আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

Part-3==Genocide======[[1971]]======Genocide==Part-3

The truth is, everyone is going to hurt you. You just got to find the ones worth suffering for

ট্রাকভর্তি মানুষগুলোকে হত্যা করা হয় অন্তঃতপক্ষে এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ হল যে বারী হিন্দু নয়। তারপরও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। “বল তুমি দৌড় দিয়েছিলে কেন?” এতক্ষণে ওর চোখ বুনো হয়ে উঠল। ওর শরীরও কাঁপছিল প্রচণ্ডভাবে। সে উত্তর দিতে পরছিল না, সে হাঁটু চেপে ধরল।

“স্যার, মনে হচ্ছে ও ফৌজি। ” বারী পা খামচে ধরায় এক জওয়ান মন্তব্য করে। (ফৌজি সৈনিকের উর্দু শব্দ, বাঙালি বিপ্লবীদের পাকসেনারা এই নামে চিহ্নিত করে থাকে। ) “হতে পারে। ” আমি শুনলাম রাঠোর হিংস্রভাবে বিড়বিড় করল।

রাইফেলের বাট দিয়ে প্রচণ্ডভাবে পিটিয়ে আব্দুল বারীকে ভীষণ জোরে ছুঁড়ে দেয়া হল একটি দেয়ালের দিকে। তার আর্তনাদের পর কাছের কুঁড়েঘরের আড়াল থেকে এক তরুণকে উঁকি দিতে দেখা গেল। বাংলায় কী যেন চেঁচিয়ে বলল বারী। মাথাটি সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হল। কিছুক্ষণ পরেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এল এক বুড়ো মানুষ।

রাঠোর তাকে খামচে টেনে আনলো। “এই লোকটাকে তুমি চেন?” “হ্যাঁ সাহেব। ও আব্দুল বারী। ” “সে কি ফৌজি?” “না সাহেব। হে ঢাকায় দর্জির কাম করে।

” “সত্যি কথা বল। ” “খোদার কসম, সাহেব, হে দর্জি। ” হঠাৎ নিরবতা নেমে এলো। রাঠোর অপ্রস্তুত হয়ে তাকালে আমি বললাম, “আল্লাহর দোহাই, ওকে যেতে দাও। ওর নির্দোষিতার আর কত প্রমাণ চাও?” জওয়ানরা তবু সন্তুষ্ট হয় না, তারা বারীকে ঘিরে রাখে।

আরো একবার বলার পর রাঠোর বারীকে ছেড়ে দেবার আদেশ দিলেন। ইতোমধ্যে সে ভয়ে জড়োসড়ো ও কুঞ্চিত হয়ে গেছে। তার জীবন বেঁচে গেল। অন্য সবার ভাগ্যে এমন সুযোগ আসে না। ৯ম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি ছয়দিন কুমিল্লায় ঘুরেছি।

আমি কাছ থেকে দেখেছি গ্রামের পর গ্রাম, বাড়ির পর বাড়ি “অস্ত্র অনুসন্ধান”-এর ছলে খৎনা করা হয়নি এমন লোকদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। কুমিল্লার সার্কিট হাউসে (বেসামরিক প্রশাসনের হেড কোয়ার্টার) মানুষদের মৃত্যুযন্ত্রণার আর্তরব আমি শুনেছি। কারফিউর নামে আমি দেখেছি ট্রাক বোঝাই লোক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খুন করার জন্য। সেনাবহিনীর “হত্যা ও অগ্নিসংযোগ মিশন’-এর পাশবিকতার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। দেখেছি বিপ্লবীদের খতম করার পর কীভাবে গ্রাম-শহরে ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে।

‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ” নিয়ে কীভাবে পুরো গ্রামকে ধ্বংস¯তূপে পরিণত করা হয়েছে তাও আমি দেখেছি। আর রাত্রিবেলা শুনেছি তাদের সারাদিনব্যাপী চালানো হত্যাকাণ্ডের অবিশ্বাসযোগ্য, বর্বর রোমন্থন। “তুমি কয়টা খতম করেছ?” তাদের উত্তর এখনও আমার স্মৃতিতে জ্বলন্ত। যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার বলবে এর সবই করা হয়েছে ‘পাকিস্তানের আদর্শ, সংহতি ও অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখা’-র জন্য। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে।

