আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

◄ ইসলামে উত্তরাধিকার আইন : আসুন জানি ► ইসলামে আর্থিক সুবিধা পুত্রের চেয়ে কন্যার বেশি ◄



পত্রপত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে, সদ্য প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতিতে সরকার উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষকে সমান করতে চাচ্ছে। তা করা হলে কুরআনের সূরা নিসার আয়াত নম্বর ১১-এর নির্দেশিত বিধানের সরাসরি লঙ্ঘন করা হবে। অথচ এটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে পুত্রের চেয়ে কন্যার আর্থিক অধিকার এবং সুবিধা বেশি। নিচের বিশ্লেষণই তা প্রমাণ করবে।

আমার নিজের কথাই বলি। আমরা অনেক ভাই-বোন ছিলাম। আমার মরহুম আব্বার সমগ্র সম্পত্তির মূল্য আজকের বাজারদরে প্রায় ৯০ লাখ টাকা হবে। আমরা প্রত্যেক ভাই ১৫ লাখ টাকার উত্তরাধিকারী হয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বোন সাড়ে সাত লাখ টাকার উত্তরাধিকারী হয়েছিল। অর্থাৎ আমার সুবিধা বোনের তুলনায় ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেশি ছিল।

অন্য দিকে ইসলামি বিধান মোতাবেক (কুরআনে সূরা বাকারা, সূরা নিসা ও সূরা তালাক) আমাকে আমার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার ভরণপোষণ ব্যয় বহন করতে হয়েছে। আজকের মূল্যে তা অন্তত ৩০ হাজার টাকা মাসিক খরচ হবে। আমার স্ত্রী ৩০ বছর বিবাহিত জীবনের পর মারা যান। এ সময় আমাকে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে ৩০ বছর ধরে ব্যয় করতে হয়েছিল, যার পরিমাণ (৩০,০০০কô১২কô৩০) এক কোটি আট লাখ টাকা। এর পরও পিতা হিসেবে আমার কন্যার জন্য আমাকে অনেক খরচ করতে হয়।

অন্য দিকে আমার বোনকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি বোনের স্বামী, পুত্র বা কন্যার ভরণপোষণের জন্য। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক তারা এর জন্য দায়িত্বশীল নয়। অর্থাৎ ভরণপোষণের ক্ষেত্রে যেখানে আমাকে এক কোটি আট লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, সেখানে এ পরিমাণ অর্থ আমার বোনকে ব্যয় করতে হয়নি। এ ক্ষেত্রে বোনের সুবিধা এক কোটি আট লাখ টাকা। যদি আমার সাড়ে সাত লাখ টাকা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অধিক সুবিধা বাদ দেয়া হয় তাহলে বোনের নিট সুবিধা হয় (১,০৮,০০,০০০-৭,৫০,০০০=১,০০,৫০,০০০/-) এক কোটি পঞ্চাশ হাজার টাকা।

এ হিসাবে আমি মোহরানা ধরিনি। অসংখ্য ক্ষেত্রে হিসাব করে দেখেছি, সার্বিক আর্থিক সুবিধা ইসলামি বিধানে পুত্রের চেয়ে কন্যার বেশি। পিতামাতার উত্তরাধিকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমান। ভাইবোনরা, যে ক্ষেত্রে তারা উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সমান পান। এসব ক্ষেত্রেও সব শ্রেণীর পুরুষের আর্থিক দায়িত্ব নারীর চেয়ে একইভাবে বেশি।

হিসাব করে দেখেছি, আমেরিকার জনগণ যদি ইসলামি আইন অনুসরণ করে, তাহলে নারীরাই অধিক সুবিধা পাবে। সেখানে উত্তরাধিকার খুব সামান্যই পাওয়া যায়। কেননা বেশির ভাগ মানুষ ক্রেডিট কার্ডে চলে, তাদের সঞ্চয় নেই বা থাকলেও তা খুবই সামান্য ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে। সে দেশে মাসিক খরচ যদি মাত্র দুই হাজার ডলারও ধরি তাহলে ৩০ বছরের বিবাহিত জীবনে ইসলামি আইন মোতাবেক নারীর সুবিধা হবে (২০০০কô১২কô৩০) ৭,২০,০০০ ডলার (বাংলাদেশী টাকায় ৭,২০,০০০কô৭০=৫,০৪,০০,০০০/- (পাঁচ কোটি চার লাখ টাকা)। এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আশা করি এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, পুরুষ ও নারীর আর্থিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলাম মূলত নারীদের অধিক সুবিধা দিয়েছে।

