আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভোট , না ভোট : একটি সত্যের মতো বদমাশ ।।

নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা ।

মুখবন্ধ [ দীর্ঘ দশটি বছর পর্যন্ত আমার এ লেখাটিকে আমি আঁকড়ে রেখেছি । বিশ্বাস ছিলো কেউ না কেউ একজন সম্পাদক এ লেখাটির মূল্যায়ন করবেন একদিন । লেখাটি পড়লেই বুদ্ধিমান কেউ বুঝতে পারবেন, কোথায় ভুল করে ফেলেছি আমি ।

এখানে যেটুকু তুলে ধরলুম তা আমার মূল লেখাটির শেষের ইতিহাস । গোড়ার ইতিহাস আরো লম্বা । এই ব্লগে দীপ্যমান একদল লেখক এবং পাঠকশ্রেনী আছেন, এই বিশ্বাসে সাহস করেই পুরোনো পান্ডুলিপি যতোখানি সম্ভব অবিকৃত রেখে হাজির করলুম লেখাটির ভাগ্যের টানাপোড়েনের এবং কাল-পরিক্রমার কথকতা । আশা করি গোস্তাকী মাপ করবেন …… ] প্রিয় সম্পাদক, …………….. শুভেচ্ছা রইলো। এই প্রথম একটি লেখা পাঠালাম আপনার পত্রিকায়।

লেখাটির প্রেক্ষাপট লেখাটির প্রথম কয়েক লাইনেই রয়েছে। লিখেছিলাম অনেক আগে, তখন সম্ভবত রাজনৈতিক কারনেই কোন বিশেষ একটি পত্রিকা এটি ছাপাতে উৎসাহ (‘সাহস’ বললুমনা) দেখাননি। লেখাটি সম্পর্কে এটাই আমার সরল স্বীকারোক্তি । সময় পাল্টেছে, তাই মূল লেখাটির সাথে বর্তমান কালটি সংযোজিত হয়েছে। লেখাটির প্রতিপাদ্য, একটি আলোচনার জন্ম দিতে পারে যা থেকে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে আমার-আপনার, সকলের কাঙ্খিত একটি সমাধান।

ধন্যবাদান্তে – ………………………. ৫ ই জানুয়ারী’২০০৮ ভোট, না ভোট কথায় আছে ‘ দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি ’। এ লেখা শুধু ক্ষেপিয়া গিয়াছি বলেই নয়, আরো বেশী কিছু হয়েছি বলেই লেখা। আমি দেশের পনের কোটি লোকের মধ্যে একজন খেটে খাওয়া মানুষ। উদয়াস্ত পরিশ্রম করি। পত্রিকায় কিছু লেখা আমার জন্যে বিলাসিতা।

চিন্তা-চেতনা এবং বিদ্যাবুদ্ধি ‘ বুদ্ধিজীবি ’ স্তরের নয় বলে সে সাহস ও নেই। কিন্তু দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ মাত্রেই মরীয়া হয়ে ওঠেন। বাঁচার একটা শেষ চেষ্টা করেন। আমার এ লেখা এরকমই বাঁচার একটা শেষ চেষ্টা। জানিনা, সম্পাদক মহোদয় আমার বক্তব্যটিকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে লেখাটির কোন গতি করবেন ! কারণ আমি কোনও প্রতিষ্ঠিত লেখক/প্রাবন্দিক নই।

আমার মতো হাযারো অর্বাচীন নিত্যদিন সম্পাদক মহোদয়ের শীরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাড়াঁন। সুতরাং ‘সম্পাদক’ নামের মানুষটিকে তেমন একটা দোষ দেয়া যাবেনা। তবুও কোন ভরসায় লিখতে বসা ? কারন এ অভিজ্ঞতাটুকু হয়েছে যে, দেশের কেউ শুনুক আর না ই শুনুক ; কথা বলতে কোনও বাধা নেই। যখন আমরা সবাই ই বাক-স্বাধীনতায় (!) বিশ্বাসী । আর এই শোনা, না শোনা নিয়েই আমার এই লেখা।

দীর্ঘদিন ধরে পত্র-পত্রিকা, বক্তৃতা-সমাবেশ, বেতার-টিভি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি তাবৎ মাধ্যমে একটি কথাই বেশী উচ্চকিত এবং প্রমানিত যে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবক্ষয় আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রানের কোনও উপায় সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞ সমাজবিদরাও দিতে পারছেননা। সবাই ‘মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক’ এই জাতীয় গৎবাধা বুলি আউড়ে গেছেন সমাধান হিসাবে, দিনের পর দিন। কাজের কথাটি কিন্তু কেউ ই বলেননি। আশ্চর্যের বিষয় ‘ওয়ান-ইলেভ্ন’ এর আগে এই ‘কথা-বলিয়েরা ’ দের অধিকাংশই, যারা ছিলেন প্রধানতঃ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবি (সত্যিকার অর্থেই বুদ্ধি বিক্রি করে যারা জীবিকা অর্জন করেন মাত্র, জনগনের কাছে যাদের কোনও কমিট্মেন্ট নেই) তাদেরকে মনে হতো দেবতার মতো - যাদের মুখে খাবার উঠতে চাইতো না , ঘুম হারাম হতো জনগনের কথা চিন্তা করতে করতে।

