা। এই অস্থায়িত্বেরকালে কেন্দ্রীণ এক স্বতঃস্ফুর্ত রূপান্তরের বা পরিবর্তনের মধ্যে পরে যায় এবং এর ফলে বিকিরণ নিঃসৃত হয়।
ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, প্লুটুনিয়াম ইত্যাদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ। এতক্ষণ যা আলাপ করলাম তার উদ্দ্যেশ্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জটিল প্রক্রিয়াকে বুঝতে সবার জন্য যেন সহজ হয়। এখন আসল কথায় ফিরে আসি।
পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে বা বিভাজন করে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকে পারমাণবিক শক্তি বলে। ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন প্রমাণ করেন যে, পদার্থ ও শক্তি প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন অর্থাৎ পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় এবং শক্তিকে রূপান্তরিত করা যায় পদার্থতে।
m ভরবিশিষ্ট কোন পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার পরিমাণ E=mc² এখানে c=আলোকের বেগ = 300,000 km/sec.
ফিশানের (Fission) শাব্দিক অর্থ বিভাজন। একটি ভারী পরমাণুকে দ্রুতগামী নিউট্রন দ্বারা ভেঙ্গে হালকা ভারের একাধিক পরমাণু ও শক্তি উৎপন্ন করার প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানো হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে (Nuclear Power Plant)। যে সকল তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই ফিশন বিক্রিয়ায় অংশ নেয় তাদের ফিসাইল পদার্থ বা পারমাণবিক জ্বালানী বলা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হয় ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপ। মজার ব্যাপার হচ্ছে তেজস্ক্রিয় কিছু আইসোটোপ আছে যেগুলো বিশেষ অবস্থায় নিজেরাই নিজেদের পরমাণুকে ভেঙ্গে তাপশক্তি বিকিরণ করে।
Uranium-235(92+143)একটি সুস্থিত (stable) তেজস্ক্রিয় পদার্থ যার প্রতিটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ৯২টি প্রোটন ও ১৪৩টি নিউট্রন আছে। ইহার পরমাণুতে বাহির থেকে একটি নিউট্রন ঢুকিয়ে দিলে তখন এটি ইউরেনিয়ামের অস্থিত (unstable) আইসোটোপ Uranium-236 -এ পরিণত হবে। এই আইসোটোপটি নিজের অস্তিত্ব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। তাই এর পরমাণুটি ভেঙ্গে দুটি সুস্থির (stable) পরমাণুতে (Krypton and Barium) পরিণত হবে। ভেঙ্গে যাওয়ার প্রাক্কালে পরমাণুটি প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে দুটি অতিরিক্ত নিউট্রনকে মুক্ত করে দেবে।
মুক্ত নিউট্রন দু’টি আবার ইউরেনিয়ামের নতুন দু’টি পরমাণুকে ভেঙ্গে প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে চারটি নিউট্রনকে মুক্ত করে দেবে।
এইভাবে চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর অস্তিত্ব থাকবে। এই ধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বলা হয় চেইন রিয়েকশন। চেইন রিয়েকশনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তাপশক্তি বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। যেমন নিউক্লিয়ার বোমা।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লীতে (Reactor) ইউরেনিয়ামের রডগুলো বিশেষভাবে সজ্জিত থাকে। চুল্লীগুলো বিভিন্ন ধাপে খুব শক্ত ও প্রশস্ত কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয় যাতে তেজস্ক্রিয়তা বাহিরে আসতে না পারে। ফিশনের পরিমাণ তথা চেইন রিয়েকশনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য Cadmium দিয়ে নির্মিত নিয়ন্ত্রক রড/পাইপ ব্যবহার করা হয়। কারণ Cadmium মুক্ত নিউট্রনকে সহজেই চুষে নেয়। চুল্লীর তাপমাত্রাকে কমাতে বা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক পাইপ দিয়ে ইউরোনিয়াম রডকে ঢেকে দেওয়া হয়।
আর সম্পূর্ণ রিয়েক্টরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হয় পানি। রিয়েক্টরের তাপে এই পানি বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প দিয়েই টারবাইনের সাহায্যে জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। টারবাইনে ব্যবহারের পর এই বাষ্পকে কুলিং টাওয়ারের মাধ্যমে পানিতে পরিণত করে আবার রিয়েক্টরে ফেরত পাঠানো হয়। প্রয়োজনে অতিরিক্ত বাষ্প চিমনি দিয়ে বের করে দেওয়া হয় ও নতুন পানি বাহির থেকে সরবরাহ করা হয়।