ভারতের দ্বারা হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুই অংশকে একত্রে রাখার জন্য এই তথাকথিত সামরিক কার্যক্রমই আদর্শের পতনকে প্রমাণ করেছে। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখা সম্ভব একমাত্র কঠোর সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। আর পাকসেনাদল পাঞ্জাবীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যারা ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালিদের অপছন্দ করে, ঘৃণা করে। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় এসেছে যে কিছু বাঙালিকেও পশ্চিম পাকিস্তানী দলের সঙ্গে দেখা গেছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে। ঢাকায় এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় এ-রকম আশ্চর্য অদ্ভুত অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি হয়েছি আমি।

“দুঃখিত”, সে আমাকে বলল, “ছক পাল্টে গেছে। আমি তুমি যে পাকিস্তানকে জানি, তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাকে পেছনেই থাকতে দাও। ” ঘণ্টাখানেক বাদে এক পাঞ্জাবী সেনা-কর্মকর্তা পাকসেনারা পদক্ষেপ নেয়ার আগের অবাঙালিদের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ডের কথা বলা আরম্ভ করল। সে আমাকে বলল, “১৯৪৭-এর দেশবিভাগের সময়কার শিখদের চাইতে পাশবিক আচরণ করেছে তারা।

কীভাবে আমরা তা ভুলতে বা মাফ করতে পারি?” সেনাবাহিনীর এই উম্মত ধ্বংসকার্যের দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটিকে কর্তৃপক্ষ ‘শুদ্ধি অভিযান’ নামে চিহ্নিত করতে পছন্দ করেন যা মূলত ধ্বংসলীলাকেই নরমভাবে উচ্চারণ করা। অপরটি হল ‘পুনর্বাসন-উদ্যোগ”। পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনিবেশ বানানোর প্রচেষ্টাকে এভাবে বর্ণনা করা হয়। এই ঢালাও অভিব্যক্তি এবং ‘দুষ্কৃতিকারী’ ও ‘হামলাকারী’ হিসেবে বারংবার উল্লেখ বিশ্বকে সন্তুষ্ট রাখার প্রয়াস।

কিন্তু প্রচারণার অন্তরালে হত্যা ও উপনিবেশীকরণই হলো বাস্তবতা। হিন্দুদের হত্যালীলার যৌক্তিকতা বিষয়ে ১৮ এপ্রিল রেডিও পাকস্তিান থেকে প্রচারিত পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারি গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের বক্তব্য আমি শুনেছি। তিনি বললেন “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিল, তারা পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিজ্ঞ। কিন্তু হিংস্র ও আগ্রাসী সংখ্যালঘুরা জীবন ও ধনসম্পদ ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠদের দমন করেছে, আওয়ামী লীগকে বাধ্য করেছে হিংসাত্মক নীতি গ্রহণ করতে। ” অন্যরা যৌক্তিকতা খোঁজার ব্যাপারে আরো বোধ-বুদ্ধিহীন।

“টাকার জোরে হিন্দুরা মুসলমান জনগণকে একেবারে খাটো করে দেখেছে,” কুমিল্লার অফিসার্স মেসে ৯ম ডিভিশনের কর্নেল নাঈম আমাকে জানান। “শুষে পুরো শহরকে ওরা রক্তশূন্য করে ফেলেছে। টাকা অর্থ পণ্য সব ভারতে চলে যায় সীমান্ত পার হয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজে অর্ধেকরও বেশি নিজেদের লোক ঢুকিয়ে আপন ছেলেদের পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দেয় কলকাতায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসেছে যে বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে পরিচালনা করছে কলকাতার মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীরা।

জনগণের কাছে তাদের দেশকে ফিরিয়ে দিতে হলে এবং বিশ্বাসের কাছে জনগণকে ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের তাদের খুঁজে বের করতে হবে। ” অথবা মেজর বশিরের কথাই ধরা যাক। তিনি নিচুপদ পার হয়ে এ পর্যায়ে এসেছেন। কুমিল্লার ৯ম ডিভিশনের এই এসএসও-র নিজস্ব হত্যার খতিয়ান ২৮ বলে দম্ভও আছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে তার আছে একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা।

