পরিবর্তনে বিশ্বাস করি।
বিগত দুই বছর ধরেই ইউরোপিয় ইউনিয়নে (ইইউ) তুরস্কের সদস্যপদ প্রাপ্তির সাথে ইসলামের সম্পর্ক একটি আলোচনার বিষয়। ইসলাম ইইউ এর সদস্যপদ প্রাপ্তির েক্ষত্রে একটি বিবেচ্য বিষয় কিনা এ প্রশ্নটি মূলত আলোচনায় এসেছে ৮০’র দশকের শেষের দিকে যখন ইউরোপিয় ইউনিয়নে তুরস্কের পূর্ণ সদস্যপদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরম্ন হয়। এই রচনাটিতে তুরস্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইসলামের ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে।
তুরস্ক- ইইউ সম্পর্ক এমন একটি প্রক্রিয়া যা প্রায় ৪৬ বছর ধরে চলে আসছে।
তুরস্ক সর্বপ্রথম ১৯৫৯ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটির (ইসি) কাছে সদস্যপদের জন্য আবেদন করে এবং ১৯৬৩ সালে ইসির সহযোগীতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যা ‘আঙ্কারা চুক্তি’ নামে পরিচিত। চুক্তিতে বলা হয় তুরস্ককে ইসির সদস্য হতে হলে তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে। প্রতিটি ধাপের উত্তরনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যসমূহ সম্পাদনের পাশাপাশি নতুন দিপাক্ষক চুক্তির প্রয়োজন ছিল। তুরস্ক ১৯৭০ সালে একটি অতিরিক্ত খসড়া চুক্তি সহ প্রথম ধাপ অতিক্রম করে যা ইইউ’র কাস্টম্স ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে দেয়। ১৯৯৫ সালের মধ্যে তুরস্ক সদস্যপদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধাপ সমূহ পূর্ণ করে।
কাস্টম্স ইউনিয়নে যোগ দেবার জন্য তুরস্ককে অনেক বিশেষ শর্তের সাথেই মানিয়ে নিতে হয়েছিল অর্থাৎ ইউরোপিয় ইউনিয়নের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য আলোচনার যোগ্য হবার পূবেই তুরস্ক নিজেকে ইইউ’র সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে।
কাগজে-কলমে বিষয়টি অনেক সহজ মনে হলেও বাসত্মবে তা ছিলনা বরং পথে যথেষ্ট পরিমানেই চ্যালেঞ্জ ছিল। যেমন, ১৯৬০ এবং ১৯৮০ সালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান, ইসির চাহিদার সাথে তুর্কী সরকারের মতানৈক্য, ইত্যাদি দুই পক্ষর মধ্যকার সম্পর্ককে অনেকটাই শীতল করেছিল। সে যাই হোক না কেন, তুরস্ক- ইইউ সম্পর্কের গভীরে যাবার চেয়ে বরং এর সাথে ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা বেশী গুরম্নত্বপূর্ণ।
১৯৮০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ওজাল সরকার ক্ষমতায় আসলে তুরস্ক-ইইউ সম্পর্কের বরফ গলতে শুরম্ন করে।
এ সরকার ১৯৮৭ সালে পূর্ণ সদস্যপদের আবেদন কওে যা ১৯৮৯ সালে ইসি প্রত্যাক্ষন করে। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, সামান্য একটি প্রসত্মাব প্রত্যাÿ্যান করতে ইসির ২ বছর সময় লেগেছে। উপরন্তু এ সময়েই প্রথম তুরস্কের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভিন্নতাকে পূর্ণ সদস্যপদ প্রাপ্তির পথে বাধা হিসেবে দেখানো হয়।
এরপরও তুরস্ক-ইইউ সম্পর্ক আঙ্কারা চুক্তি অনুযায়ী চলতে থাকে। ১৯৯৫ সালে কাস্টম্স ইউনিয়নে অমত্মর্ভূক্তির পর তূর্কি সরকার ও জনগণের মধ্যে ইউরোপিয় ইউনিয়নে অমত্মর্ভূক্তির আশা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়।
