দিতে পারো একশ ফানুস এনে...আজন্ম সালজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই...
সিদ্ধার্থ এবং তাঁর প্রচারিত ধর্ম অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আমার সীমাহীন আগ্রহ। কোন প্যাগোডা বা বৌদ্ধ মন্দির পেলে সাধারনত না দেখে ছাড়িনা। তাদের চিত্রকলা দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে এবং প্রতিবার দেখার সময় একটা ডিএসএলয়ার ক্যামেরা খুবই মিস করি। যাই হোক, পরের দিন আমরা কাঠমান্ডু দর্শন শুরুই করলাম মন্দির দিয়ে। প্রথমেই বুদ্ধনাথ মন্দির।
কাঠমান্ডু শহর থেকে বেশখানিকটা দূরে। রাস্তা ঘাটের অবস্থা বেশী একটা ভালনা, খুবই অনাকর্ষনীয়, ধূলায় ভরা। তবে, দূরে এভারেস্ট গর্বের সাথে দাঁড়িয়ে। তাকালেই হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। এভারেস্টের চূড়া একমাত্র কাঠমান্ডু শহর থেকেই নাকি স্পষ্ট দেখা যায়।
এভারেস্টের একেবারে কাছাকাছি যাওয়ার জন্য ওখানে একটা স্পেশাল প্লেন আছে। ১৫০ ডলারের বিনিময়ে প্লেনে চেপে মোটামোটি কাছ থেকে স্বপ্নচূড়াকে দেখা সম্ভব। ১৮/২০ সিটের ছোট প্লেন। সমস্যা একটাই, নিরাপত্তা। আমরা যাওয়ার ঠিক ২/৩ দিন আগেই একটা ক্রাশ করেছিল, প্লেন গুলোর অবস্থা খুব বেশী ভালো নয়।
তাই আমরা দূর থেকে দেখেই সন্তষ্ট থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম!
বুদ্ধনাথ মন্দির।
বুদ্ধনাথ বা বোধনাথ মন্দির কাঠমান্ডুর অন্যতম বিশাল এবং পবিত্র জায়গা। ধপধপে সাদা মূল মন্দিরটি ঘিরে অসংখ্য উপাসনাগার এবং দোকান। পায়রা দিয়ে ভরা। একসাথে দল বেঁধে উড়ে বেরাচ্ছে এবং দর্শনার্থীরা দানা দিলে মারামারি করে খাচ্ছে।
বিশাল স্পীকারে গম্ভীর “ওম মণি পদ্মে ওম” সুরটি বাজছে। শুনলে আপনা আপনি মন শান্ত হয়ে আসে। চারিদিকে প্রেয়ার হুইলে সাজানো। ভিক্ষুরা মন্দিরের মূল কাঠামো প্রদক্ষিণ করছে আর প্রেয়ার হুইলগুলো ঘুরাচ্ছে। এগুলোকে বাংলায় “পাপ মোচন ঘন্টা” ও মনে হয় বলা যায়।
দার্জ়িলিং এর এক ভিক্ষু আমাকে জানিয়েছিল যে এই ঘন্টা ঘুরিয়ে সকলে পাপ স্বীকার করে, পবিত্র মনে তা করলে পাপ কাটা যায়।
ছোট ছোট প্রেয়ার হুইল দিয়ে ঘেরা মন্দির।
পবিত্র ঘন্টা, মন্দিরের বিপরীত পাশে।
উপাসনাগার।
মন্দিরের চূড়া যেখানে শুরু, সেখানে দুইটি বড় চোখ আঁকা।
নেপালের বেশীরভাগ মন্দিরেই সেটি রয়েছে। এটার ব্যখ্যা কি জানা নেই। মন্দিরটি যদি কেউ দৌড়েও দেখতে চান, তাহলেও কম করে ১ ঘন্টা সময় লাগার কথা। সময় স্বল্পতার কারনে আমাদের দেয়া হয়েছিল ৪৫ মিনিট। বলাই বাহুল্য আড়াই ঘন্টার আগে আমরা কেউই বের হতে পারিনি।
সেটার আরেকটা কারন মন্দির প্রাংগনের দোকান! রঙ্গিন দোকান গুলো দেখলে সাধ্য কার একবার ঢু না মারা? মুখোস গুলো চমৎকার, তবে কিনা দামও সেইরকম। সস্তা হচ্ছে পাশমিনা শাল এবং মেয়েদের জাঙ্ক জুয়েলারি। দেখা মাত্র মাথা গরম এবং কিনে ব্যাগ ভর্তি! যখন আমরা বেরোচ্ছি তখন মোটামোটি আমাদের সব মেয়েদের গলায় হরেক রকম মালা, আর ছেলেদের হাতে বিশাল ব্যাগ। ওম মণি পদ্মে ওম সুরটা আমাকে এতই পাগোল করল যে ওইটার সিডি না কিনলে জীবন বৃথা! কিন্তু দাম ৪৫০ রুপি। অনেক মুলোমুলি করেও ৪০০ রুপির কমে দেবে না।
