আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডা. প্রাণ গোপালের বিদেশে চিকিৎসা ও আম পাবলিকের প্রাণ নিয়ে তেলেসমাতি খেল

নাজমুল ইসলাম মকবুল

ডা. প্রাণ গোপালের বিদেশে চিকিৎসা ও আম পাবলিকের প্রাণ নিয়ে তেলেসমাতি খেল নাজমুল ইসলাম মকবুল মানুষের ৫টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র এমনকি অপারেশনের সময় রুগীর পেটের ভেতর কেচি রেখে সেলাই দেওয়া, ইন্টার্নী কর্তৃক রুগী ও আত্মীয় স্বজনদের বেধড়ক পিটুনি থেকে শুরু করে নানান অনিয়মের ফিরিস্তি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে এবং হচ্ছে। কেয়ামত তক এর উত্তরনের সম্ভাবনা তেমন একটা দেখা যাচ্ছেনা। গত ২৪ মার্চের আমার দেশের প্রথম পাতায় ২ কলামের বাক্সবন্দি সংবাদের শিরোনাম ‘‘ভিসি ডা. প্রাণ গোপালের আস্থা নেই বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের ওপর। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন’’।

সংবাদটি মোটেও অবাক হওয়ার নয়। আমাদের এই সোনার দেশে স্বাস্থ্যসেবার নামে আজব রঙের তেলেসমাতি খেল দেখে আফসুস করা ছাড়া যেন কোন উপায়ও নেই। তীব্র প্রতিদ্ধন্ধিতাপুর্ণ পরীার মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদেরই মেডিকেলে পড়ার সৌভাগ্য হয়। কয়েক বছর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা ডিগ্রি নিয়ে ডাক্তারসাব পদবী লাভ করেন মানুষ তথা মানবতার সেবার জন্য। একজন ডাক্তার গড়তে সরকারেরও বিপুল পরিমাণ খরছ হয়।

তবে নিজের মেধা ও অভিভাবকের যে বিপুল পরিমান খরছ হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। গত ক’দিন পূর্বে সারাদেশে বেশ কিছু ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মফস্বলে যেতে নাক সিটকান বলে জানা যায়। কারন হিসেবে জানা যায়, শহরে কাড়ি কাড়ি মাল কামানোর রাস্তা একেবারে ফকফকা। মফস্বলে গেলে আন্ধার আন্ধার লাগে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয় অবহিত হয়ে স¤প্রতি এক সভায় ভাষনে ােভের সাথে বলেন, ‘‘মফস্বলে গিয়ে চাকরি করতে না চাইলে চাকরি ছেড়ে দিন’’। জাতির সেরা মেধাবীদের আচার আচরন হাল সমাচার কাজ কর্ম যদি সেরকম সেরা না হয়ে বিপরিত হয় তখন রুগীর রোগ আরও বাড়ে, হতাশাও বাড়তে থাকে। আর এই হতাশা গোটা জাতিকেই কুরে কুরে খায়। গত ক’বছর পুর্বে ঢাকার মালিবাগের এক মিছিলে মতাসীন এক ডাক্তার নেতার মিছিলে প্রকাশ্যে পিস্তল দেখেও জাতি অবাক হয়নি। যেখানে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে কয়েকজনের জানও অপারেশন করা হয়েছিল, যা সে সময়ের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছবিসহ বড় বড় হরফে প্রকাশিত হয়েছিল।

সেই ডাক্তার বাবুর নামের সাথে মিল ছিল আমাদের সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার পদে গত ক’বছর পুর্বে দায়িত্বরত এক ডাক্তার মহাশয়ের। এক রাতে আমার ছোট ভাই পেটের ব্যথায় লুটোপুটি খাচ্ছিল। গভীর রাতে কোথাও ডাক্তার পাবার সম্ভাবনা নেই বিধায় সারারাত পরিবারের সকলেই নির্ঘুম ও উদ্বেগ উৎকন্ঠায় কাটিয়ে বাদ ফজর গাড়িযোগে নিয়ে গেলাম বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কারন এতো ভোরে কিনিক বা চেম্বারগুলোতে ডাক্তার পাবার সম্ভাবনা নেই। ডাক্তার বাবু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেরই একটি কে থাকতেন এবং শয়নকরে পাশের কটিকে প্রাইভেট চেম্বার হিসেবে ব্যবহার করতেন।

সেই রুমে রুগী নিয়ে গিয়ে ডাক্তার বাবুর মোবাইলে ফোন দিলাম। কাতর কন্ঠে বললাম ডাক্তার সাহেব আপনার চেম্বারে আমার ছোট শিশু ভাইটিকে নিয়ে এসেছি। সারারাত পেটের ব্যথায় সে লুটোপুটি ও মাত্রাতিরিক্ত কান্নাকাটি করছে। দয়া করে আপনি একটু এসে দেখেন। উত্তরে তিনি বললেন আমি এখন কাপড় ধুইতেছি।