কিন্তু ১৯৯৭ সালের লুক্সেমবার্গ সম্মেলন তাদের জন্য একটি দু:সংবাদ বয়ে আনে। এই সম্মেলনে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ‘এজেন্ডা ২০০০’ নামে তাদের নতুন সম্প্রসারন প্যাকেজ ঘোষনা করে। এই প্যাকেজের আওতায় প্রায় সকল পূর্ব ইউরোপিয় প্রাক্তন কমিউনিস্ট দেশসমূহকে সদস্য হিসেবে অমত্মর্ভূক্তির ঘোষনা দেয়া হলেও তুরস্ককে বাদ দেয়া হয়। তুরস্ক এরপরও ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে এবং ১৯৯৯ সালে হেলসিঙ্কি সম্মেলনে তুরস্ককে ইইউ সদস্যপদ পদপ্রার্থী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যদিও কোপেনহেগেন সম্মেলনে ঘোষিত মানদন্ড পূরণের পূর্ব পর্যমত্ম এ আলোচনা শুরম্ন করা হয়নি।
২০০৪ সালে কোপেনহেগেন মানদন্ড পূরণের পর আলোচনা শুরম্ন করা হয়। কমিশন আলোচনার জন্য তিন সত্মম্ভ বিশিষ্ট একটি কৌশলপত্র সুপারিশ করে: প্রথমত, তুরস্ককে পূর্নগঠনের ব্যপারে সহায়তা করা, বিশেষত রাজনৈতিক পুর্নগঠন। এছাড়াও স্বাধীনতা, গনতন্ত্র এবং মানবাধিকারের যেকোন ধরনের লংঘনের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, আলোচনার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরী করা। তৃতীয়ত, তুরস্ক এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নভূক্ত দেশসমূহের মাঝে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনা জোড়দার করা।
সুশীল সমাজের ভূমিকাকে এ ব্যপারে অত্যমত্ম গুরম্নত্ব দেয়া হয়।
কোপেনহেগেন মানদন্ড বাসত্মবায়নে সফলতার জন্য ইইউ তুরস্ককে সদস্য পদপ্রার্থী হিসেবে আলোচনার জন্য বিবেচনা করে, তবে মজার বিষয় হল যে, কমিশন তাদের রিপোর্টে ধর্মকে একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ঘোষণা করে এবং এই বিষয়ে আরো কাজ করার সুপারিশ করে। এখানে স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্ন উঠে যে, ৪৬ বছরের পারস্পারিক সম্পর্কের পর এতদিনে ধর্ম কেন একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হল?
তুরস্ক-ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সম্পর্কেও ক্ষত্রে মূল দুইটি প্রভাবক হল ধর্ম এবং স্নায়ুযুদ্ধ শেষে তৈরি হওয়া ইউরোপিয়বাদ। সেই ইউরোপিয় কোল এন্ড স্টীল কমিউনিটি থেকে শুরম্ন করে ইউরোপিয় কমিউনিটির লক্ষ ছিল অর্থনীতি। স্নায়ুযুদ্ধকালীন দ্বিমেরূকেন্দ্রিক বিশ্বে একটি কমিউনিটিকে কখনই সুপার পাওয়ার হবার আশা করা হত না বরং অর্থনৈতিক উন্নতির সোপান হিসেবেই বিবেচনা করা হত।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই ধারণা ভেঙ্গে যায়। যদিও স্নায়ুযুদ্ধকালে ইউরোপিয় কমিউনিটি ওয়েষ্টার্ন বস্নকের অংশই ছিল তবে এর নজর রাজনীতি নয় বরং ছিল অর্থনীতির দিকেই। ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতনের পর অনেকেই বুঝতে পারে স্নায়ুযুদ্ধের সময় যে কৃত্রিম সীমান তৈরি হয়েছিল তার পরিবর্তন আসছে। পরিবর্তন এতটাই প্রকট হয়ে উঠে যে, নতুন সৃষ্ট পরিবেশে ইসিকে একটি বৃহৎ ভূমিকা নিতে হয় যার জন্য ইসি নিজেও ঠিক প্রস্ত্তত ছিল না। ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সবকিছু আর আগের মত চলবে না।
ইসি নতুন সৃষ্ট পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে। একইসাথে এটি আরো বৃহত্তরভাবে সংহতিসাধনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৯২ সালে ম্যাসট্রিক্টস চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপিয় কমিউনিটি তার ১২ জন সদস্য নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে রূপলাভ করে।
