১.
৩৫ বছরের জাহিদা। চতুর্থবারের মত গর্ভধারণ করেছে। আগের তিন সন্তানের জন্ম বাড়িতেই হয়েছে দাইয়ের তত্ত্বাবধানে। তাই এইবারও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই বলেই ধরে নিয়েছে। এমন কি অনেকে যে বাচ্চা ছেলে না মেয়ে সেটা জানার জন্য আলট্রাসনো করে তা-ও সে করতে চায় না।
তার দুই মেয়ে এক ছেলে আছে, এই বাচ্চা ছেলে হোক বা মেয়ে কিছু যায় আসে না। কিন্তু হঠাৎ একদিন উঠানে পা পিছলে পড়ে যায় জাহিদা, শুরু হয় অতিরিক্ত রক্তপাত। কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পর আলট্রাসনো করে জানা গেল তার প্ল্যাসেন্টা (ফুল) জরায়ুর নীচের দিকে জরায়ুমুখের কাছে। বড় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হল। কিন্তু এই পর্যন্ত আসতে আসতে তার শরীরের অর্ধেকের বেশি রক্ত শরীর থেকে বের হয়ে গিয়েছে।
বড় হাসপাতালে আসার সাথে সাথে রক্ত জোগাড় করে অপারেশনের মাধ্যমে বাচ্চা আর ফুল বের করা হল। বাচ্চাকে বাঁচানো যায়নি। মাকেও বাঁচানো যেত না যদি আর আধা ঘন্টাও দেরী হত।
২.
১৯ বছরের রূপালী। প্রথমবারের মত সন্তান ধারণ করেছে।
নিম্ন মধ্যবতী পরিবারের বউ। বয়স কম। নিজের ইচ্ছা থাকলেও শ্বশুর বাড়ির কারুরই বাড়ির বউকে ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে আগ্রহ নেই। তাদের কথা হল, তারা তো কেউ গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের কাছে যায় নি, কই তাদের তো কোনো সমস্যা হয়নি। রূপালীরও তেমন কোন সমস্যা বোধ হয়নি নয় মাস পর্যন্ত, শুধু মাঝে মাঝে একটু মাথা-ব্যথা হওয়া ছাড়া।
নয় মাস পর হঠাৎ করে এক সকালে শুরু হল খিঁচুনি। সারাদিন ধরে একটু পর পর হতেই থাকল। তবু কেউ হাসপাতালে নেবার চেষ্টা করল না। অবশেষে সন্ধ্যার পর প্রতিবেশিদের জোরাজুরিতে নিয়ে আসা হল তাকে হাসপাতালে। হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে দেবার সাথে সাথে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল রূপালী।
৩.
৩১ বছরের ময়না। প্রথমবার গর্ভধারণের পর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। নয় মাসের সময় হঠাৎ বাচ্চার নড়া-চড়া বন্ধ হয়ে গেল। প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে অপারেশন করে সেই মৃত বাচ্চা বের করা হল। কয়েক মাসের মধ্যেই আবারও গর্ভধারণ করল ময়না।
এবারও প্রথম থেকে ডাক্তার দেখানো হয়নি। কিন্তু আট মাসের সময় হঠাৎ রক্তপাত শুরু হলে বড় হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। এখানে চিকিৎসার পর রক্তপাত বন্ধ হল। তাকে পরামর্শ দেয়া হল যেহেতু প্ল্যাসেন্টা জরায়ুর মুখের কাছে আছে আর তার আগেও একটা অপারেশন হয়েছে, সে যেন আর কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালেই থাকে, এরপর অপারেশন করা হবে। কিন্তু হাসপাতালে থাকা কষ্ট বলে ময়না একরকম জোর করেই বাড়িতে চলে গেল।
কয়েক সপ্তাহ পর আবারও ছোট-খাটো ক্লিনিকে গিয়ে অপারেশন করাল। বাচ্চা সুস্থই ছিল, কিন্তু ময়নার অবস্থা খারাপ হতে থাকল। সারারাত যমে-মানুষে টানাটানি করার পর ভোরবেলা বড় হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। এখানে আবারও অপারেশন করে দেখা গেল তার জরায়ু ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে আছে, রক্তপাত হয়ে হয়ে শরীরে আর রক্ত নেই বললেই চলে। জরায়ুটা আর রাখা গেল না, কেটে ফেলতেই হল।
কোনমতে ময়নার জীবনটা বাঁচানো গেল। কিন্তু সে আর কোনদিন সন্তান ধারণ করতে পারবে না।
এমন আরও কত হাজার হাজার ময়না, রূপালী, জাহিদা আছে আমাদের দেশে। বলতে গেলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এদের জীবনটাতো এরকম হওয়ার ছিল না।
শুধু যদি তারা একটু সচেতন হত, তাহলেই মা-সন্তান দুজনেই সুস্থ হয়ে বাঁচতে পারত। সবাইকেই যে বড় হাসপাতালে যেতে হবে বা বড় ডাক্তার দেখাতে হবে তা নয়, সবার সেই সামর্থ্যও থাকে না। কিন্তু গর্ভাবস্থায় যদি অন্তত কাছের কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও যায়, তাহলে অন্তত এই সমস্যাগুলো আগে থেকে চিহ্নিত করা যায়। প্রয়োজনবোধে সময়মত বড় হাসপাতালে পাঠানো যায়। এতটুকু করা গেলেও তো এই অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনাগুলো ঠেকানো যায়।
একজন মেয়ে যখন গর্ভধারণ করে তখনই সে মা, তার গর্ভের বাচ্চাটা তখনই একজন সন্তান। একজন মা তার সন্তানকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেন। পরিবারের নতুন অতিথির জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। তবে কেন মা আর তার অনাগত সন্তানের সুস্থতার জন্য আরেকটু সচেতন হয় না মানুষ, কেন তাদের প্রতি এত অবহেলা?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।