চুল্লীর মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যেসব তেজস্ক্রিয় পার্টিকেল প্রস্তুত হয় তারমধ্যে Deuterium ও tritium অন্যতম। এগুলো পানির হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে নিউট্রন যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়।
কোন কারণে রিয়েক্টর বন্ধ করে দিলেও কয়েকদিন পর্যন্ত রিয়েক্টরের ভেতর উচ্চ তাপমাত্রা থাকে। কারণ পারমাণবিক বিক্রিয়া হঠাৎ করে সম্পূর্ণ থামিয়ে দেয়া যায় না। তাই রিয়েক্টর বন্ধ করে দিলেও ডিজেল জেনারেটর অথবা ব্যক আপ জেনারেটর দিয়ে পাম্প চালিয়ে রিয়েক্টরে পানির প্রবাহ সচল রাখা হয়।
ডিজেল জেনারেটর কাজ না করলে ব্যাটারি ব্যাবহার করে পাম্প সচল রাখারও ব্যবস্থা আছে। এই পানির প্রবাহ যদি কোন ভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে রিয়েক্টরের তাপমাত্রা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, ফলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক কালে (18 March, 2011) জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লি একই সাথে প্রচন্ড ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থের কারণে বিকল্প পাম্পগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চুল্লিতে পানি সরবরাহ সচল রাখা সম্ভব হয়নি। যার ফলে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বিস্ফোরণ ঘটে।
পানির ব্যবহারের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দুইভাগে ভাগ করা যায়: Pressurized Water Reactor ও Boiling Water Reactor।
১) Pressurized Water Reactor (PWR):
এখানে পানিকে বিশেষভাবে চাপের মধ্যে রাখা হয়, ফলে পানি খুবই গরম হবে কিন্তু ফুটবে না বা বাষ্পে পরিণত হবে না। এই super heat পানিকে একটি তাপ পরিবাহী পাইপের মধ্যে দিয়ে চালনা করা হয়। পাইপটির অংশ বিশেষ স্টীম জেনারেটর বা হিট চেইঞ্জারের মধ্যে প্রবেশ করনো থাকে। বাহির থেকে সরবরাহকৃত পানি স্টীম জেনারেটরে এসে সুপার হিট পানির তাপ শোষন করে বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প টারবাইনকে সচল করে কনডেনসর/কুলিং টাওয়ারে এসে পানিতে পরিণত হয়ে আবার চুল্লীতে একই প্রক্রিয়ায় ফিরে যায়।
সুবিধা: চুল্লীর তেজস্ক্রিয় পানি বাহিরে আসতে পারে না। অসুবিধা: পানিকে চাপে রাখার জন্য আলাদা শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। জাপানের ফুকুশিমায় বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ছিল এধরনের Pressurized Water Reactor।
২) Boiling Water Reactor (BWR):
এখানে চুল্লীতে চেইন রিয়েকশনের তাপে পানি সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়। এই তেজস্ক্রিয় বাষ্প চুল্লীর বাহিরে এসে টারবাইনকে সচল করে কনডেনসর/কুলিং টাওয়ারে পানিতে পরিণত হয়ে আবার চুল্লীতে ফিরে যায়।
অসুবিধা: চুল্লীর তেজস্ক্রিয় পানি বাহিরে আসায় সহজে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। সুবিধা: পানিকে চাপে রাখার জন্য আলাদা শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।
মেল্টডাউন: রিয়েক্টরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে ফুয়েল রড তথা ইউরেনিয়াম রড গুলো গলে গিয়ে রিয়েক্টরের মেঝেতে তেজস্ক্রিয় জ্বালানী ছড়িয়ে পড়তে পারে। রিয়েক্টরের মেঝে ২২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক বিক্রিয়ার (চেইন রিয়েকশন) ফলে তাপমাত্রা ৪০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ফলে রিয়েক্টরের মেঝে গলে গিয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটির নীচে চলে যাবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহের সাথে মিশে যাবে। দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাটির নীচ থেকে সংগ্রহ করা