স্নায়ুযুদ্ধের পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। বিশেষত প্রাক্তন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হবার প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করে ।
এর ফলে নতুন সদস্যদের প্রতি ইইউ এর চাহিদাও বেড়ে যায় যা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ন হলেও পূর্বের তূলনায অনেকটাই বৈষম্যমূলক। অন্যভাষায় বলা যায়, বাজার নীতি: পন্যের চাহিদা বাড়লে দামও বেড়ে যায়।
ইউরোপিয় পরিচয়ের ক্ষত্রে দুটি বিষয় মনে রাখা দরকার। প্রথমত, ইউরোপ একটি রাজনৈতিক একক এবং দ্বিতীয়ত, ইউরোপ একটি জনসংখ্যার সমষ্টি। ইউরোপিয় জনগন ইইউ এর ব্যাপাওে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মত পোষন করে।
স্মিথ এর মতে, “EU is fundamentally different from something that is part of a national culture. It is a part of global culture therefore it is affectively neutral”
এই স্বীকারোত্তি আমাদের একটি দুষ্টচক্রে ফেলে দেয়। একটি উচ্চমাপের পরিচয় কি তৈরি করা সম্ভব যা কোনভাবে আমারই অংশ কিন্তু ঠিক আমি নই? আবার আমি ঠিকই নিজেকে এর সাথে যুক্ত মনে করি!
ইউরোপে জাতিয়তাবোধ একটি বড় বিষয়। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যগতভাবেই ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ বিভক্ত। তাদের অনুভূতি ও চিমত্মাভাবনার মৌলিক ভিন্নতার কারনেও তারা স্বকীয়। কিন্তু ইউরোপীয় পরিচয়ের বিষয়টি এসবের উর্দ্বে।
এটি আরো বৃহৎ একটি একতার অনুভূতি যেখানে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখেও এর অংশ হওয়া যায়। এখন একটি প্রশ্ন উঠে যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিজেকে কোন অবস্থায় দেখতে চায়? Fuat keyman এক বিশেস্নষনে দুটি পথ দেখিয়েছেন যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অনুসরন করতে পারে। তার মতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে ‘নতুন ইউরোপ’ এবং ‘সাংস্কৃতিক ইউরোপ’ থেকে যে কোন একটি বেছে নিতে হবে। নতুন ইউরোপ হল একটি বৃহত্তর ইউরোপ যার রাজনৈতিক অসিত্মত্ব রয়েছে যা আধুনিক গনতন্ত্র ও আমত্মর্জাতিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ইউরোপ হল এমন একটি একক যাতে অনেক সীমানা এবং দেয়াল রয়েছে যা অংকিত হয়েছে সংস্কৃতি ও ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী।
তুরস্কের সদস্যপদের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে এই পথেই ভাবা উচিত। তবে অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে দুই পথের কোনটিই একটি অন্যটির চেয়ে উত্তম নয়। এটি বেছে নেয়ার ব্যপার, আর এই বেছে নেয়ার ক্ষত্রে সবচেয়ে গুরম্নত্ব দেয়া উচিত দ্বিপাক্ষক সম্পর্ককে। তাই বলতে হয়, তুরস্কের সদস্যপদের জন্য তুরস্কের পরিচয় গুরত্বপূর্ন নয় বরং গুরত্বপূর্ন হল যে ইইউ এতে আগ্রহী কিনা। ইউরোপীয় পরিচয় এবং কিভাবে ইউরোপ এটিকে সজ্ঞায়িত করে তা অবশ্যই বিবেচ্য।
তুরস্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইসলামের ত্রিমুখী সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার জন্য তুরস্কের সেক্যুলারিজম এবং ইসলামের প্রতি তাদের অবস্থানও যাচাই করা গুরম্নত্বপূর্ণ।