“এটা হল শুদ্ধ আর অশুদ্ধর মধ্যে যুদ্ধ”, এক কাপ সবুজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে কথাটা বলেন। “এখানকার লোকদের নাম হয়তো মুসলমানের, পরিচয়ও দেয় হয়তো মুসলমান বলে, কিন্তু মানসিকতায় এরা হিন্দু। আপনার বিশ্বাস হবে না, শুক্রবার এখানকার ক্যান্টনমেন্ট-মসজিদের মৌলবি ফতোয়া দিচ্ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের খুন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। ওই জারজটাকে আমরা খুঁজে বের করেছি, বাদবাকিদেরও খুঁজছি। যারা ওতে অংশ নেয়নি তারা হল খাঁটি মুসলমান।

আমরা এমন কি ওদের উর্দু শেখাবো। ” আমি প্রত্যেক জায়গার কর্মকর্তাদের দেখেছি তাদের হত্যালীলার পেছনে কল্পনামিশ্রিত যথেষ্ট যুক্তিও বানিয়ে নেন। কৃতকার্যের বৈধতা নিরূপণের জন্য অনেক কিছুই বলা যেতে পারে, নিজেদের মানসিক সন্তুষ্টির জন্যও সেটা প্রয়োজন, কিন্তু এই মর্মান্তিক ‘সমাধান’-এর মূল কারণটা রাজনৈতিক; বাঙালিরা নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঞ্জাবীদের আকাক্সক্ষা এবং স্বার্থ সরকারি নীতি-নির্ধারণে প্রাধান্য স্থাপন করেছে — ক্ষমতা হারানোর ব্যাপারটা তাদের কিছুতেই সহ্য হবে না। আর সামরিক বাহিনী এতে ইন্ধন যুগিয়েছে।

কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে এই বলে সাফাই গেয়েছে যে, সামরিক বাহিনী হত্যাকাণ্ড শুরুর পূর্বে অবাঙালিদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার পাল্টা জবাব হিসেবে এখনকার পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাবলী এমনটা বলে না যে চলমান এই গণহত্যা তাৎক্ষণিক ও বিশৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে। এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ভদ্র ও আত্মবিশ্বাসী অ্যাডমিরাল আহসানের কাছ থেকে পূর্ব বাংলার গভর্নরপদ এবং পণ্ডিতম্মন্য সাহেবজাদা খানের কাছ থেকে সামরিক ক্ষমতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান গ্রহণ করার পরই ‘অনুসন্ধান’-এর পরিকল্পনা শুরু হয়, এটা পরিষ্কার। এটা মার্চের শুরুর দিককার কথা, বাঙালিদের বিরাট প্রত্যাশা এসেম্বলি-সভা স্থগিত হবার পর যখন শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ-আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠেছে।

বলা হয়ে থাকে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের দমন-পীড়নের পক্ষের লোক হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিমালাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলছিল ঢাকাস্থ পাঞ্জাবী ইস্টার্ন কমান্ড। [এটা অত্যন্ত বাজে ব্যখ্যা যে খানরা এর সঙ্গে জড়িত নয়; খান পাকিস্তানীদের নামের একটি পদবী] যখন ২৫ মার্চের রাতে পাকসেনারা ঢাকার পথে নামে, পরের দিন সকালে শহর এমনিতেই জনশূন্য ছিল, তাদের সঙ্গে ছিল যাদের শেষ করে দিতে হবে তাদের নামের তালিকা। এতে ছিল হিন্দু আর প্রচুর সংখ্যক মুসলমানের নাম — ছাত্র, আওয়ামী লীগ সমর্থক, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং মুজিবের সহায়তাকারী। মানুষকে বর্তমানে জানানো হচ্ছে যে সৈন্যদের আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক ভবন জগন্নাথ হল, রমনা রেসকোর্স মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত দু’টি হিন্দু কলোনি এবং তৃতীয়ত পুরনো ঢাকার বুকের ওপর শাখারিপট্টিতে।

কিন্তু মার্চের ২৬ ও ২৭ তারিখের দিবারাত্রিব্যাপী কারফিউয়ের সময়ে ঢাকা ও নিকটস্থ নারায়নগঞ্জ শিল্প এলাকার হিন্দুদের কেন হত্যা করা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কারফিউর সময়ে রাস্তায় চলাচলকারী মুসলিমদেরও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এই লোকগুলোকে খতম করা হয়েছে পরিকল্পিত অভিযানের মাধ্যমে; হিন্দু দমনের বানোয়াট অভিযোগের ফল এলো আরো বিস্তৃতভাবে, অন্যরকমভাবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।