হয়, সেক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া রিয়েক্টরের তেজস্ক্রিয় বাষ্প বাতাসের অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ঘটায়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুফল: গ্রীনহাউস এফেক্ট বা গ্লোবাল ওর্য়ামিংয়ের মত কোন সাইট এফেক্ট এখানে নেই। The World Nuclear Association -এর মতে বর্তমান বিশ্বে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পারমাণবিক কেন্দ্রে উৎপন্ন হয় তা কয়লা দিয়ে উৎপন্ন করতে প্রতি বৎসর বায়ুমন্ডলে 2.6 বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড যোগ হত।
এক পাউন্ড ইউরোনিয়াম দিয়ে যে পরিমাণ বিদুৎ উৎপাদন করা সম্ভব তা কয়লা দিয়ে উৎপাদন করতে ৩ মিলিয়ন পাউন্ড কয়লার প্রয়োজন। পারমাণবিক রিয়েক্টরের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও কম। যেসব দেশে গ্যাস, তেল, কয়লা ইত্যাদি খনিজ সম্পদ নেই তাদেরকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করতে হয় না।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কুফল: একটি পারমাণবিক শক্তির চুল্লি স্থাপনের পূর্বে অঞ্চলের পরিবেশ, ভূ-কম্পন প্রবনতা, হাইড্রোলজি, আবহাওয়াবিদ্যা, জনসংখ্যা এবং শিল্প-পরিবহন ও সামরিক স্থাপনাসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হয়। এছাড়া অগ্নিকান্ড, বিস্ফোরণ, বিকিরণ, ও দুর্ঘটনার কারণে মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণে আন্তর্জাতিক মানের নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লির দুর্ঘটনার ফলে ক্যান্সারজনিত রোগের সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যেসব স্থানে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে সেসব স্থানে জন্ম নেয়া সকল শিশুই শারীরিক প্রতিবন্ধীকতার শিকার হয়, জমির উর্বরতা চিরদিনের জন্য বিনষ্ট হয়। পারমাণবিক চুল্লিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার পর সৃষ্টি হয় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য যা জীবজগত ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপদজনক। এসব বর্জ্য কমপক্ষে ১০,০০০ বছর বিশেষভাবে সংরক্ষণ করতে হয় যেন তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে না পারে।
যতই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হউক না কেন তারপরেও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও কারিগরি ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমবেশি থেকে যায়। কোন দেশ বা জাতিকে বিপন্ন করার জন্য আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা সে দেশের পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালাতে পারে। এছাড়া পারমাণবিক চুল্লির প্রযুক্তি ও ইউরেনিয়াম দিয়ে পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা থাকে। পারমাণবিক চুল্লির শক্তির উৎস হচ্ছে অপ্রতুল ও দুর্লভ মৌল ইউরেনিয়াম। বিজ্ঞানীদের ধারণা বর্তমানে যে হারে ব্যবহার হচ্ছে তাতে আগামী ৪০ থেকে ৬০ বৎসর পর ইউরেনিয়াম আর পাওয়া যাবে না।
পারমাণবিক চুল্লি নির্মান খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার।
বিশ্বের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৬% আসে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বিশ্বের ৩১টি দেশের ৪৪০টি পারমাণবিক চুল্লিতে এই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একাই রয়েছে ১০৪টি রিয়েক্টর যেখানে উৎপাদন হয় তাদের ২০% বিদ্যুৎ। ফ্রান্সের ৫৯টি রিয়েক্টর সেদেশের মোট উৎপাদনের ৭৮% বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
বর্তমানে যেসব দেশে আরো রিয়েক্টর নির্র্মানাধীন রয়েছে তারমধ্যে শীর্ষে রয়েছে চীন ও ভারত। ভারতে বর্তমানে ২০টি পরমাণু চুল্লি রয়েছে। যারা একটি বাদে সব ক'টি চালু রয়েছে। বর্তমানে ভারতের মাত্র ৩ শতাংশ চাহিদা মেটে পরমাণু বিদু্ৎতে। এই উৎপাদন ২০২০ সালের মধ্যে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ ও ২০৩০ সালে ১৩ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের।