‘ওয়ান-ইলেভ্ন্’ সেই তাদেরকেই ন্যাংটো করে ছেড়েছে, যে নগ্নতা হয়তো আরো অনেক যুগ আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যেতো। আরো আশ্চর্যের বিষয় এই যে ‘ওয়ান-ইলেভ্ন্’ পরবর্তীকালে তারাই আবার ভোল পালাটাচ্ছেন ক্ষনে ক্ষনে। যে সংবিধানকে পায়ে ঠেলে এতোদিন যারা নিজেদেরই আখের গুছিয়েছেন মাত্র, সংবিধানের কথা বলতে বলতে তাদের মুখেই এখন ফেনা উঠে যাচ্ছে। জনগণের অধিকারের কথা বলতে বলতে নাওয়া-খাওয়া ছেড়েছেন। সাংবিধানিক ভাবে এদেশটি একটি “গণপ্রজাতন্ত্রী” রাষ্ট্র।

যৌক্তিক ভাবেই প্রতিনিধি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গঠিত একটি সার্বভৌম সংসদ এর পরিচালনায় থাকবেন। জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় যারা সাংবিধানিক ভাবেই বাধ্য। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে ‘ওয়ান-ইলেভ্ন্’ পূর্ববর্তী রাষ্ট্রীয়, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিমন্ডলে একছত্র ভাবে রাজনীতিবিদ এবং তাদের বশংবদ সুবিধাবাদীরাই এই সংসদীয় রাজনীতিতে ছলচাতুরী ঢুকিয়ে তারই ছত্রছায়ায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য চালিয়ে গেছেন যেখানে জনগণ ছিল অপাংতেয় এবং তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকারটি ছিল ডাষ্টবিনে নিক্ষিপ্ত । উল্টো ঐ সকল প্রতিনিধিদের কাছেই সময় সময় জনগণকে জবাবদিহি করতে হয়েছে। সেই সময়কালের পুরোটা জুড়েই কার্যত জনগণ ছিলো তাদেরই কাছে জিম্মি।

তারা ভুলেই গিয়েছিলেন যে, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে এরাই একসময় কতো রকমের তত্ত্বই না হাযির করেছেন - সেই গণতস্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সামরিক স্বৈরাচারতন্ত্র - সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মিশেল দেয়া তন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনও কিছুতেই কিছু হয়নি। কারনগুলো আজ স্পষ্ট। এসব করতে গিয়ে সাধারন মানুষের পিঠটি ঠেকে গেছে দেয়ালে।

সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ চীৎকার করেছেন একটি সুস্থ্য সমাজের জন্যে - একটি কল্যানমূখী রাষ্ট্রের জন্যে যেখানে একটি রাষ্ট্র কাঠামোয় প্রতিটি সদস্য তার নাগরিক ও মৌলিক অধিকার যেমন - খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে নিশ্চয়তা পাবেন। আশ্চর্যের বিষয়, এই চিৎকার যে সব ‘কান’ এর জন্যে সেই কানে এগুলো অতীতে ঢুকেছে এমন প্রমান নেই, ভবিষ্যতেও ঢুকবে কিনা আমরা জানিনা। ‘ওয়ান-ইলেভ্ন্’ পূর্ববর্তী সময়কালে কোনও তরফের কানেই যে তা ঢোকেনি তার প্রমান তো এবেলা সূর্যের মতোই সত্যি। ঢোকেনি বলেই বিদগ্ধজনেরা তখন দিনের পর দিন, পাতার পর পাতা ভরে লিখে গেছেন পথের হদিশ; লিখছেন এখনও। কিন্তু কুম্ভকর্ণদের ঘুম তো ভাঙ্গেনি।