দেরী হবে। ফোনে অনেক অনুনয় বিনয় করে বলার পরও কাপড় ধোয়া শেষ না করে আসতে পারবোনা বলেই লাইন কেটে দিলেন। আমার ছোট শিশু ভাইটি ব্যথায় লুটোপুটি খাচ্ছে ও উচ্চস্বরে কাঁদছে। তার কান্না দেখে সাথে থাকা আমার আম্মাও কাঁদছেন। ওদিকে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখা পাশের রুমের বাথরুমে ডাক্তার মশাইর কাপড় কাচার শব্দও শুনা যাচ্ছে।

অনুনয় বিনয়ের পর নিরুপায় হয়ে দরজায় উচ্চ স্বরে নক করেও ডাকাডাকি করছি। মোবাইলেও কল দিচ্ছি। বার বার রিং হচ্ছে, রিংয়ের শব্দ পাশের রুম থেকে আমরাও শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু মোবাইলও রিসিভ করছেননা। এতো ডাকাডাকিতে উনার পাষান হৃদয় একটুও গলছেনা। পরবর্তীতে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পর কাপড় কাঁচা শেষ করে মাঝখানের দরজা খুলে তশরিফ মুবারক আনলেন ও রুগী দেখলেন এবং ফিও নিলেন।

আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ না করে পারছিনা। বছর দুয়েক পূর্বে আমার পিতা যিনি ৭১ এর রনাঙ্গনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাঁর কান ও চুয়াল বরাবর বড় একটি ফোড়া হয়েছিল। কয়েকদিন পর এক রাতে ব্যথা বেড়ে সারা মুখমন্ডল ফুলে গেলে সারারাত ব্যথায় চিৎকার চেচামেচির পর বাদ ফজর অন্য কোন কিনিক বা চেম্বারে ডাক্তার পাওয়ার সম্ভানা নেই বিধায় সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে নিয়ে গেলাম। সেখানে কর্তব্যরতরা বললেন রুগীতো হাটতে পারছেন। এমন রুগীকে ইমার্জেন্সীতে ভর্তি করা যাবেনা।

আপনারা ঘন্টা তিনেক পরে বহির্বিভাগে দেখান। ব্যথার জ্বালায় রুগী কাতরাতে থাকায় সেখানে বিশ্রামের কোন সুযোগ না পেয়ে পার্শ্ববর্তী একটি আবাসিক হোটেলে গিয়ে উঠলাম। সেখান থেকে নির্দিষ্ট সময়ে বহির্বিভাগে যাওয়ার পর তারা ভর্তি করাতো দুরের কথা এই ঘাট সেই ঘাট বলে চক্কর দেওয়াতে শুরু করলে তিনি নিরুপায় হয়ে শহরের একটি কিনিকে গিয়ে ভর্তি হলে তারা জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করেন এবং বলেন এই মুহুর্তে আপনার অপারেশন না করলে ফোড়াটি ফেটে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। এমনকি জীবন নিয়েও শংকা সৃষ্টি হতো। পরবর্তীতে ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধার ােভ শিরোনামে কয়েকটি পত্রিকায়ও সংবাদটি প্রকাশিত হয়।

এই হলো সরকারী হাসপাতালে আমার স্বশরীরে প্রত্য করা মাত্র দুটি সেবার নমুনা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আমাদের দেশের সিংহভাগ ডাক্তাররা গুরুত্বপুর্ন শহরে চেম্বার খুলে বসেন এবং সেখানে রুগী প্রতি মাত্র কয়েক মিনিট সময় নিয়ে ভিজিট নেন ৪/৫ শত টাকা। সেসাথে লিখে দেন বিভিন্ন ধরনের টেষ্ট এবং সাথে ধরিয়ে দেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্ড বা লিফলেট। যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পান সেটাতেই টেস্ট করাতে হবে। অন্যটাতে গেলে সেই রিপোর্ট গ্রাহণযোগ্য নয়।

মজার বিষয় হচ্ছে প্রতিটি টেস্টের জন্য আলাদা আলাদা কমিশন কড়ায় গন্ডায় হিসেব করে ডাক্তার বাবুকে দেয়া হয়। এজন্য অনেকে কমিশন বাড়াতে অপ্রয়োজনীয় টেস্টে পাঠাতেও বিবেকে একটুও বাধেনা। প্রায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও চলে জালিয়াতি। ডাক্তারের শিল স্বার রিপোর্টে আগেই দিয়ে রাখারও সংবাদ ইতোমধ্যে আমরা পত্র পত্রিকায় দেখেছি। আমার গ্রামের এক তরুন কলেজ প্রভাষক ঢাকায় একই টেস্ট দুই জায়গায় করানোর পর দুই স্থানের রিপোর্ট আসে দুই ধরনের।

