যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না
ছোট্ট একটা মাংসপিণ্ড ক্ষণে ক্ষণে দিক পাল্টিয়ে এদিক-সেদিক যাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট গন্ডির ভেতর তাকে খাবি খেতে হচ্ছে। সে যে জিনিষটার ভেতর অবস্থান করছে তাকে প্রাপ্ত-বয়স্ক মানুষেরা জরায়ু বলে থাকে।
মাংসপিন্ডটি মানুষ না- তার মুখ নেই,চোখ নেই,কাউকে ডাকার মতো হাত নেই,হাঁটার মতো পা নেই; সে কেবলি একটি মাংসপিন্ড। বিশেষজ্ঞরা তাকে ফিটাস কিংবা ভ্রূণ বলে ডাকতে পারে। তাই তার জানা নেই সে কোথায় আছে। সে শুধু খাবি খেতে থাকে জরায়ুর ভেতরের তরল পদার্থে। তাকে কেউ সাঁতার শেখায় নি,তবু হাত-পা ছাড়া দিব্যি সাঁতার কাটছে।
মাংসপিন্ডটি যার ভেতর বড় হচ্ছে সে সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ একজন তরুণী। তার দু’ট হাত আছে,পা আছে,কথা বলার জন্য মুখ আছে,স্বপ্ন দেখার জন্য মন আছে! তবু সে সাঁতার কাটতে জানে না। পুকুর দেখলে ভয় পায়। আর এখন সাগরে কখনো ভাসছে,কখনো ডুবছে। তরুণীকে পৃথিবীর মানুষ নয়না বলে ডাকে।
নয়ন মানে চোখ,নয়না মানে তবে চোখা হওয়ার কথা। তরুনীর জানা নেই। তাই কেউ নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকে। সে জন্মের পর থেকে অবশ্য কথা কম বলে।
তরুণী মাঝে মাঝে মাংসপিণ্ডটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করে।
বাবু কেমন আছো?
মাংসপিন্ড জরায়ুর ভেতর আবার দিক বদলায়। তরুণী বোঝে না। সে অপেক্ষা করে আছে কবে মাংসপিন্ডটি ধীরে ধীরে শিশুর আকৃতি লাভ করবে,কবে তাকে মা বলে ডাকবে। আদৌ কী ডাকবে?
আজ সকালে তরুণীর মা এসেছিলেন ঘরে। উনি বিখ্যাত মানুষ।
টিভির পর্দায় প্রায় দেখা যায়। নারীবাদি মহিলা;নারীর অধিকারের দাবিতে তার মতো সোচ্চার আর কেউ নেই। রুমে এসে বেশিক্ষণ বসতে পারেন নি। তার মিটিং ছিল। অল্প কিছু কথা বলে চলে গিয়েছেন।
তরুণীটি এখন বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের কথা মানার জন্য অপেক্ষা করছে।
মাংসপিন্ডটির এসব জানার কথা না। সে শুধু মাঝে মাঝে দিক বদল করে। হয়ত জন্মের পর একসময় জানবে শুক্রাণু আর ডিম্বানুর অবুঝ সরল খেলায় সে এসেছে। শুক্রাণুদাতা মানুষটিকে সে বাবা বলে ডাকবে।
আধুনিক ভাবে বড় হলে ডাকবে ড্যাডি বলে। ড্যাডি এখন বাইরে আছে,বাইরে থাকতে হয় ড্যাডিদের। ড্যাডিরা জব করতে যায়,আর বাবারা কাজে। এক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। মাংসপিন্ড মানুষ হলে জানতে চাইতে পারে,সেদিন তুমি কোথায় ছিলে?
শুক্রাণুদাতা ব্যক্তিটি তখন দ্বিধায় পড়ে যাবে।
হাত দিয়ে গাল চুলকাতে পারে। অথবা খুব স্মার্টলি বলে দিতে পারে,আমার বাবুটার জন্য গিফট আনতে গিয়েছিলাম।
হেই ড্যাড,কাম অন। ইটস নট ফানি।
বাচ্চার মুখে ইংরেজি শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাবে সে।
আনন্দের আতিশয্যে কোলে তুলে জাপটে ধরতে পারে।
অথবা,ও আব্বা আপনি কি’তা কইবার লাগছেন?এই ধরনের উত্তর শুনে রাগে ক্ষোভে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে পারে। মাংসপিন্ডর জানা নেই,শুক্রাণুদাতা খুব স্মার্ট। তাই তার ভেতর কোনো গেয়ো ভুতের আত্মা থাকা চলবে না।
এদিকে তরুণী চুপচাপ বসে আছে জানালার ধারে।
সমুদ্রসঙ্গম মানে জানো?