তাই উত্তরাধিকার আইন বদলের যেকোনো প্রচেষ্টা অপ্রয়োজনীয়। তদুপরি ৯০ ভাগ মুসলিম অধিবাসীর বাংলাদেশে এ ধরনের সরাসরি কুরআন-বিরোধী বিধান প্রবর্তন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে। আমি সরকারকে অনুরোধ করি, যেন তারা এ উদ্যোগ থেকে সরে আসেন। নারীদের সব ধরনের অধিকার দেয়া হোক, তাদের অধিকার যাতে তারা সত্যিকার অর্থেই পায় এবং কেবল কথায় যাতে তা সীমাবদ্ধ না থাকে, তার জন্য ব্যবস্খা নিন।

কিন্তু সরাসরি কুরআন ও ধর্মের সাথে সংঘর্ষশীল ব্যবস্খা নেবেন না। এসব বিধান ভালো করে কার্যকরও হয় না। যেসব আইনের পেছনে নৈতিকতার সমর্থন রয়েছে, ধর্মের সমর্থন রয়েছে, সেগুলো বেশি কার্যকর হয়। ধর্মবিরোধী আইন কখনোই সত্যিকার অর্থে কার্যকর হয় না। কেননা আইনের পেছনে দরকার নৈতিক ভিত্তি।

লেখক : শাহ আব্দুল হান্নান সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার *.*.*.* ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করার প্রচেষ্টা সম্পদে বোনের অধিকার ভাইয়ের অর্ধেক আমাদের আজকের লেখায় ইসলামী উত্তারাধিকার আইনের বর্ণনা দেয়া উদ্দেশ্য নয়। এনিয়ে ইসলামী আইনবিদদের লেখা শত শত ভলিউম লেখা আছে । যে কেউ সেগুলো পড়তে পারেন। বরং, আমাদের আজকের লেখার শুরুতে বলব, এই আইনগুলো কে, কেন দিয়েছেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এগুলো মানলে কি লাভ ও না মানলে কি ক্ষতি হবে তাও উল্লেখ করব।

পরিশেষে আমরা এই আইনগুলো প্রয়োগের সময় রাসুলুল্লাহ সা: ও সাহাবীদের রা: কর্তৃক গৃহিত কিছু মৌলিক দিকনির্দেশনা এবং বাস্তবের বিভিন্ন সমস্যায় কি ভাবে আল-কোরআনের নিয়মাবলী প্রয়োগ করা হয়েছে সেগুলোর কিছু উদাহরণ উল্লেখ করব। ইনশাল্লাহ। ► ইসলামী উত্তারাধিকার আইন : সুরা নিসা◄ → নিসা ৭ : পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশী। এ অংশ (আল্লাহর পক্ষ থেকে) নির্ধারিত। আয়াতে সুস্পষ্টভাবে পাঁচটি আইনগত নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এক, মীরাস কেবল পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও অধিকার। দুই, যত কমই হোক না কেন মীরাস অবশ্যি বন্টিত হতে হবে। এমন কি মৃত ব্যক্তি যদি এক গজ কাপড় রেখে গিয়ে থাকে এবং তার দশজন ওয়ারিস থাকে, তাহলেও তা ওয়ারিসদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। একজন ওয়ারিস অন্যজনের থেকে যদি তার অংশ কিনে নেয় তাহলে তা আলাদা কথা। তিন, এ আয়াত থেকে একথাও সুস্পষ্ট হয়েছে যে, মীরাসের বিধান স্থাবর-অস্থাবর, কৃষি-শিল্প বা অন্য যে কোন ধরনের সম্পত্তি হোক না কেন সব ক্ষেত্রে জারী হবে।

