আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশ সরকার এবং প্রশাসন সর্বত্রই নৈরাজ্য চলছে



০৪ মার্চ ২০১১ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বিশেষ সাক্ষাতকার কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, দেশ ঠিকমতো চলছে না। সরকারও না। আমলারাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দেশ, সরকার এবং প্রশাসন সর্বত্রই চরম নৈরাজ্য চলছে। মন্ত্রীরা ফ্রিস্টাইলে চলছেন।

তারা একেকজন একেক কথা বলছেন। একজনের কথার সঙ্গে অন্যজনের কথায় কোন মিল নেই। আমলারাও কথা শুনছেন না। শোনা যাচ্ছেছ প্রধানমন্ত্রী একাই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দুই বছরের মূল্যায়ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের রায় কার্যকর, দুর্নীতি, শেয়ারবাজার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্বসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সাক্ষাৎকারে খোলামেলা কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। একইভাবে অযোগ্য মন্ত্রী দিয়েও সরকার সফলতা অর্জন করতে পারবে না। যারা অযোগ্য তাদের বাদ দিয়ে মন্ত্রপরিষদ ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আর সময়ক্ষেপণ না করে নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি পূরণের বিষয়টি মাথায় রেখে সবকিছু নতুন করে বিন্যাস করতে হবে।

মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও দলীয় ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে সামনে সমূহ বিপদ আছে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামল থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে। এটাকে বর্তমান সরকারের সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর বাইরে সাফল্য বলতে খুব সামান্যই।

শিক্ষা ও কৃষি ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কিš‘ আইন-শৃঙ্খলা পরি¯ি’তির চরম অবনতি ঘটেছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দলীয়করণ আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যাঁতাকলে মানুষ পিষ্ট হচ্ছেছ। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, বর্তমান সরকার নির্বাচনের আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল। এক্ষেত্রে তারা স¤পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কশাঘাত দিন দিন আরও তীব্র হয়েছে। নির্বাচনের আগে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্র“তি দিলেও সরকারের দুই বছরের মাথায় এসে দেখা গেছে বেকারত্বের অভিশাপ বেড়েছে বৈ কমেনি। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে লুটপাট হচ্ছেছ। চিহ্নিত কিছু লোক শেয়ারবাজারকে ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক বনে গেলেও প্রায় ৩০ লাখ ক্ষুদে বিনিয়োগকারী আজ পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছে। অথচ সরকার নির্বিকার।

তাদের ভূমিকা জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। যে কারণে মানুষের মুখে মুখে আজ একটি কথা চালু হয়ে গেছে ‘সব সরকারেরই দাঁতে বিষ। তফাৎ শুধু উনিশ-বিশ। তিনি বলেন, প্রশাসন বিকেন্দীকরণ করে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে সেসব জায়গায় সংসদ সদস্য এবং আমলাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার বদলে এমপিতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে।

দুর্নীতিকে বিকেন্দীকরণ করা হয়েছে। দুর্নীতির পরিমাণ বেড়েছে কিনা তা বলতে পারব না। সবাই দেখছে তৃণমূল পর্যায় দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছেছ না। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি এসব নিয়েই সরকারদলীয় ক্যাডাররা ব্যস্ত।

ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সরকারি দরেলর ক্যাডাররা মারামারি করছে। নিজেরাই নিজেদের লোককে খুন করছে। প্রধানমন্ত্রী দফায় দফায় চরম হুশিয়ারি দিয়েও তাদের নিবৃত্ত করতে পারছেন না। পারবেন কিভাবে? তিনি তো চারদলীয় জোট সরকারের মতোই লুটপাটের অর্থনীতি চালু রেখেছেন। এক সময়কার তুখোড় এই ছাত্র নেতা বলেন, লুটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিযোগিতার প্রধান ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

দেশী-বিদেশী শোষকরাও এটাই চায়। তারা চায় লুটপাটের রাজত্ব থাকুক। তাহলে একবার সরকারে এ পক্ষকে আনা সম্ভব হবে। আরেকবার অন্য পক্ষকে আনা যাবে। কিš‘ শোষণ ব্যব¯’া অব্যাহত থাকবে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বর্তমান সরকার এ ধরনের দ্বিমেরুকরণভিত্তিক রাজনীতির ছকের ফাঁদে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। যে কারণে সাধারণ মানুষের অবস্থা ‘ত্রাহি মধুসূদন’। দেশের মানুষ আজ ফুটন্ত কড়াইয়ে তপ্ত হচ্ছেছ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে তারা জ্বলন্ত উনুনে দগ্ধ হয়েছে। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে আবার ঝাঁপ দিয়ে মানুষ পরিত্রাণ পাবে না।