বরং আপামর জনগণের ‘কান’ এর জন্যে তাদেরই একশ্রেনীর পদলেহী প্রতিভূরা স্বোচ্চারে ওয়াজ নসিহৎ করেছেন ‘ ভোট দেয়া নাগরিক অধিকার ’ বলে। সকল ধরনের ‘তন্ত্র ’ এই শিশু রাষ্ট্রটির উপর গিনিপিগের মতো প্রয়োগ করেও যখন সমাজের ক্ষমতাভোগী শ্রেণী , যখনই সকল সুবিধা ভোগের ‘ মৌরসী পাট্টা ’ লাভে কোনও না কোনও ভাবে শংকিত হয়েছেন তখনি ভোট তন্ত্রের সংস্কৃতি চালু করে দিয়েছেন। যার ধারাবাহিকতা আজো রয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, ভাত-কাপড়ের অধিকারের দাবীর চেয়েও এই ভোটাধিকারের দাবী আরো সোচ্চার হয়ে পত্র-পত্রিকায়, বেতার-টিভিতে, মাঠে-ময়দানে একশ্রেণীর লোকের (যারা নিজেদের গণতন্ত্রের একমাত্র পূজারী বলে ভাবতে ভালোবাসেন) গলায় উচ্চকিত হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকারের দাবী আদায়ের কথা বলে হরতালের নামে জনগণের সম্পদের উপরই আঘাত হানা হয়েছে, খেটে খাওয়া মানুষের রুজির পথ বন্ধ করা হয়েছে, মানুষ খুন করা হয়েছে।

এগুলো শুনে শুনে - দেখে দেখে কান,চোখ পঁচে গেছে। আর আমরা নির্বোধ জনগণ ( ক্ষমা করবেন, পাঠক ) তারপরেও এগুলো শীরধার্য করে ভোটের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছি ; ভাত-কাপড়ের লাইনে দাঁড়াইনি কারণ ভাত-কাপড়ের অধিকার আদায়ের ডাক কেউ দেয়নি- দেয় ও না। এবং এ করেই আমাকে প্রতিপালনের যাবতীয় ক্ষমতা তুলে দিয়েছি সেই শ্রেণীর হাতে যে শ্রেণী কোন অবস্থাতেই ‘সাধারন মানুয়ের’ প্রতিনিধিত্ব করেননি। সমাজবিদরা আৎকে উঠবেন আমার এ বিশ্লেষনে। প্রশ্ন তুলবেন - ভোটে নির্বাচিত লোকজন ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেননা, এটা কোন ধরনের আহাম্মকী কথা ! জবাবে বলছি, শাসক শ্রেনী কোন অবস্থাতেই শোষিতের প্রতিনিধিত্ব করেনা।

এটা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা ভোট দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে এক একটি ‘শাসকশ্রেণী ’ ই তৈরী করেছি বারংবার, প্রতিনিধি নয়। খুচরো-খাচরা কিছু ইস্যু ছাড়া কোন অবস্থাতেই তারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেননি। এর প্রমান প্রতিদিনের কাগজের সংবাদে, সংবাদভাষ্যে, নিবন্ধে চোখ বুজে পেয়ে যাবেন। ‘ওয়ান-ইলেভ্ন’ এর পরে সব ধরনের মিডিয়ার কল্যানে এই নগ্ন-কুৎসিত চেহারার প্রমানগুলো জনপ্রতিনিধিদের (!) কোন ভুমিকাকে তুলে ধরছে ? এটাও কি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে ? পুরোনো কিছু লেখা থেকে এর কিছু উদাহরন তুলে ধরলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে বিশ্বাস করি।

‘ চাই নূহের কিসতী ’ সংবাদভাষ্যে জনাব মুন্তাসীর মামুন এক জায়গায় লিখেছেন - ‘‘ দেশের প্রগতির অন্তরায় যে এ ধরনের রাজনীতিবিদ সে কথাটা আবারও সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে ”। অন্যত্র - ‘‘ স্টেটম্যানশীপের কথা দুরে থাক, এসব বক্তব্যে আধুনিক কোন মানুষের মনোভাবও প্রকাশ পায়না ”। জনাব রাশেদ খান মেননের ‘ অসহায় সব মানুষের কথা ’ নিবন্ধের দু’লাইন - ‘‘রাজনীতিতে এখন বড় কথা - ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার ইস্যুর তলায় মানুষের জীবন ধারনের মৌল প্রশ্নগুলো অবান্তর হয়ে গেছে”। ‘ওয়ান-ইলেভ্ন’ এর পূর্ববর্তী সময়ের যে চিত্র এখন পরিষ্কার, তা থেকে তো একজন অকাট মূর্খও বুঝতে পারছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিগন কস্মিনকালেও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেননি।