চার, এ থেকে জানা যায় যে, মীরাসের অধিকার তখনই সৃষ্টি হয় যখন মৃত ব্যক্তি কোন সম্পদ রেখে মারা যায়। পাঁচ, এ থেকে এ বিধানও নির্দিষ্ট হয় যে, নিকটতম আত্মীয়ের উপস্থিতিতে দূরতম আত্মীয় মীরাস লাভ করবে না। → নিসা ৮ : সম্পত্তি বন্টনের সময় যখন আত্নীয়-স্বজন, এতীম ও মিসকীন উপস্খিত হয়, তখন তা থেকে তাদের কিছু দিয়ে দাও এবং তাদের সাথে কিছু সদালাপ করো। এখানে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিসদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ মীরাস বন্টনের সময় নিকট ও দূরের আত্মীয়রা, নিজের গোত্রের ও পরিবারের গরীব মিসিকন লোকরা এবং এতিম ছেলেমেয়ে যারা সেখানে উপস্থিত থাকে, তাদের সাথে হৃদয়হীন ব্যবহার করো না।

শরীয়াতের বিধান মতে মীরাসে তাদের অংশ নেই ঠিকই কিন্তু একটু ঔদার্যের পরিচয় দিয়ে পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে তাদেরকেও কিছু দিয়ে দাও। সাধারণভাবে এহেন অবস্থায় সংকীর্ণমনা লোকরা যে ধরনের হৃদয়বিদারক আচরণ করে ও নির্মম কথাবার্তা বলে,তাদের সাথে তেমনটি করো না। → নিসা ৯ : লোকদের একথা মনে করে ভয় করা উচিত যে, তারা যদি মরার সময় নিজেদের পশ্চাতে দুর্বল অক্ষম সন্তান-সন্ততি ছেড়ে যেত তাহলে তাদের জন্যে তারা কতই না আশঙ্কা করত। সুতরাং তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং ন্যায় সংগত কথা বলে। → *নিসা ১১ : তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেনঃ পুরুষদের অংশ দুজন মেয়ের সমান।

মীরাসের ব্যাপারে এটি প্রথম ও প্রধান মৌলিক বিধান যে, পুরুষদের অংশ হবে মেয়েদের দ্বিগুণ। যেহেতু পারিবারিক জীবন ক্ষেত্রে শরীয়াত পুরুষদের ওপর অর্থনেতিক দায়িত্বের বোঝা বেশী করে চাপিয়ে এবং অনেকগুলো অর্থনৈতিক দায়িত্ব থেকে মেয়েদেরকে মুক্তি দিয়েছে,তাই মীরাসের ব্যাপারে মেয়েদের অংশ পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম রাখা হবে, এটিই ছিল ইনসাফের দাবী। যদি (মৃতের ওয়ারিস) দুয়ের বেশী মেয়ে হয়, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দুভাগ তাদের দাও। দু’টি মেয়ের ব্যাপারেও এই একই বিধান কার্যকর। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির যদি কোন পুত্রসন্তান না থাকে এবং সবগুলোই থাকে কন্যা সন্তান, কন্যাদের সংখ্যা দুই বা দু’য়ের বেশী হোক না কেন, তারা সমগ্র পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দু’ভাগ পাবে।

অবশিষ্ট তিনভাগের একভাগ অন্যান্য ওয়ারিসদের মধ্য বন্টন করা হবে। কিন্তু যদি মৃত ব্যক্তির শুধুমাত্র একটি পুত্র থাকে, তাহলে এ ব্যাপারে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে অর্থাৎ ফিকাহবিদগণ সবাই এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, অন্যান্য ওয়ারিসদের অনুপস্থিতিতে সে-ই সমস্ত সম্পত্তির ওয়ারিস হবে। আর যদি অন্যান্য ওয়ারিসরাও থাকে, তাহলে তাদের অংশ দিয়ে দেবার পর বাকি সমস্ত সম্পত্তিই সে পাবে। আর যদি একটি মেয়ে ওয়ারিস হয়, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক তার। যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে , তাহলে তার বাপ-মা প্রত্যেকে সম্পত্তির ছয় ভাগের একভাগ পাবে।

অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার বাপ-মা প্রত্যেকে ছয়ভাগের একভাগ পাবে। আর সন্তান যদি সবগুলোই হয় কন্যা বা সবগুলোই পুত্র অথবা পুত্র কন্যা উভয়ই হয় বা একটি পুত্র অথবা একটি কন্যা হয়, তাহলে বাকি তিনভাগের দু’ভাগে এ ওয়ারিসরা শরীক হবে। আর যদি তার সন্তান না থাকে এবং বাপ-মা তার ওয়ারিস হয়, তাহলে মাকে তিন ভাগের একভাগ দিতে হবে । বাপ-মা ছাড়া যদি আর কেই ওয়ারিস না থাকে তাহলে বাকি তিনভাগের দু’ভাগ বাপ পাবে। অন্যথায় তিনভাগের দু’ভাগে বাপ ও অন্যান্য ওয়ারিসরা শরীক হবে।

যদি মৃতের ভাই-বোনও থাকে, তাহলে মা ছয় ভাগের একভাগ পাবে। ভাই-বোন থাকলে মায়ের অংশ তিনভাগের এক ভাগের পরিবর্তে ছয় ভাগের একভাগ করে দেয়া হয়েছে। এভাবে মায়ের অংশ থেকে যে ছয় ভাগের এক ভাগ বের করে নেয়া হয়েছে তা বাপের অংশে দেয়া হবে। কেননা এ অবস্থায় বাপের দায়িত্ব বেড়ে যায়। মনে রাখতে হবে, মৃতের বাপ-মা জীবিত থাকলে তার ভাই-বোনরা কোন অংশ পাবে না।

(এ সমস্ত অংশ বের করতে হবে) মৃত ব্যক্তি যে অসিয়ত করে গেছে তা পূর্ণ করার এবং এ যে ঋণ রেখে গেছে তা আদায় করার পর। অসিয়তের বিষয়টি ঋণের আগে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ঋণ রেখে মারা যাওয়া কোন জরুরী বিষয় নয়। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত করা তার জন্য একান্ত জরুরী। তবে বিধানের গুরুত্বের দিক দিয়ে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে একমত যে, ঋণের স্থান অসিয়তের চাইতে অগ্রবর্তী। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে মারা যায়, তাহলে সর্বপ্রথম তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তি থেকে তা আদায় করা হবে, তারপর অসিয়ত পূর্ণ করা হবে এবং সবশেষে মীরাস বন্টন করা হবে।

অসিয়ত সম্পর্কে সূরা বাকারার ১৮২ টীকায় আমি বলেছি, কোন ব্যক্তি তার সমগ্র সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত অসিয়ত করতে পার। অসিয়তের এই নিয়ম প্রবর্তনের কারণ হচ্ছে এই যে, মীরাসী আইনের মাধ্যমে যেসব আত্মীয়-স্বজন পরিত্যক্ত সম্পত্তির কোন অংশ পায় না, এখান থেকে তাদের যাকে যে পরিমাণ সাহায্য দেবার প্রয়োজন উপলদ্ধি করা হয়, তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন কোন এতিম নাতি বা নাতনী রয়েছে। মৃত পুত্রের কোন বিধবা স্ত্রী কষ্টে জীবন যাপন করছে। অথবা কোন ভাই, বোন, ভাবী, ভাই-পো, ভাগিনে বা কোন আত্মীয় সাহায্য-সহায়তা লাভের মুখাপেক্ষী।

এ ক্ষেত্রে অসিয়তের মাধ্যমে তাদের অন্য হকদারদের জন্য বা কোন জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পত্তির অংশ অসিয়ত করা যেত পারে। সারকথা হচ্ছে এই যে, সম্পদ-সম্পত্তির তিন ভাগের দু’ভাগ বা তার চাইতে কিছু বেশী অংশের ওপর ইসলামী শরীয়াত মীরাসের আইন বলবৎ করেছে। শরীয়াতের মনোনীত ওয়ারিসদের মধ্যে তা বন্টন করা হবে। আর তিন ভাগের এক ভাগ বা তার চেয়ে কিছু কম অংশের বন্টনের দায়িত্বভার নিজের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। নিজের বিশেষ পারিবারিক অবস্থার প্রেক্ষিতে (যা বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়ে থাকে) সে যেভাবে সংগত মনে করবে বন্টন করার জন্য অসিয়ত করে যাবে।