সেক্যুলারিজম শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ স্যেকুলিম থেকে যার অর্থ ‘‘অনাধ্যাতিক পৃথিবী’’। অর্থাৎ সেক্যুলারিজম এর শাব্দিক প্রতিশব্দ হতে পারে ‘‘পার্থিববাদ’’। ১৫৪০ সালে রির্ফমেশনের পূর্বে চার্চ ধর্মীয় ভাবে তো বটেই এমনকি অনেক ক্ষত্রে রাজনৈতিক ভাবেও রাষ্ট্রের উর্ধ্বে অবস্থান করত। পার্থিব বিষয়েও ধর্মের প্রভাব ছিল লক্ষনীয়।
এই অর্থে স্যেকুলারাইজেশন অর্থ কতৃত্বেও আধ্যাত্মিক রূপ থেকে পার্থিব রূপে স্থানামত্মর। যাই হোক, খ্রিশ্চিয়ান ধর্মে এই পরিবর্তন একদমই সহজ ছিল না। রাষ্ট্রের উপর চার্চের অবস্থান খ্রীষ্ট ধর্মের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। খ্রিশ্চিয়ান চার্চের রিফরমেশন ছিল একটি বিশেষ মুহূর্ত যা সেক্যুলারিজমের প্রচলন ঘাটায় এবং চার্চের সার্বজনীন প্রাধান্যতা অস্বীকার করে।
অন্যদিকে ইসলামে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আলাদা কোন স্বীকৃতি নেই।
ধর্ম এবং রাষ্ট্র উভয়কে ইসলামে একিভূত করা হয়েছে। তাই মুসলমান সমাজে মনে করা হয় সেক্যুলারিজমের চর্চা অপ্রসঙ্গিক। খ্রীষ্ট ধর্মে রাষ্ট্র ও ধর্মের অবস্থান পাশাপাশি যেখানে ইসলাম ধর্মে একটির অবস্থান অন্যটির ভিতরে। উভয় ক্ষেত্রেই ধম,র্ প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র অথবা উভয়ের জন্য সেক্যুালার সমাজ কতৃক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সংষ্কৃতিক সংগঠনের সাথে সহাবস্থান কষ্টকর। সহজ ভাবে বলা যায়, সেক্যুলারিজমের ধারনাটি উভয়ের জন্যই গ্রহন করা কষ্টকর।
যদিও মনে হতে পারে যে, খ্রীষ্টান ধর্ম রির্ফমেশনের মাধ্যমে। সেক্যুরারইজড হয়েছে। কিন্তু বর্তমানেও অনেক খ্রীষ্টান সমাজে চার্চ কে রাষ্ট্র ও সরকারের চেয়ে প্রভাবশালী ভাবা হয়। ইসলামের ক্ষেত্রে সমস্যা হল এই যে এটি প্রতিষ্ঠানিক ভাবে রির্ফমেশনের মত কোন সংস্কারের মধ্যদিয়ে যায়নি। ইসলাম একটি জীবন বিধান এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শাষন প্রক্রিয়া পরিচালনা সম্ভব।
এবং একই সাথে বলা যায় একে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করাও সম্ভব। রাষ্ট্র ও ধর্মের বিরোধ সকল ধর্মেই বিদ্যমান। তবে মূলত এ বিরোধ ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের নয় বরং ধর্ম প্রয়োগকারী, প্রচলিত ধারা, ধর্মীয় কতৃত্ব, ধর্মীয় আইন এবং পরিবর্তনের শক্তির সাথে। অটোমান উত্তরাধিকার এবং খলিফত ছিল নতুন প্রতিষ্ঠিত তুরষ্ক রাষ্ট্রের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর অন্যতম প্রধান কারণ। তুর্কি প্রজাতন্ত্র গঠনের সময় মূল লক্ষ্য ছিল গনতন্ত্র ও আইনের শাসনের একটি মডেল তৈরী করা যাতে ইসলামিক আইনের অসিত্মত্ব ছিল।
যদিও এটি একটি বড় ধাপ যেহেতু এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন মুসলিম সমাজের সংষ্কার আন্দোলনের মত কিছুর সূচনা করতে পারত। তুরষ্কের অধিকাংশ জনগনই মুসলমান তার মানে কি ই যে তূর্কী সরকার ইসলাম পন্থী? তাদের কাজ কিন্তু তা কখনোই বলেনি।
কেমালিষ্ট রিফর্ম এবং প্রজাতন্ত্র গঠন মূলত ছয়টি ধারনার উপর ভিত্তি করে হয়েছিল। প্রজাতন্ত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ, বিপ্লববাদ, জনবাদ, রাষ্ট্রবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা সেক্যুলারিজম । সেক্যুলারিজম ছিল অন্যতম মূল ধারনা কারণ কেমালিষ্টরা পুরো সমাজকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিল।