ক্ষমতা, কেবলমাত্র ক্ষমতায় থাকার লোভেই এই প্রজাতিটি এবং তাদের জন্মদাতা দল ও গোষ্ঠী , যারা জনগণ এবং সংবিধানের দোহাই দিতে দিতে মূর্চ্ছা গেছেন সকাল-বিকেল; তারাই সেই রাষ্ট্র ,জনগণ এবং সংবিধানকে লাথি মেরেছেন অবলীলায়, যে রাষ্ট্র এবং জনগণের উছিলায় তারা এই পদাভিসিক্ত হয়েছেন। এমনকি সেই রাষ্ট্রের জন্মের বিরূদ্ধাচারনকারী এবং জনগণকে ভারতের জারজ সন্তান হিসাবে আখ্যায়নকারী গোষ্ঠীর সাথে গলাগলি করেছেন ( আক্ষরিক অর্থে, গোষ্ঠীকে কোলে বসিয়ে চুমু খেয়েছেন ) নির্লজ্জের মতো কেবলমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে। একবারের জন্যেও তাদের আত্মসম্মানবোধ (নিছক যেটুকু থাকলেও মানুষ ‘মানুষ’ পদবাচ্য হয়) চিড় খায়নি। কেবল মাত্র ক্ষমতালীপ্সার কারনে এদেশের জনগণের ০.৫% এরও কম মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী গোষ্ঠীর কাছে মুক্তিকামী ৯৯.৫% জনগণ এবং তাদের স্বাধীনতার চেতনা বিকিয়ে দিয়ে নিজেরাই যে পিতৃ-পরিচয়হীন তা প্রমান করে ছেড়েছেন। এখন কথা হলো, এই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রাপ্তি কি কিছুই হয়নি ? বলবেন - হয়েছে, গণতন্ত্র চর্চ্চা হয়েছে।

মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যদি প্রশ্ন তুলি - সেই গণতন্ত্র আমাদের কি দিয়েছে ? ‘ওয়ান-ইলেভ্ন’ এর আগে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হলে উত্তরে বলতাম - দৃশ্যত ‘ গণতন্ত্র পেয়েছি ’ বলে আনন্দে বগল বাজানো একশ্রেনীর রাজনীতিক এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবি একটি শ্রেণী উপহার পেয়েছি। দিস্তা দিস্তা কাগজ আর টনকে টন কালি খরচ করে গণতন্ত্র নামক সোনার হরিণ ধরেছি এই সুখে ‘সব পেয়েছির দেশে’ পৌঁছে গেছি বলে নিবন্ধ লেখার মতো তোষামুদে বুদ্ধিজীবি শ্রেণী উপহার পেয়েছি। এবং সভা সেমিনারের নামে লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয় করার জন্যে একদল সুযোগ সন্ধানী লোকের দেখা পেয়েছি। (পাঠক, খেয়াল করবেন; এই ধারা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি সময়কালেই বিভিন্ন খোলসে বিস্তৃত) আমরা নির্বোধ জনগণ উপরিউক্তদের উল্লাসে খামোখা উল্লসিত হয়েছি কিছু না বুঝেই।

বহু চর্চিত গানটির প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে অবান্তর হবেনা হয়তো, ‘বেগানা শাদী মে আব্দুল্লাহ দিওয়ানা’। (পত্রিকান্তরে একজন বোদ্ধা এই গানটির শিরোনামেই একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি) আর ‘ওয়ান-ইলেভ্ন’ এর পরে এই প্রশ্নের উত্তরটি কি হবে তা জানতে মেট্রিক পাশ করার দরকার নেই। একজন অতি সামান্য ব্যক্তিও যে উত্তরটি বলবেন তা এই - সেই গণতন্ত্র আমাদের কয়েক’শ কোটিপতি উপহার দিয়েছে, জনগণের প্রতিনিধি এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হাযার শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে । (ভাবতে ভালোই লাগছে, দেশ এগিয়ে গেছে !) আর রেখে গেছে ‘ভাত দে হারামজাদা’ এই মনোভাব নিয়ে নিষ্ফল ক্রোধে নিজের আঙ্গুল কামড়ানো চৌদ্দ কোটি আটানব্বই লাখ সংখ্যক এক অবুঝ জনগোষ্ঠীকে যারা গত কয়েক শতক ধরে নিষ্পেষিত হয়ে এসেছেন এমনিভাবেই। কিন্তু আমরা কি জানতাম, যাদের যাদের সমর্থন দিয়ে আমরা গণতন্ত্র রক্ষার অতন্দ্র সৈনিক হলাম তাদের উল্লসিত হওয়ার কারণ অন্যত্র ! তাদের বাজারে যেতে হয়না, গেলে বলতে পারতেননা, ভাতের বদলে আধকেজি মাছ খান ( এই উক্তি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যিনি একসময় জনতার লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের মন কেড়ে ছিলেন, আর সেই তিনিই ভোটের লাইনে এসে একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে আমূল পাল্টে গেলেন।