না,জানি না। নয়না আর কিছু বলতে পারে নি।
আঁধো চাঁদ ছিল- আকাশে,ভেজা বালি ছিল চারপাশে। মানুষ ছিল,হয়ত ছিল না। থাকলেও আধাঁরের ছায়া ছিল।
নয়নার মনে ভালোবাসা ছিল,শরীরে কাম ছিল। আর এখন সেই ভালোবাসার চিহ্ন আছে কেবল। ভেজা বালি নেই,আকাশে চাঁদ নেই,আধাঁরের আশ্রয় নেই। সে একা- ভালোবাসার মানুষ হয়ত আছে কোথাও। কিন্তু,ভালোবাসা নেই!
আমি কনসিভ করেছি,সুব্রত।
এটা হয় না। আমি পারব না।
দরজায় বেলের শব্দ। নয়নার ব্যস্ত মা এসে হাজির।
তাড়াতাড়ি চল।
আমার কাজ আছে।
নয়না কিছু একটা বলতে চায়। কথাগুলো গলায় এসে আটকে যায়। স্টাডি ট্যুর ছিল। সেখান থেকে এত বিপর্যয়- ভাবতে পারে না নয়না।
তুই আমার মেয়ে একটা হিন্দু ছেলের সাথে!আরো কত কিছু শুনতে হলো। জন্মের পর কারো গায়ে লেগে থাকে না,সে হিন্দু না মুসলমান। কথাটা শুনে তার মামা তাকে মুরতাদ বলেছিল!
আর এখন এই মুরতাদ মেয়েটি সমাজের চোখে ভালো থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে হাসাপাতালে যাচ্ছে। তার নারীবাদি মা’র মানসম্মানের ব্যাপার।
দুপুরের রোদে ঝলসানো রাস্তার উপর দিয়ে টয়োটার গাড়িটি ছুটে চলছে ধীর গতিতে।
সিগন্যালে থামার পর,ফুল নিয়ে এলো এক কিশোরী। তার মতোই- হয়ত নির্যাতিত কিংবা নিষ্পেষিত,এখন জীবনযুদ্ধের সৈনিক।
২। ।
কিছুক্ষণ আগে এবরশন করা হয়েছে।
নয়না এখন সুস্থ আছে।
কখন বাসায় নিয়ে যেতে পারব?
রাতের দিকে,ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করেন।
নয়নার কানে কিছু ঢোকে না। সে দেখে মাংসপিন্ড। সেখান থেকে ফুল ফোটার মতো করে ধীরে ধীরে,বাচ্চটির অবয়ব ফুটে উঠছে।
ছোট্ট দু’টি বাদামী রঙ এর হাত,প্রথমে বের হলো। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মুখের আদলটা ফুটে উঠতেই নয়না বলে উঠল- বাবু,আমাকে ক্ষমা করো,আমার যে একটা সমাজ ছিল।
নয়না স্পষ্ট শুনতে পেল,বাচ্চাটি বলছে- আমার কোনো মা ছিল না! আমার কেউ ছিল না। তুমি আমার মা হলে না? তুমি আমার কেউ হলে না?
পাশে দাঁড়ানো নয়নার বাবা কিছু শুনতে পেলেন না।
শুক্রাণুদাতা ছেলেটি তার কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। আর নয়নার মা- নারীবাদি সংঘটনের নেত্রী,নারীর অধিকার নিয়ে কোথাও কথা বলছেন।
ঢাকা শহরে রাতের আকাশের থেকে আকর্ষণীয় হলো,রাতের রাস্তা,সোডিয়াম লাইটের রহস্যময় আলো। মাঝে মাঝে ভেসে আসে ট্রাকের হর্ণ। কী সুস্থির! কী শান্ত! যেন অপেক্ষায় আছে কিছু জানানোর।
রাতের নিঃস্তবদ্ধতা কাউকে কিছু বলতে পারে না;অনেকটা নয়নাদের মতোই- উপভোগ করা যায় কিন্তু অনুভূতির খবর রাখার বেলায় সবাই সমাজ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।