আর সেই সমাজ ছিল এমন একটি ব্যবস্থার অধিনে যার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সমসত্ম মুসলিম বিশ্বের খলিফা। কেমালিষ্ট প্রজাতন্ত্রীরা সর্বপ্রথম যে বড় পদক্ষেপটি নেয তা হল সেক্যুলারিজমের নামে সালতানাতের বিলুপ্তি। এটি করার ফলে রাজনৈতিক কতৃত্ব বা সালতানাত ধর্ম থেকে পৃথক হয় । এরপর গনতন্ত্রের আগমনের সাথে সাথে স্বৈরতান্ত্রিক সালতানাত ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু খলিফা পদটি আরো কিছু দিন বিদ্যমান ছিল।
কারণ জনমত তখনও এর বিলুপ্তির পক্ষে ছিল না এমনকি একই কারণে ১৯২১ সালে যখন তুরস্কের প্রথম সংবিধান লেখা হয় তখন ইসরামকেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে দেখানো হয়।
সংস্কার আন্দোলন গতি পেলে প্রথমেই খলিফত প্রথার বিলুপ্তি ঘটানো হয়। প্রকৃতপক্ষে খলিফতের বিলুপ্তির মাধ্যমে তুরষ্ককে ধর্ম নিরপেক্ষ করাই নয় বরং আরও বড় অর্থ রয়েছে। & খলিফা ছিলেন পুরো মুসলিম বিশ্বেও অধিকর্তা, যখন তুরষ্কে খলিফা প্রথা পরিবর্তিত হল, সাথে সাথে সমগ্র মুসলিমবিশ্বেও একটি পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যায়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের কাঠামোতে পুর্নবিন্যাস ঘটে।
পরে তূর্কী প্রজাতন্ত্রের সংবিধান হতে ধর্ম সংক্রামত্ম অনুচ্ছেদটি অপসারন করা হয় এবং ১৯৩৭ সালে সেক্যুলারিজমকে সংবিধানের মূল নীতির সাথে যুক্ত করা হয়। যদিও সময়ের সাথে সাথেই পরিবর্তনের পথ রচিত হয়েছে এবং পূবের ঘটনা সমুহের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ধারা ভাল ভাবেই উপলব্ধি করা যায। তারপরও কেমালিষ্টদের সেক্যুলার মানসিকতা সম্পর্কে একটু ব্যখ্যা দেয়া দরকার। কেমালিষ্টদের সেক্যুলার মানসিকতা অর্জন সম্পর্কে দুটো মত লক্ষ্য করা যায়, প্রথমত কেমালিষ্ট সেক্যুলারিজমের মডেল নেয় হয়েছে ফরাসী লাইসিজম থেকে যা রাষ্ট্র ও ধর্মের সরাসরি বিচ্ছেদের কথা বলে । এখানে যদিও ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে আলাদা করা হয়েছে।
তারপরও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ধর্ম রাষ্ট্রের অধিনে থেকে যায়। অন্যভাবে বলা যায় এক্ষেত্রে ধর্ম রাষ্ট্র কতৃক নিয়ন্ত্রিত হয় যেখানে অটোমান সময়ে রাষ্ট্র ধর্ম কতৃক নিয়ন্ত্রিত হত। দ্বিতয়িত কেমালিষ্টরা যাকে সেক্যুলারিজম বলে তা মূলত ধর্মহীন, যার লক্ষ ছিল ধীরেধীরে পরিকল্পিত ভাবে ইসলামী নিয়ন্ত্রনকে দেওলিয়া করা। এ মত অনুযায়ী ভাবা হয় যে, কেমালিষ্টদের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের ইসলামিক অংশকে সম্পূর্ন বিনষ্ট করা। সে যাই হোক মূলত যা ঘটেছে তা হল এ দুই এর মাঝামাঝি কিছু একটা।
ধর্মের উপর রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রন স্থাপিত হয়েছিল। এবং ধর্মকে উচ্ছেদ না করে মুলত স্বতন্ত্রীকরন করা হয়েছিল। ধর্মকে তার পুরাতন আবরন থেকে বের করে নতুন একটি রূপ দেয়া হয়েছিল। অন্যভাষায় কেমালিষ্টরা ইসলামের সংষ্কার সাধনের মাধ্যমে মূলত একটি অধিক মানবিক ধর্মের প্রচলন করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এই পরিবর্তিত রূপে ইসলাম শুধুমাত্র একটি স্বতন্ত্র ধর্ম ব্যতিত আর কিছুই ছিল না।
রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে এর বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক ছিল না।