এদেশের ভোটের রাজনীতিতে আমরা একজন মানুষকে হারালাম। ); তাদের ছেলেমেয়েদের সীমাহীন যানজট পেড়িয়ে-জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশী স্কুল কলেজে যেতে হয়না; সেশন জটে পড়ে তার সবেধন নীলমনি সন্তানটি কবে বাড়ী ফিরে সংসারের জোয়ালটি ঘাড়ে নেবে,এই চিন্তায় মাথার চুল সাদা করতে হয়না; তাদের সামান্য সর্দি-কাশীর চিকিৎসার জন্যে উড়ালজাহাজ ডানা মেলেই আছে, উঠে বসলেই হলো ইত্যাদি। পেছনের দিনগুলোতে পত্রিকার পাতা খুলে এ সম্পর্কিত তাবৎ আক্ষেপ আপনারা সবাই পেয়ে গেছেন। কিছু ভালো মানুষ আছেন বলেই এগুলো লেখা হয়েছিল । কিন্তু ঐ পর্য্যন্তই।

আগের মতো এখনও এগুলো লেখা হয়- কি গতি হয়, তা আমার মতো আপনারাও ভালো জানেন। তাহলে দাঁড়ালো এই - গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা অবোধ জনগণ এক একটি শাষকশ্রেণীই তৈরী করেছি এক এক সময়। সেই শ্রেণীটিই আমার-আপনার দণ্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে (রাষ্ট্র ক্ষমতার স্বাদ ভোগকারী সকল শ্রেণী) বেশ জোর গলাতেই বলতে পারেন - ‘জনগণ আমাদের পাশে আছে’। বিপদে পরলে উভয় পক্ষই জনগণের দোহাই তোলেন । কিন্তু আমরা ভেবে পাইনা, আমাদের মতো জনগণের পাশে কে আছে ! অর্থনীতিবিদ জনাব ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যথার্থই বলেছেন, ‘শুধু একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোনক্রমে টিকিয়ে রেখেও কোনও লাভ নেই যদি তা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক না হয়।

’ এ প্রসঙ্গে ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল সাহেবের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন একটি উক্তি স্মরন করা যেতে পারে। এক প্রশ্নের উত্তরে উনি বলেছিলেন, গণতন্ত্রের মতো খারাপ কোনও তন্ত্রই আমি দেখিনি। অথচ এই মূহুর্তে এর চেয়ে ভালো কোনও তন্ত্রের কথাও আমার জানা নেই। (পাঠক, এর অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করুন) একটি শিক্ষিত জাতির প্রতিনিধি হয়েও যদি উনি এমন মন্তব্য করতে পারেন তবে আমাদের মতো অশিক্ষিত (?)জাতির জন্যে সেই তন্ত্র কতোখানি ভয়ঙ্কর হতে পারে একবার ভাবুন ! যদি না সেই গণতন্ত্রের মর্মকথা আমরা বুঝি। আমরা যে তা বুঝিনা তার প্রমান ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এর ঐ উক্তিটি।

যদি বুঝতাম তাহলে গণতন্ত্রের প্রথম পাঠ, ‘‘ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, অব দ্য পিপল” এই প্রাথমিক সঙ্গাটি ভুলে যেতাম না। আজ অবস্থাটিকে গণতন্ত্র পুজারীরা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন যে, আমরা নিজেরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি গণতন্ত্র মানেই ‘ ফর্ মি, বাই মি, অব মি’। গণতন্ত্রের এই ধরনের পুজারীরা বুঝে গেছে, নির্বোধ জনগণকে একবার ভোটের লাইনে দাঁড় করাতে পারলেই ‘‘ ফর্ মি ” র গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। এবং এটাই তাদের একমাত্র রক্ষা কবচ। এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক সভ্যতার ধ্বজাধারীরা যে মেকী মানসিকতা তৈরী করে দেয় জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের মূহুর্তে তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই মৃত্যু পর্যন্ত ।

ব্যতিক্রম যারা হতে চায়, যারা মানুষের সঠিক জায়গার খোঁজ দিতে বদ্ধপরিকর তাদেরকে হয় পাগল নয় রাজনৈতিক মতলববাজ বলে চিহ্নিত করে দেয় পেশাধারী রাজনৈতিক দলগুলো। এর ভূরিভূরি প্রমান - দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ/ পাল্টা প্রবন্ধ এর ছড়াছড়ি, ছোটবড় সকল রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি, এমনকি বিভিন্ন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পারিক দন্ধ আর বাক্যুদ্ধ। আর আমরা দেশের কোটি কোটি মূর্খ কিছু না বুঝেই সেইসব বাণী গপ্গপিয়ে গিলি। তাছাড়া এই সিস্টেমটাই তারা এমন ভাবে তৈরী করে যে কয়েকটা রাজনৈতিক দল, কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং সুবিধা লুন্ঠনকারী কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবি ও মানবতাবাদী কর্মী যা করবে মিলেমিশে, সাধারন মানুষ তাই ই মেনে নেবে। এতে করে, জনগণের নামে তারা যা ইচ্ছা তা ই করতে পারবে।