রিপোর্টগুলি নিয়ে ভারতে যাবার পর ভারতের ডাক্তার তা দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন, একই রুগীর একই ধরনের টেস্টের রেজাল্ট কখনো দুই ধরনের হতে পারেনা। রেজাল্ট বিভ্রাট ও ভুল চিকিৎসায় ঢাকায় সময় পেনের ফলে যা হবার তাই হয়ে গেল প্রভাষক সাহেবের ভাগ্যে। অগণিত ছাত্র শিককে কাঁদিয়ে তরুন বয়সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন তিনি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেক ডাক্তার বাবু আবার তিলকে তাল বানিয়ে ভয় ভীতি দেখিয়ে রুগীকে পাঠিয়ে দেন নিজের কিনিকে টাকা কামানোর ধান্দায়। এজন্য দেশের গুরুত্বপুর্ন শহরগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো কিনিক গজিয়ে উঠেছে ও চুটিয়ে ব্যবসাও চলছে।

এছাড়া কিনিকে রুগি বাগিয়ে দেওয়ার জন্য নাকি দালালও নিয়োগ দেয়া হয়। আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে প্রায় সকল ডাক্তারের চেম্বারে ব্যাগ হাতে ঔষধ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভদের লম্বা লাইন থাকে। তারা ডাক্তার বাবুর সাথে একান্তে স্বাাত করে নিজ নিজ কোম্পানীর ঔষধ লেখার জন্য নানা ধরনের অফার দেন। টার্গেট ফিলাপ হলে কোম্পানীর প থেকে চেম্বারে ও বাসায় এসি, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, উন্নতমানের ফার্নিচার ইত্যাদি উপঢৌকন দেয়া হয়। এছাড়া ফ্রি ঔষধপাতিসহ নগদ উপহার সম্পগ্রীতো আছেই।

তাই অনেক ডাক্তার টার্গেট ফিলাপের ধান্দায় অপ্রয়োজনীয় ঔষধও স্লিপে লিখে দিতে একটুও বিবেকে বাধেনা। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের ঔষধপাতি কিনা দুরে থাক ডাক্তার বাবুর দর্শন ফি দিতেই মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাড়ায়। প্রাইভেট চেম্বার কিনিক টেস্টের কমিশন ও ঔষধের কমিশন এত্তোসব লাভ বাদ দিয়ে সরকারী হাসপাতালে মন প্রাণ উজাড় করে চিকিৎসা সেবা দিলে লাভের গুড় পিপড়ায় খাবে তাই লাভের অংক যদ্দুর সম্ভব বাড়ানো যায় ততই নিজের শান্তি। দেশের মানুষ গোল্লায় যাক তাতে কিছু যায় আসেনা। সরকারী মোটা অংকের বেতন ভাতা এবং পেনশনসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা এসব যেন বোনাস অথবা উপরী।

মনে হয় এগুলো দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা নয় বরং তা আকাশ থেকে উড়ে উড়ে আসে। কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করলেও সরকারকে টেক্স দেবার প্রবণতা খুবই নগণ্য বলে জানা যায়। সারাদেশে সরকারী চাকুরিজিবী ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস কিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আয় ও কমিশন থেকে যে অর্থ উপার্জন করছেন এর অর্ধেকও যদি সরকারকে দেয়া হতো তাহলে সরকারের আগ্রহী মন্ত্রী এমপিদেরকে অন্তত একটি করে প্রাইভেট বিমান কিনে দেয়া সম্ভব হতো। তবে এত্তোসব মহাপুরুষদের ভিড়েও আমাদের দেশে হাতে গোনা কিছু ডাক্তার আছেন যারা পাহাড়সম সম্পদ অর্জনের ধান্দায় না লেগে নিঃস্বার্থভাবে জনগনকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। দেশের জন্য মানবতার জন্য চালিয়ে যাচ্ছেন কঠোর পরিশ্রম।

তাদের আচার ব্যবহার ও সেবার ধরন দেখলে বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা জানানো এবং তাদের জন্য প্রাণখুলে দোয়া করতে ইচ্ছে হয়। অন্তরাত্মা শান্তি হয়ে যায়। ডাক্তারের বাচন ভঙ্গি ও একটু আশার বাণীতে অনেক রুগীর অর্ধেক রোগ সেরে যায়। তবে এ মহৎ ব্যক্তিদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য এবং রক্তলিপ্সুদের ভিড়ে তারা যেন কোনঠাসা হয়েই জিন্দেগী গুজার করে যাচ্ছেন।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।