বাংলাদেশে সিডি এত সস্তা যে মনেই থাকে না যে বাইরে এত দাম হতে পারে। রাগ করে তখন কিনলাম না বটে, কিন্তু সুর মাথা থেকে গেলো না! শেষকালে পোখরা গিয়ে ঠিকই কিনলাম আমি, সানোয়ার আর ক্রিস্টিনা শেয়ার করে, ২৫০ রুপিতে।
রঙিন দোকান।
পরবর্তী গন্তব্য বালাজী ওয়াটার গার্ডেন। ওয়াটার গার্ডেন নাম শুনেই আমরা ভাবলাম ওয়াটার পার্ক জাতীয় কিছু হবে।
সানোয়ারকে দেখলাম একটা এক্সট্রা প্যান্ট ভরে নিতে। গিয়ে তো তবদা খেয়ে গেলাম! ভাঙ্গাচোরা একটা পার্ক। দুই তিনটা সবুজ রঙের ডোবা, তার মাঝে বিভিন্ন আকৃতির ব্যাঙ। চার পাঁচটা গোদা বান্দর মহা আনন্দে ঘুরে বেরাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে দাঁত খিচাচ্ছে। এমনই খারাপ অবস্থা যে কোন জুটিও চোখে পড়লোনা।
থাকার মাঝে এক আছে কমলার গাছ। মনের দুঃখে কিছু কমলা চুরি করলুম। অবশ্য এমন টকের টক, খেতেও পারলাম না ঠিক করে। তবে কাঠমান্ডুতে এক ধরনের ছোট ছোট সবুজ কমলা পাওয়া যায় যেটা খেতে খুবই মজা!
বালাজী ওয়াটার গার্ডেন।
এরপর আমরা গেলাম সাউথ এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দির সম্ভুনাথ(swyambhunath) স্তুপাতে।
এটা মাঙ্কি টেম্পল নামেও সুপরিচিত। হাজার খানেক বান্দরের আবাসস্থল। এরা কাউকেই ভয় পায়না, উলটে তাদের ভয়েই সবাই অস্থির!ক্যামেরা পারলে জড়িয়ে রাখতে হয়, কোন প্যাকেট নেয়ার উপায় নেই। অনন্যা মাত্র কিছু মালা কিনে দাঁড়িয়েছিল, বান্দর বাবাজী এসে তো দিল টান! অনন্যাকে আমরা দেখলাম অনেক কাকুতি মিনতি করতে, “ভাই দেখ, কোন খাবার নাই, আমি তো মালা কিনছি, খুলে দেখ!”। আমাদের অবাক করে দিয়ে বানরটা ব্যাগ ফেলে দিয়ে গেল।
ডারউইন কে মনে হয়ে কোনভাবেই অবিশ্বাস করা ঠিক না!
সম্ভুনাথ টেম্পল
বানরের স্বর্গরাজ্য!!!
বুদ্ধনাথের মতই চূড়া তবে আরো অনেক উঁচু। পুরো কাঠমান্ডু শহর মন্দির হতে দেখা যায়, অপূর্ব দৃশ্য। মন্দিরে উঠতে হয় গাড়ি দিয়ে, তবে পাহাড়ের নিচ থেকেই প্রেয়ার হুইলে সাজানো শুরু। ভিক্ষুদের দেখলাম প্রদক্ষিন করতে এক অদ্ভুত উপায়। প্রথমে সাষ্ট্রাঙ্গ প্রণিপাত করছে, আবার দাঁড়িয়ে নমষ্কার করছে।
এভাবেই নাকি পুরো মন্দির চক্কর দেবে!কয়দিন যে লাগে এতে আল্লাহ মালুম। তবে যে কয়দিনই লাগুক, তারা নাকি শুধু তরল খাবে। অসংখ্য মূর্তি দিয়ে ঘেরা মূল মন্দির। কোন বাধা নিষেধ নেই মূল উপাসনাগারে ঢোকার ব্যাপারে। আমরা সবাই গিয়ে পবিত্র পানি মাথায় দিয়ে এলুম।
বাইরের Wish pool এ সবাই কয়েন ফেলে উইশ করছে দেখলাম, আমরা ফুল ফেলে করলুম। এই মন্দিরের প্রাঙ্গনও ভরা রঙিন দোকানে, তবে অনেক বেশী দাম। বরং মন্দিরের বাইরে দাম খানিক কম দেখলাম।
নগরকোটের রিসোর্টে সকলে যায় শুধু সূর্যাস্ত বা সূর্যদয় দেখতে। তবে আমরা কিনা দেখতে পারিনি।
৩৮ জন মিলে ক্যাচাল করলে যা হয় আরকি! হাউ মাউ করতে করতে রওনা দিতেই বিকাল ৫টা। নগরকোট শহর থেকে মোটামোটি দুই আড়াই ঘন্টার জার্নি। তবে আগের বার আমি গিয়েছিলাম রিসোর্টটাতে। পাহাড় থেকে নীচে তাকালে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। দেবদারু সহ অনেক নাম না জানা গাছের সমারহ, মেঘ এসে যেন ছুঁইয়ে দিচ্ছে আলতো করে।