International Nuclear and Radiological Event Scale (INES): পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও সম্ভাব্য বিপর্যয়কে পরিমাপ করার জন্য যে স্কেল ব্যবহার হয় তাকে সংক্ষেপে INES স্কেল বলা হয়। এর প্রণেতা হচ্ছে International Atomic Energy Agency (IAEA)।
ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদমাত্রার পরিমানকে এই স্কেলে সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে। স্কেলের ধাপগুলোকে লগারিদম পদ্ধতিতে বাড়ানো হয়েছে, অর্থাৎ ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদমাত্রার পরিমান প্রতি ধাপে দশ গুণ করে বাড়ে। উল্লেখ্য ১৯৮৬ সালের ইউক্রেনে চেরনোবিল দুর্ঘটনাকে স্কেলের সর্বোচ্চ ৭ নম্বর মহা বিপর্যয়, ১৯৫৭ সালে রাশিয়ায় মায়াক দুর্ঘটনাকে ৬ নম্বর বিপর্যয়, সাম্প্রতিক কালে জাপানের ফুকোশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনাকে ৫ নম্বর বিপর্যয় এবং ১৯৮০ সালে ফ্রান্সের সেন্ট লরেন্ট দূর্ঘটনাকে ৪ নম্বর পর্যায়ের বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র: আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি বিদ্যুৎ সমস্যা। এটি এখন আর নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে, স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত থেকে শুরু করে হাসপাতালের মত জরুরী প্রতিষ্টানগুলোও তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারছে না। গ্যাস ও কয়লার অভাবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। অথচ নাগরিক জীবনে বিদ্যুতের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে।
এছাড়া দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য বিদ্যুতের গুরুত্ব অপরিসীম। সারা দুনিয়াজুড়েই যে জাতি যতো বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার করতে পারে সে জাতি ততো বেশি উন্নত বলে স্বীকৃতি রয়েছে। আজকের বিশ্বের ধনী দেশগুলো বেশিরভাগ পারমাণবিক চুল্লি নির্মান করেছিল ৬০ ও ৭০ -এর দশকে। পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ জাপান এটম বোমার আগুণে দগ্ধ হয়েও চরম ঝুঁকি নিয়ে ১৯৬০ সালে পারমাণবিক চুল্লি নির্মান করে। অর্থাৎ আজকের ধনী বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অতপ্রোতভাবে জড়িত।
চীন ও ভারতের মত দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের অর্থনীতির চাকাকে আরো বেগবান করার জন্য উন্নত দেশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিপদের সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও আরো অধিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ বিদ্যুতের অভাবে আমাদের দেশের অর্থনীতির নড়বড়ে চাকা প্রায় থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশ ঘণবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় বিপদের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। তারপরেও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সহকারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সুখের বিষয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার পাবনার রূপপুরে ৬০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে রাশিয়ার সহায়তায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পৃথিবীজুড়ে এখন নবায়নযোগ্য সৌরশক্তির ব্যবহারের প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। তবে তা এখনো সীমিত পর্যায়ে। সোলার এনার্জিকে সহজলভ্য করে এবং তা দিয়ে অধিক পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ভয়াবহ বিদ্যুৎ সমস্যাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য আপাতত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিয়ে কিছুটা হলেও কাজ চালিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
----------------------------------
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট, বিজ্ঞান বিশ্বকোষ, দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।