তিনি বলেন, একথা ঠিক বর্তমান সরকারের সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। তবে সব অপরাধীর শাস্তি এখনও হয়নি। স্বঘোষিত ঘাতকদের কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড এবং আরও কয়েকজনের বিচারের রায় হলেও এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক চক্রান্ত প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল তার স্বরূপ উদঘাটন করা হয়নি। বিচারের কাঠগড়ায় এখনও সেসব শক্তিকে দাঁড় করানো হয়নি। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এ বিষয়ে সরকারের কোন আগ্রহ আছে বলেও মনে হয় না।

হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত আন্তর্জাতিক শক্তিকে অসš‘ষ্ট করলে ক্ষমতায় থাকা সমস্যা হতে পারে মনে করেই হয়তো এ কর্তব্যটি পালনের কথা সরকার ভুলে গেছে। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির পক্ষে শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলার জন্য যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো উচিত সেদিকেও সরকারের মনোযোগ নেই বললেই চলে। যে কোন অপছন্দনীয় ঘটনাকে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করার ষড়যন্ত্র’ বলে এক কথায় দায়িত্ব সেরে ফেলা হচ্ছেছ। অথচ ঘরে ঘরে ব্যাখ্যামুলকত শক্তিশালী রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে না পারলে দেশী-বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করা কঠিন হবে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, অনেকে মনে করেন চারদলীয় জোট এবং মহাজোট সরকার মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

যদিও কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। কিছুটা তফাৎ রয়েছে তাদের মধ্যে। একেকটার জন্ম একেক পটভূমিতে। কিš‘ অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতি ও দর্শনের ক্ষেত্রে দুই দলই সমগোত্রীয়। তারা মার্কিনপন্থী লুটেরা ধনিকদের স্বার্থ রক্ষা করে।

খোলাবাজার অর্থনীতির নামে লুটপাটের অর্থনীতি চালু রেখেছে। তিনি বলেন, রাজনীতি একটি অন্ধ গলির ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল বামপন্থী বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটাতে হবে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, মহাজোট হচ্ছেছ একটি জগাখিচুড়ির জোট। পরস্পরবিরোধী আদর্শের অনুসারী দল এখানে জোটবদ্ধ হয়েছে।

এদের সবারই স্বার্থ হচ্ছেছ ক্ষমতার ভাগ নেয়া। আর এ সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগ রাজনীতিবিমুখ হয়ে গেছে। দলবাজিতেই এখন ব্যস্ত তারা। দলবাজি আর রাজনীতি এক জিনিস নয়। যে কারণে দল ও সরকার কোনটাই ঠিকমতো চলছে না।

তিনি বলেন, সব জায়গায় এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সর্বত্র কথা উঠছেÑ প্রধানমন্ত্রী একাই সবকিছু করছেন। যদি তাই হয় তাহলে প্রশ্ন হচ্ছেছ সকাল-বিকাল এদিক-ওদিক হয়ে যায় কেন? আমলারাও স্বাধীন। তাদের ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার পরিচালনায় এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বিএনপি জন্ম থেকেই দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দল। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক সময় মধ্য বামধারায় কিছুটা থাকলেও এখন নিবেদিত মধ্য ডানপন্থী দলে পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই বর্তমান সরকার তেল-গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার পুরনো নীতি অব্যাহত রেখেছে। মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, সরকার সরাসরি শ্রমিকদের বির“দ্ধে মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে চলছে।

সীমান্তে হত্যা হচ্ছেছ। দেশের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে আটক আছে। লিবিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকরা জিম্মি হয়ে আছে। অথচ এসব নিয়ে সরকার নির্বিকার। তারা কথা বলছে না।

কারণ নতজানু পররাষ্ট্রনীতি। সাম্রাজ্যবাদ ও বিদেশী শক্তির প্রতি আনুগত্যের কারণেই সরকার কথা বলতে পারছে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।