এখন তুরস্ক একটি দেশ যেখানে ১৯২৩ সাল থেকে গনতন্ত্র চালু রয়েছে। এর ৯০ শতাংশ জনগন মুসলিম। তুরস্কে ১৯৮০র শেষের দিকে মৌলবাদীর পরিবর্তে নতুন ধারার ইসলামিক উত্থান লক্ষ করা গিয়েছিল যা অনেকটাই উদারবাদী ছিল। কিন্তু তুরস্ককে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা অযৌক্তিক হবে।
তূর্কী প্রজাতন্ত্র স্যেকুলার গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এক অনন্য উদাহারন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হওয়ার পরেও তুরস্ক মুসলিম রাষ্ট্র নয়। তুরস্ক যদি মুসলিম রাষ্ট্র না হয়ে থাকে তবে ইইউ এর এই পশ্নে এত মাথাব্যাথা কেন? ইইউ কি তবে একটি খ্রিস্টান কমিউনিটি? যা ইসলামকে একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ইউরোপে সমাজ সংস্কারের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও জনগনের ওপর এখন পর্যমত্ম পোপ ও ভ্যাটিকানের ব্যপক প্রভাব রয়ে গিয়েছে। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে অধিকাংশ রাষ্ট্র ভ্যাটিকানের কতৃত্ব না মানলেও এর মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
বিশেষত ইতালী এবং স্পেন এর মত দেশে এর ব্যপক প্রভাব লক্ষ করা যায় এবং কার্যত এর অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়।
ইইউ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের একটি পরিবর্তিত ও আধুনিক রূপ যদিও এখন পবিত্রতা বিষয়টি প্রশ্নের সম্মূখীন। এই অঞ্চলে সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে, হয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, যা সব শেষে এনেছে সহনশীলতা বর্তমানে শুধুমাত্র জনগনই নয় বরং সরকারও তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজেদের একটি বৃহত্তর ইউরোপের অংশ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে যেখানে তারা কিছু সাধারণ মূল্যবোধ ভাগাভাগি করে। তবে এ মূল্যবোধ সমূহের মধ্যে কি ধর্মের স্থান থাকা উচিত? যদিও তুরষ্কের ক্ষেত্রে ইসলাম একটি ইস্যু, তবে তা অনেকাংশেরই সামাজিক ইস্যু, কোন ভাবেই রাষ্ট্র কেন্দ্রিক নয়। ইইউ এর জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ন তা হল নিরপেক্ষতা।
ইইউ যদি তুরষ্ককে গ্রহন করতে চায় তাহলে ইইউকে অবশ্যই নিরপেক্ষ ও সৎ হতে হবে। ইইউ এর উচিত সবার জন্য একই পদ্ধতি, মানদন্ড, এবং একই নীতি অনুসরন করা। তাকে হতে হবে বিশ্বজনীন পক্ষপাতিত্বহীন। এই মত যদিও আমাদের সেখানেই নিয়ে যায়, যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম। আসলে সমস্যাটি তুরষ্কের নয়, বরং ইইউ এর অবস্থানের।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ইইউ এর সামনে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী গনতন্ত্র ও উদারবাদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে তারা এ নেতৃত্ব দিতে প্রস্ত্তত হলেও তাদের সমাজ এখনো এর জন্য প্রস্ত্তত নয়। পূর্বের মত এখানেও পথ বেছে নেয়ার ব্যাপার রয়েছে, ইউরোপকে ‘নতুন ইউরোপ’ অথবা ‘সাংস্কৃতিক ইউরোপ’ থেকে একটিকে বেছে নিতে হবে। তাদের বেছে নেয়ার উপর নির্ভর করবে তারা কি হতে চায়। হতে পাওে তা একটি নিরপেক্ষ নীতিবান নেতৃত্ব অথবা অধিক সংরক্ষনশীল নেতৃত্ব যা নিজেকে ভূ-প্রাকৃতিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।