যেমন, বিরোধী ভূমিকায় থাকলে হরতাল ডাকতে পারবে এবং ক্ষমতায় এসেই ডান্ডা মেরে হরতাল বেহাল করতে পারবে; অর্থনীতিকে রসাতলে পাঠিয়েও অর্থমন্ত্রী পদে বহাল থাকতে পারবে; আগপাছ না ভেবেই, নিজের আব্রু রক্ষার কোন ব্যবস্থা না করেই ঘরের সদর দরজা সকলের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়ে বিশ্ব কাতারে সামিল হতে পারবে (এ ক্ষেত্রে পাঠক অবশ্যই স্মরন করবেন, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদির বিশ্বায়ন ফর্মূলার বিরূদ্ধে খোদ ধনী দেশেই সামপ্রতিক কালের বিশাল বিক্ষোভ এর); প্রতিদিন মাঠেঘাটে মারামারি আর মুখ দেখাদেখি না করেও সংসদে বসে দুই বা ততোধিক শত্রুপক্ষ আপোসে বেতন বৃদ্ধি, শুল্কমুক্ত গাড়ী আমদানী ইত্যাকার প্রশ্নে একই সুরে কোরাস গাইতে পারবে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন করবেন, এর জন্যে দায়ী কে। উত্তর একটাই - আমরা জনগণ। কারণ আমরাইতো ভোট দিয়ে তাদের ‘লাইসেন্স’ দিয়ে দিয়েছি। যদি সেই শ্রেনীকে কোন প্রশ্ন করেন তবে জবাব পাবেন - আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত।

‘ফর মি, বাই মি’র গণতন্ত্রে এটাই একমাত্র ফলাফল। এটি জেনেও বিদগ্ধজনেরা অনেক আশা নিয়ে ‘মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক’ জাতীয় লেখা লিখেছেন পাতার পর পাতা । কিন্তু সবই গুড়ে বালি। কারণ লক্ষ লক্ষ গৃহহীন মানুষের গৃহসংস্থানের জন্যে যে সংসদ ও জনপ্রতিনিধিদের কোনও মাথা ব্যথা নেই বরং জনগণের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ব্যক্তি বিশেষকে বরাদ্দ দেয়ার জন্যে আইন পাশের মহাউল্লাশ করা হয় (এ ক্ষেত্রে উক্ত সম্পত্তির নগদ মূল্যের সাথে আইনটি পাশ ও পাশ পূর্ব আলোচনার জন্যে ব্যয়িত সময়ের সংসদ খরচ যোগ হবে) সেখানে এরকম লেখা বিদগ্ধজনকে লিখতে হবে আমৃত্যু। এবং প্রতিবারই সরল অংকের মতোই ফলাফলটি হবে ” অপ্রাপ্তি ”।

এমনটা কেন হলো ? অর্থনীতিবিদ জনাব ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের আরো একটি পুরানো বক্তব্য প্রনিধান যোগ্য- ‘ বর্তমান পরিবেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে নীতিবান সৎ মানুষের কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্ধিতায় প্রভাবশালী, দূর্নীতিবাজ প্রার্থীকেই নির্বাচনে জয়ী হতে দেখা যায় এমনকি অবাধ নির্বাচন হলেও। ’ আর একারনেই গত ত্রিশ বছর ধরে রাষ্ট্র এবং সামাজিক পরিমন্ডলের প্রতিটি স্তরে যে “আতঙ্কিত” হবার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রেণী স্বার্থে যাতে করে ‘ ফর মি ’ র গণতন্ত্রে পৌঁছানোর প্রতিটি পথ কায়েমী ভাবে নিরঙ্কুশ হয়। এতে যে ‘গেল গেল’ রব ওঠেনা, তা নয়। তবে তারা বেঁচে যায় একটি খুটির জোরে।

সে খুটিটিই হলো ‘ভোট’। এবং এই জোরেই শোষন নিপীড়নের যাবতীয় হাতিয়ার ও সংগঠনের তারাই একমাত্র নিয়ন্ত্রক হয়। সেটিই তাদের রক্ষা কবচ। এবং এভাবেই তারা সেক্ষেত্রে রক্ষা পায় আর যতোদিন সম্ভব ক্ষমতার গদি আঁকড়ে রাখে। এরকম (যা আমরা এতোদিন দেখে এসেছি) চিরস্থায়ী একটি কায়েমী সুবিধা বজায় রাখতে শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাকে তো পাশ করতেই হবে।