পাহাড়ের অনেক উঁচুতে ক্লাব হিমালয় নামে একটি ক্লাব আছে। বারবিকিউ করার জায়গা আছে আলাদা। ১০গুন দাম বেশী এমন একটা বড়সড় মুখোসের দোকান আছে। দাম বেশী ঘটনা সত্য, কিন্তু মুখোসের এত সুন্দর কালেকশন আর কোথাও দেখিনি। সর্বত্র ফুল দিয়ে সাজানো।
সারাদিন কাটানোর জন্য অসাধারন একটি জায়গা। তবে সূর্যাস্তের জন্য এখনো মন পুড়ে।
ফেলুদার যত কান্ড কাঠমান্ডুতে যে দুইটা জায়গা বারবার বলা আছে, তা না দেখে কাঠমান্ডু ছেড়ে যাই কি করে? তার মাঝে হোটেল লুম্বিনী অবশ্য খুঁজে পাইনি, পশুপতি মন্দিরটা দেখেছি। অনেক খানি জায়গা নিয়ে। ভিতরে পাহাড়সম একটা মূর্তি আছে, সকলে পূজা করছে।
কড়াকড়ি ভাবে ক্যামেরা নিষিদ্ধ থাকায় কোন ছবিই তুলতে পারিনি। আর অধিকাংশ মন্দিরের মত এখানেও কবুতরের রাজত্ব। ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে আর দানা খাচ্ছে। মাঝে গিয়ে হাতে দানা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কেউ কেউ এসে হাত থেকেও খাচ্ছে, এমনই নির্ভিক। দরবার স্কয়ারের এত নাম শুনে গিয়ে দেখি কিছু দোকান ছাড়া আর তেমন কিছুই নাই, পুরাই হতাশ।
পশুপতি মন্দিরের পার্শ্বদরজা।
তৃতীয় নয়ন!
রাজার বাড়ী।
মন্তব্য নিস্প্রয়জন!
এরপর গাড়ি নিয়ে শহরে খানিক চক্কর দিলাম। রাজার প্রাসাদের সামনে দাঁড়ানো নিষেধ, তাই গাড়ি থেকেই দেখতে হল। মার্কেট পর্বে বলার তেমন কিছু নেই।
কেনার মত জিনিস শুধু তিনটা, পাশমিনা শাল, মুখোস আর বাদাম। কেশিউ নাট খুবই সস্তা। প্রথমবার আমি গিয়েছিলাম দূর্গা পূজার সময়। নেপালের রাজার নিয়ম হচ্ছে, সারা বছর যে যাই করুক, দূর্গাপূজার সময় প্রত্যেককে নতুন কাপড় দিতে হবে। তাই এসময় যেমন সেল থাকে, তেমন বোনাস দেয়।
নেপালের মানুষজন যথেষ্টই সাধাসিধা, তবে অনেক জেদী। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোরখা সম্প্রদায়ের কীর্তিগাথা অনেক জায়গাতেই খোদাই করা আছে। কাঠমান্ডু ঘুরে মনে হয়েছে ভারতেরই একটা অংগরাজ্য! ভারতের কারেন্সি দিলে এরা বেশী খুশী। নেপালি রুপির চেয়ে ইন্ডিয়ান রুপি চলে বেশী। লেস আর কিটক্যাটের আধিক্যে নেপালের কোন প্রোডাক্টই নেই।
সকলেই হিন্দীতে সাবলীল। যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশী সুবিধার না, বিদ্যুতও তথৈবচ। পুরো কাঠমান্ডুতে মেডিকেল কলেজ মাত্র একটি। যদিও সেটা ২/৩ টা পাহাড়ের উপরে এবং দেখার মত একটি জায়গা, তারপরও স্বাস্থ্যসেবা হতাশাজনক। পুরো শহর ছেয়ে আছে বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজের বিজ্ঞাপনে।
মিথ্যা বলব না, দেখে খানিক গর্বই হল। সত্যি বলতে কি, নেপাল ঘুরে এসে টের পেয়েছি যে বাংলাদেশে আসলে আমরা অনেক ভালো আছি, শুধু যদি আমরা মানুষ হিসেবে আরেকটু সহনশীল হতাম!!! সেদিনই ছিল কাঠমান্ডুতে শেষদিন, পরের দিন রওনা দিব পোখারার উদ্দেশ্যে।
হিমালয় কন্যা নেপাল - কাঠমান্ডুর পথে (প্রথম পর্ব)
হিমালয় কন্যা নেপাল – মনোকামনা ও সারেংকোট (তৃতীয় পর্ব)
হিমালয় কন্যা নেপাল – পোখারা (শেষ পর্ব)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।