বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে বলে আমরা সবাই মোটামুটি একমত। আমাদের স্ত্রী-কন্যারা হিন্দি সিরিয়ালে ডুবে রয়েছে, আমাদের ক্রিকেট ফ্যানরা ক্রিকেট ম্যাচ দেখার ফাকে ফাকে পরিচিত হচ্ছে ভারতীয় পন্যের সাথে, আমরা দেশি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির নাম না জানলেও হালিখানেক ভারতীয় কোম্পানির নাম জানি, আমাদের তরুনরা ভারতীয় রিয়েলিটি শো দেখে কিভাবে কুল হতে হয় সেটা শিখছে, মার্জিত হওয়ার চেষ্টা করা যেখানে ব্যাকডেটেড, আমাদের স্বামী-স্ত্রীরা এখন আরো আত্মবিশ্বাসের সাথে পরকীয়া চালাতে শিখে গেছে, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে আমাদের শিশুরা বাংলা শব্দের চেয়ে হিন্দি শব্দ শিখছে বেশি করে।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে একটা দেশের এমন অনেক কিছুই দখল করে নেয়া যায়, যেটা যুদ্ধ করেও যেতা সম্ভব নয়। সংস্কৃতি বলতে অনেকেই শুধু পার্ফর্মিং আর্ট বুঝে থাকে, যদিও আমরা দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু করছি সবই সংস্কৃতির আওতাভুক্ত। সংস্কৃতি এমন একটি বিষয় যা মানুষ জন্মগতভাবে নিয়ে আসে না, বরং পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শিখে।
মানুষের সংস্কৃতির কিছু অংশ বৈশ্বিক, কিছুটা আঞ্চলিক, আবার কিছুটা একান্তই স্থানীয়। ভারতের সাথে একই অঞ্চলে অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আমাদের অনেক মিল রয়েছে (ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা, গলাবাজির রাজনীতি, কত্থক/মনিপুরী নৃত্য, ধ্রুপদী সংগীত, প্রাচীন মহাকাব্য, রক্ষণশীল সমাজ, পরিবার এবং পরিবারে সদস্যদের ভুমিকা ইত্যাদি)। আবার বৈশ্বিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবেও অনেক কিছুতেই মিল রয়েছে। আবার কিছু রয়েছে আমাদের নিজস্ব। এই নিজস্ব সংস্কৃতিতেও আবার দেশের ভিতরে এলাকাভেদে বিভিন্নতা রয়েছে।
ভারত বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে অনেক মিল থাকলেও কিছু অমিলও রয়েছে। সবচেয়ে বড় অমিল ভাষার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ বাংলা ভাষা প্রধান, ভারত হিন্দি ভাষা প্রধান। লোক সংস্কৃতিতে দুদেশের তেমন কোন বড় পার্থক্য নেই। তবে বড় পার্থক্য রয়েছে মিডিয়ার সংস্কৃতিতে (মূলধারার সিনেমা ছাড়া)।
মানুষের সংস্কৃতি শেখার ক্ষেত্রে বর্তমান যুগে পরিবার বা নিকটবর্তী সমাজের চেয়েও বড় ভুমিকা রাখে মিডিয়া। বাবা-মার সান্নিধ্য বঞ্চিত শিশুটির সংস্কৃতিবোধ-মূল্যবোধ তৈরী ও বিকাশ সবই হচ্ছে মিডিয়ার কল্যাণে। ভারত ও বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতি কাছাকাছি হলেও মিডিয়ার সংস্কৃতি অনেকটাই আলাদা। আমাদের মূল ধারার সিনেমা যেমন বাস্তবতা বিবর্জিত এবং অশ্লীলতা নির্ভর, ভারতেরটাও তাই। আমার ভারতীয় বন্ধুরা বলিউডের সংস্কৃতিকে তাদের জাতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে মানতে নারাজ, ঠিক যেমন আমরা এফডিসির বাংলা সিনেমার সংস্কৃতিকে আমাদের সংস্কৃতি বলে মানতে পারি না।
বড় একটা পার্থক্য রয়েছে টিভি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। আমাদের টিভি অনুষ্ঠান অনেক বেশি লোকসংস্কৃতির কাছাকাছি রয়েছে ভারতীয় টিভি অনুষ্ঠানের চেয়ে। ভারতীয় টিভি শুধুমাত্র তাদের ধনিক শ্রেণীরই প্রতিনিধিত্ব করে। আর সেই টিভিই প্রমোট করে চলে তাদের অশ্লীলতা নির্ভর সিনেমাগুলোকে। সিনেমার সবচেয়ে অশালীন অংশ যে আইটেম গান, ভারতীয় টিভি গুলো সারাদিন অবলীলায় সেগুলো প্রচার করে চলে।
আর এই বলিউডি সংস্কৃতিই আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর আগ্রাসনের জন্য দায়ী।
আমাদের সুশীল সমাজ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত। তারা অশ্লীলতা বিরোধী আন্দোলন করেন, টিভি চ্যানেল বন্ধ করার জন্য চেচামেচি করেন, কিন্তু সাধারণ লোকের বিনোদনের অধিকার নিয়ে কোনকিছু ভাবেন না।
প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে আমি চিন্তিত নই। ২০/২১ বছর বয়সের পর প্রায় সকল মানুষই ভালো-মন্দ যাচাই করার ক্ষমতা অর্জন করে।
কিন্তু শিশু কিশোর, যারা সামাজিকিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের ওপর মিডিয়ার প্রভাব অনেক অনেক বেশি। আমাদের সংস্কৃতির স্বকীয়তা ধরে রাখতে হলে এই স্বকীয় দিকগুলো আকর্ষনীয়ভাবে তরুনদের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রদর্শনি বন্ধ করে বা তরুনদের আকর্ষণ করার জন্য নিজেদের সংস্কৃতির বিকৃতি ঘটিয়ে বলিউডিকরণ করে প্রচার করে স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখা যাবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।