সে কারনে জনগণের দোহাই দিয়ে একটি আবহাওয়া তৈরীর মধ্যে দিয়েই তারা নেমে পড়েন ভোট যুদ্ধে। আর আমরা জনগণই সে ভোট যুদ্ধের আয়োজক এবং অংশগ্রহনকারী। নিজের পায়ে কুড়াল মারার এমন নজির আর দ্বিতীয়টি নেই। এ ভাবেই আমরা মূর্খ জনগণ নিজেরা বেগার খেটেখুটে রাজমুকুটটি তাদের মাথায় তুলে দিই অর্থাৎ পাশের সার্টিফিকেটটি তাদের হাতেই দিয়ে দিই। আর শোষিত হয়ে ইতরসম জীবনযাপনে নিজেরাই বাধ্য হই।

‘যতো দোষ নন্দ ঘোষ’ আমরা জনগণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নটি মূখ্য হয়ে দাড়িয়েছে তা হলো,এই অবিশ্বাস্য ভারী বোঝার দায় আমরা জনগণ টানবো কেন ? টানা উচিৎ কিনা ? উত্তরটা হয়তো নিজাম আউলিয়ার ডাকাত থেকে দরবেশ হওয়ার প্রচলিত কাহিনীর মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। তাঁর তস্করবৃত্তির দায়দায়িত্ব যখন প্রশ্নের সন্মুখীন তখন তিনি পরিবারের সবাইকে এর দায়ভার নিতে বললেন। পরিবারের পক্ষ থেকে উত্তর এলো, সংসার প্রতিপালনের ভার তার উপর ন্যাস্ত থাকলেও তাঁর (নিজাম আউলিয়া) কৃতকর্মের জন্যে তাদের কোন সমর্থন নেই - এ দায়ভার তাদের নয়। সেই থেকে একজন তস্কর পরিবর্তিত হলেন একজন আল্লাহভক্ত আউলিয়া রূপে।

কাহিনী থেকেই উত্তরটা পরিস্কার, এ দায়ভার আমরা টানবো না। কিছু কিছু বিবেকবান কণ্ঠ কি একথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন না ? অনেক আগে প্রখ্যাত সাংবাদিক-কলামিষ্ট শ্রী নির্মল সেন এক প্রবন্ধে বন্যাকবলিত দেশে সংসদের অধিবেশন চলা না চলার কথা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন, তাঁর পকেটের পয়সা তিনি দিতে রাজী নন। প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর কষ্টার্জিত পয়সার সাশ্রয় আর অপচয় নিয়ে। বলেছেন, অকাজে সংসদের প্রতি মিনিটের বিপুল খরচের দায়ভার তাঁর নয়। একথা শ্রীসেন এর একার নয়।

একথা সকল মানুষের। শ্রীসেন এর সাহস আছে, সুযোগ আছে লেখার; লিখেছেন। ভোট সর্বস্য এই রাজনীতি থেকে প্রাপ্তির ফিরিস্তি দিয়ে আর লাভ নেই। বলি আর না-ই বলি, কেউ শুনুন আর না-ই শুনুন, আমরা সবাই এই রাহুগ্রাসের শিকার। এটি আমাদেরই অজান্তে, আমাদেরই অজ্ঞতায়, আমাদেরই অসচেতনতায় -অবহেলায় তৈরী একটি ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন।

তাহলে এর সমাধান কোথায় ? এর সমাধান আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। ‘ওয়ান-ইলেভ্ন’ এর পরে মানুষ সামান্য হলেও বুঝতে শুরু করেছিলো রাষ্ট্রের জন্যে জনগন নয়, জনগণের জন্যেই রাষ্ট্র। ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্রপত্রিকা এই সচেতনতা তৈরীতে যে অসাধারন ভুমিকা রাখছে তার প্রশংসা করতেই হয়। তার পরেও শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কারণ মিডিয়ার প্রচারনায় বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত টক্ - শো গুলোতে, বিগত দিনগুলোর সিষ্টেমটাই পাল্টানোর বিভিন্ন আকুতি নিয়ে যে স্বতঃস্ফুর্ত জনঅংশগ্রহণ (রাজনৈতিকদল বহির্ভূত) বাড়ছে তা থেকে আপামর মানুষের আকাঙ্খাটা যতোই স্পষ্টতর হচ্ছে ; ঠিক তেমনি ভাবেই রাজনৈতিকদলগুলোর নেতৃস্থানীয় মুখগুলো থেকে গণতন্ত্র চর্চ্চার নামে আবারো জনগণের দোহাই দিয়ে পুরোনো সিষ্টেমটাই বহাল রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টার সামন্ততান্ত্রিক বুলি বেরুচ্ছে।