তারপর কোন ব্যক্তি যদি তার অসিয়তে জুলুম করে অথবা অন্য কথায় নিজের ইখতিয়ারকে এমন ত্রুটিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে যার ফলে কারো বৈধ অধিকার প্রভাবিত হয়, তাহলে এর মীমাংসার দায়িত্ব পরিবারের লোকদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। তারা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এ ত্রুটি সংশোধন করে নেবে অথবা ইসলামী আদালতের কাযীর কাছে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানাবে এবং তিনি অসিয়তের ত্রুটি দূর করে দেবেন। তোমরা জানো না তোমাদের বাপ-মা ও তোমাদের সন্তানদের মধ্যে উপকারের দিক দিয়ে কে তোমাদের বেশী নিকটবর্তী । এসব অংশ আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন । আর আল্লাহ অবশ্যি সকল সত্য জানেন এবং সকল কল্যাণময় ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন।

মীরাসে আল্লাহ প্রদত্ত আইনের গভীর তত্ত্ব উপলব্ধি করতে যারা সক্ষম নয়, এ ব্যাপারে যাদের জ্ঞান অজ্ঞতার পর্যায়ভুক্ত এবং যারা নিজেদের অপরিপক্ক বুদ্ধির সাহায্যে (তাদের জ্ঞান অনুযায়ী) আল্লাহর এই আইনের ত্রুটি দূর করতে চায়,তাদেরকে এ জবাব দেয়া হয়েছে। → নিসা ১২ : তোমাদের স্ত্রীরা যদি নিঃসন্তান হয়, তাহলে তারা যা কিছু ছেড়ে যায় তার অর্ধেক তোমরা পাবে। অন্যথায় তাদের সন্তান থাকলে যে অসিয়ত তারা করো গেছে তা পূর্ণ করার এবং যে ঋণ তারা রেখে গেছে তা আদায় করার পর পরিত্যক্ত সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পাবে। অন্যথায় তোমাদের সন্তান থাকলে তোমাদের অসিয়ত পূর্ণ করার ও তোমাদের রেখে যাওয়া ঋণ আদায় করার পর তারা সম্পত্তির আট ভাগের একভাগ পাবে। অর্থাৎ একজন স্ত্রী হোক বা একাধিক তাদের যদি সন্তান থাকে তাহলে তারা আট ভাগের একভাগ এবং সন্তান না থাকলে চার ভাগের এক ভাগ পাবে।

আর এ চার ভাগের এক ভাগ বা আট ভাগের একভাগ সকল স্ত্রীর মধ্যে সমানভাবে বন্টিত হবে। আর যদি পুরুষ বা স্ত্রীলোকের ( যার মীরাস বন্টন হবে) সন্তান না থাকে এবং বাপ-মাও জীবিত না থাকে কিন্তু এক ভাই বা এক বোন থাকে, তাহলে ভাই ও বোন প্রত্যেকেই ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে। তবে ভাই-বোন একজনের বেশী হলে সমগ্র পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের একভাগে তারা সবাই শরীক হবে, অবশিষ্ট ছয় ভাগের পাঁচ ভাগ বা তিন ভাগের দু’ভাগ থেকে অন্য কোন ওয়ারিস থাকলে তার অংশ পাবে। অন্যথায় অবশিষ্ট ঐ সমস্ত সম্পত্তি ঐ ব্যক্তি অসিয়ত করতে পারবে। এ আয়াতের ব্যাপারে মুফাস্‌সিরগণের ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে যে, এখানে মা-শরীক ভাই-বোনর কথা বলা হয়েছে।