দেখেশুনে একথাই মনে হচ্ছে, দেশে এখন দু’টো স্রোত বইছে। একটি স্রোতে আছে অরাজনৈতিক জনগণের সাথে বিবেকবান মানুষের দল যারা বলছেন, একটি সুশীল রাষ্ট্র নির্মানে সকল স্তরের জনগনের মানসিকতার পরিবর্তন, সচেতনতাবৃদ্ধি আর রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সিদ্ধান্তে অংশগ্রহন জরুরী । আর অপর স্রোতে আছে চিরকালের সুবিধাবাদী রাজনৈতিকদলগুলোর অংশটি যারা এখন শত্রুমিত্র ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একই গলায় একই কোরাস্ গাইছে অথচ দু’দিন আগেও যারা এক অন্যের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতেও পিছপা হয়নি, যারা বলছেন সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় একটি নির্বাচন অর্থাৎ ‘ভোট’ দরকার। ভোট বা নির্বাচন কেন দরকার ? বেশ কয়েক বছর আগে বিশিষ্ট কলামিষ্ট জনাব মমতাজউদ্দিন আহমেদ এর ‘নির্বাচন-নির্বাচন-নির্বাচন’ শীর্ষক রচনায় এই প্রশ্নের উত্তরটি এরকম - “ নির্বাচন যদি না হয় তবে এদেশে রাজনীতির ছলচাতুরী হইবেনা। তখন আর ধোয়া দিবার জন্য সমর্থকও জুটিবেনা।

তাই রাজনীতি করিতে হইলে নির্বাচন করিতেই হইবে। ” ভীতিকর ব্যাপার হলো, এই রাজনৈতিকদলগুলোর মুখপাত্ররা কিন্তু এখনও মুখে ফেনা বের করে জনগন ও গণতত্রের দোহাই পাড়লেও দলের ভেতর অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রামানিক উপস্থিতি (‘ওয়ান-ইলেভ্ন’ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে রাজনৈতিকদলগুলোর গণতন্ত্র চর্চ্চার যে ভয়ঙ্কর রূপ উদ্ঘাটন করে দিয়েছে তা) নির্লজ্জের মতো অস্বীকার করে চলেছেন; জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার কথা বলছেন অথচ নিজেদের দলের ভেতরই তার উপস্থিতি নেই। তাদের এখনকার এবং পূর্বতন আচরনে এটা পরিষ্কার যে, সমস্ত ‘ তন্ত্র ’ এই নির্বাচন তথা ভোটের লাইনে এসে তার চরিত্র হারিয়েছে। সুবিধাবাদী শ্রেনী, যাদের চরিত্র ক্ষনে ক্ষনে পাল্টায়; প্রতিবারই ভোটে বলীয়ান হয়ে সেই জনগণের বুকেই ছুরি বসিয়ে গণতন্ত্রের চরিত্র হরন করেছেন যে জনগণই তাদেরকে ‘জনপ্রতিনিধি’ এই সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন “ভোট” নামক আহাম্মকী এক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে । তাই ‘ভোট’ যদি রাজনীতিবিদদের যা ইচ্ছে তা-ই করার গগনচুম্বী ক্ষমতা ( ‘ওয়ান-ইলেভ্ন’ যে ক্ষমতার দাপটের প্রমান আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে ) দিয়ে থাকে, যে ক্ষমতা ভোটারদের সামান্যতম স্বার্থ সংরক্ষনে ব্যয়িত হয়না ; তবে “না ভোট” হয়তো তাদের সেই ক্ষমতা থেকে টেনে নীচে নামিয়ে আনবে।

আস্ফালন করার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং মারাত্মক হাতিয়ারটিই তখন তাদের হস্তচ্যুত হবে। আর আমাদের সাধারন মানুষকে সেই দুঃসহ বোঝার দ্বায়িত্ব কাঁধে নিতে হবেনা। কারন তখন আমরা দায়মুক্ত। হয়তো তখন, সেই নিজাম ডাকাত থেকে একজন ‘নিজাম আউলিয়া’র পূনর্জন্মও হতে পারে। পুনশ্চঃ - অনেকেই “না ভোট” শব্দটিকে ভুল অর্থে বুঝে থাকেন ।

কথাটি কিন্তু ভোটের ব্যালটের “না ভোট” এ সীল মারা নয় । শব্দটির ভাব হচ্ছে " ভোট নয় " । অন্য অর্থে ভোট পদ্ধতিতে অংশগ্রহন না করা । [ পাদটীকা – লেখাটি প্রায় তিন বছর আগের । তাই সেই কালটিকে স্মরনে রাখলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমার এই লেখাটিকে অবান্তর মনে নাও হতে পারে ।

]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।