অর্থাৎ মৃতের সাথে তার আত্মীয়তা কেবলমাত্র মায়ের দিক থেকে এবং তাদের বাপ আলাদা। আর সহোদর এবং বৈমাত্রের ভাই-বোনের ব্যাপারে, মৃতের সাথে বাপের দিক থেকে যাদের আত্মীয়তা, তাদের সম্পর্কিত বিধান এ সূরার শেষের দিকে বিবৃত হয়েছে। যে অসিয়ত করা হয়েছে তা পূর্ণ করার এবং যে ঋণ মৃত ব্যক্তি রেখে গেছে তা আদায় করার পর যদি তা ক্ষতিকর না হয় । অসিয়ত যদি এমনভাবে করা হয় যে,তার মাধ্যমে হকদার আত্মীয়দের হক নষ্ট হয়, তাহলে এ ধরনের অসিয়ত হয় ক্ষতিকর। আর নিছক হকদারদেরকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি যখন অনর্থক নিজের ওপর এমন কোন ঋণের স্বীকৃতি দেয়, যা সে প্রকৃতপক্ষে নেয়নি, অথবা হকদারকে মীরাস থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে এমনি কোন কূটচাল চালে, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ঋণও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

এ ধরনের ক্ষতিকারক বিষয়কে কবীরা গোনাহ গণ্য করা হয়েছে। তাই হাদীসে বলা হয়েছে, অসিয়তের ক্ষেত্রে অন্যকে ক্ষতি করার প্রবণতা বড় গোনাহের অন্তরভূক্ত। অন্য একটি হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মানুষ তার সারা জীবন জান্নাতবাসীদের মতো কাজ করতে থাকে কিন্তু মারার সময় অসিয়তের ক্ষেত্রে অন্যের ক্ষতি করার ব্যবস্থা করে নিজের জীবনের আমলনামাকে এমন কাজের মাধ্যমে শেষ করে যায়, যা তাকে জাহান্নামের অধিকারী করে দেয়। এ ক্ষতি করার প্রবণতা ও অন্যের অধিকার হরণ যদিও সর্বাবস্থায় গোনাহ তবুও ‘কালালাহ’-এর (যে নিসন্তান ব্যক্তির বাপ-মাও জীবিত নেই) ব্যাপারে মহান আল্লাহ বিশেষ করে এর উল্লেখ এ জন্য করেছেন যে, যে ব্যক্তির সন্তানাদি নেই আবার বাপ-মাও জীবিত নেই, তার মধ্যে সাধারণত নিজের সম্পদ-সম্পত্তি নষ্ট করার প্রবণতা কোন না কোনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং সে দূরবর্তী আত্মীয়দেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রচেষ্টা চালায়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ, আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী ও সহিষ্ণু।

আল্লাহর জ্ঞানের কথা উচ্চারণ করার পেছনে এখানে দু’টি কারণ রয়েছে। এক, যদি এ আইন ও বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করা হয় তাহলে মানুষ আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না। দুই, আল্লাহ যে অংশ যেভাবে নির্ধারণ করেছেন তা একেবারেই নির্ভুল। কারণ যে বিষয়ে মানুষের কল্যাণ ও সুবিধা তা মানুষের চেয়ে আল্লাহ ভালো জানেন। এই সংগে আল্লাহর ধৈয্য ও সহিষ্ণুতা গুনের কথা বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এ আইন প্রবর্তনের ব্যাপারে আল্লাহ কোন কঠোরতা আরোপ করেননি।

বরং তিনি এমন নীতি-নিয়ম প্রবর্তন করেছেন যা মেনে চলা মানুষের জন্য অত্যন্ত সহজ এবং এর ফলে মানুষ কোন কষ্ট, অভাব ও সংকীর্ণতার মুখোমুখি হবে না। → নিসা ১৩-১৪ : এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে কেউ আল্লাহ ও রসূলের আদেশমত চলে, তিনি তাকে জান্নাত সমূহে প্রবেশ করাবেন, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এ হল বিরাট সাফল্য| যে কেউ আল্লাহ্ ও রসূলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন।

সে সেখানে চিরকাল থাকবে। তার জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। → নিসা ১৭৬ : লোকেরা তোমার কাছে পিতা-মাতাহীন নিসন্তান ব্যক্তির *২২০ ব্যাপারে ফতোয়া জিজ্ঞেস করছে। বলে দাও, আল্লাহ তোমাদের ফতোয়া দিচ্ছেনঃ যদি কোন ব্যক্তি নিসন্তান মারা যায় এবং তার একটি বোন থাকে, *২২১ তাহলে সে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধাংশ পাবে। আর যদি বোন নিসন্তান মারা যায় তাহলে ভাই হবে তার ওয়ারিস।

*২২২ দুই বোন যদি মৃতের ওয়ারিস হয়, তাহলে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশের হকদার হবে, *২২৩ আর যদি কয়েকজন ভাই ও বোন হয় তাহলে মেয়েদের একভাগ ও পুরুষের দুইভাগ হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট বিধান বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা বিভ্রান্ত না হও এবং আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে জানেন। ২২০)মূল বাক্যে কালালা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘কালালা’ শব্দের অর্থের ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। কারো কারো মতো কালালা হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যার সন্তান নেই এবং যার বাপ-দাদাও বেঁচে নেই।

আবার অন্যদের মতে যে ব্যক্তি নিছক নিসন্তান অবস্থায় মারা যায় তাকে কালালা বলা হয়। হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু শেষ সময় পর্যন্ত এ ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতে প্রথমোক্ত লোকটিকেই কালালা বলা হয়। সাধারণ ফকীহগণ তাঁর এই মত সমর্থন করেছেন। কুরআন থেকেও এই মতেরই সমর্থন পাওয়া যায়।

কারণ কুরআন কালালার বোনকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক বানানো হয়েছে। অথচ কালার বাপ বেঁচে থাকলে বোন সম্পত্তির কিছুই পায় না। ২২১)এখানে এমন সব ভাইবোনের মীরাসের কথা বলা হচ্ছে যারা মৃতের সাথে মা ও বাপ উভয় দিক দিয়ে অথবা শুধুমাত্র বাপের দিক দিয়ে শীরক। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার তাঁর এক ভাষণে এই অর্থের ব্যাখ্যা করেছিলেন। কোন সাহাবা তাঁর এই ব্যাখ্যার সাথে মতবিরোধ করেননি।

ফলে এটি একটি সর্বসম্মত মতে পরিণত হয়েছে। ২২২)অর্থাৎ ভাই তার সমস্ত সম্পদের ওয়ারিশ হবে, যদি কোন নির্দিষ্ট অংশের অন্য কোন অধিকারী না থেকে থাকে। আর যদি নির্দিষ্ট অংশের অন্য কোন অধিকারী থাকে-যেমন স্বামী তাহলে প্রথমে তার অংশ আদায় করার পর অবশিষ্ট পরিত্যক্ত সম্পত্তি ভাই পাবে। ২২৩)দু’য়ের বেশী বোন হলে তাদের সম্পর্কেও এই একই বিধান কার্যকর হবে। এখানে যা বলা হয়েছে তা সংক্ষেপে ১. মীরাসে আল্লাহ প্রদত্ত আইনের গভীর তত্ত্ব যারা জানতে সক্ষম নয়, এব্যাপারে যাদের জ্ঞান অজ্ঞতার পর্যায়ভূক্ত, এবং যারা অপরিপক্ষ বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহর আইনের ত্রুটি (!) দূর করতে চায়, তাদের কে যাবধান করা হয়েছে।

২. আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণকারীরা আল্লাহর পাকড়াও থেকে রেহাই পাবে না। ৩. আল্লাহ যে নিয়মাবলী বর্ণনা করেছেন তা একেবারে নির্ভূল। ৪. তিনি কঠোরতা অবলম্বন করেন নি, যেসব আইন তিনি দিয়েছেন সেগুলো মানা মানুষের জন্য সহজ। ৫. আল্লাহর বিধান মান্য কারীদের জন্য জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে। http://www.facebook.com/tafhimul Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।