আমি বলতে চাইনা যে প্রথম থেকেই আমি শাহবাগ জাগরণের বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু এই জাগরণকে আমি কোনভাবেই আন্দোলন বলতে রাজি নয়। কারণটা খুবই পরিষ্কার। আন্দোলন করতে নির্দিষ্ট প্রতিপক্ষ লাগে; শাহবাগে যা কখনোই ছিল না। শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবীটাই মুখ্য ছিল।
কিন্তু ফাঁসির জন্য কার উপর চাপ সৃষ্টি করব, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালাই ছিল না। প্রথম কয়েকটা দিন জনগণ বিবেকের তাড়নাতেই গিয়েছিল কারণ ফাঁসির রায় না পেয়ে তারুণ্য সরকারের কাছ থেকে যে ধোঁকা খেয়েছিল তার শোধ নিতেই মূলত গণজাগরণ হয়েছিল। দিন-রাত না খেয়ে শাহবাগ মোড়ে ফাঁসির দাবিতেই মুখর ছিল টগবগে রক্তের প্রাণগুলো।
এরপর কি হল? ধীরে ধীরে মিডিয়ার সমাগম বাড়তে থাকল। সাংবাদিকগণ নানারকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ধীরে ধীরে জাগরণের মোড় ঘোরানো শুরু করল।
কয়েকটা স্লোগান দেওয়ার জন্য যখন লাকি আক্তারকে মিডিয়া ‘অগ্নিকন্যা’ উপাধি দিয়ে দিল, তখন কিছু পাতি ছাত্রনেতাও ভাবতে শুরু করল ‘এইটাই সুযোগ! মন্ত্রী হতে না পারি, মঞ্চে উঠে জনতার উদ্দেশ্যে দুচারটা স্লোগান দিলেই দলে আমার সম্মান বহুগুণ বেড়ে যাবে। যদিও জাগরণমঞ্চ থেকে প্রথমে রাজনৈতিক নেতাদের বিতাড়িত করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তারাই সমন্বয়কের মহান ভূমিকা পালন করেছে। আর ফাঁসির দাবী থেকে ধীরে ধীরে জনতার নজর সরিয়ে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণের উপর আনা হয়েছে। অহিংস আন্দোলন আখ্যা দিয়ে আবার সেই মঞ্চ থেকেই জবাই করার স্লোগান তোলা হয়।
শাহবাগ জাগরণ ব্যর্থ হওয়ার একটি কারণ জনগণের হলিডে আমেজে সেখানে শামিল হতে যাওয়া।
শুক্র, শনি দুইদিন সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় আর রাজধানীতে বিনোদনের জায়গার অভাব থাকায় অনেকেই সেখানে গমন করেছেন নতুন ধরণের বিনোদনের(!) আশায়। আর টিভিতে নিজের চাঁদবদনখানি দেখানোর জন্য তো বাসা থেকে আবেগমাখা দুচার লাইন মুখস্থ করে আসাই যায় আর আমাদের অতি উৎসাহী মিডিয়াগুলো মহাসমারোহে সেগুলো প্রচার করতে থাকে। আর তাইতো ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করতে আসা জনগণের ভাঙরা নাচ করা অবস্থায় হাস্যোজ্জল ছবি চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট হয়।
আর হুজুগে বাঙালি হিসেবে বাঙালির যে বদনাম ছিল তা যেন শাহবাগে এসে আরও একটি বার প্রমাণিত হল। একঝাঁক উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলে ফেবুতে আপলোড দিয়ে ভাবল তারা আন্দোলনে বিশাল অবদান রাখছে।
তারা নিত্য চেক-ইন করছে প্রজন্ম চত্বরে। ডিএসএলআরে কয়টা ছবি তোলার মাঝেই তাদের অংশগ্রহণ। এরপর বাসায় ফিরে রঙবেরঙে সাজিয়ে আপলোড দেওয়া। তাদের মনে হচ্ছে এতেই তারা বীর সেনানী হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতে যে জাগরণের মূলমন্ত্রই স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল, সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপই ছিলনা।
সমাবেশ তবুও ঠিকঠাক মতই চলছিল, দেশের মানুষকে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু আবার সর্বনাশ করল কিছু উঠতি ক্ষমতালোভী মানুষ। রাজনীতিকে না না করতে করতে সেই নোংরা রাজনীতিরই স্বীকার হয়ে গেল বহু আকাঙ্খিত প্রজন্মের জাগরণ। ছাত্রনেতাদের ব্লগার বানিয়ে তাদের বানানো হল আহ্বায়ক, সমন্বয়ক। আর স্লোগানগুলো হঠাৎ করেই যেন রাজনৈতিক মহলের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বনে গেল। এরা সাধারণ সমাবেশের মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দিল যে সমাবেশে যারা রাত-দিন কাটাচ্ছে না, তারা মূলত নব্য রাজাকার।
আর এই ধারণার মধ্যে দিয়েই সমাবেশকারীরা নিজেদের অনেকটা জনবিচ্ছিন্নই করে ফেলল।
সমাবেশের আরেকটি ভুল দিক হল, সরকারের কাছে থেকে পাওয়া তিন স্তরের নিরাপত্তার যথেচ্ছ ব্যবহার। পৃথিবীর ইতিহাসে বোধকরি এমন কোন আন্দোলন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে আন্দোলনকারীরা নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘেরাটোপে বসে গলাবাজি করেন। চারপাশে পুলিশ নিয়ে অনেক বড় বড় বাণী দেওয়াই যাই, কিন্তু বাস্তব অনেক কঠিন। আজ যখন লাশের পর লাশ পড়ছে, জামায়াত শিবিরের নামে নিরীহ মানুষ খুন হচ্ছে।
পথে চলতি সাধারণ মানুষ জেলের ভিতরে আটকা তা নিয়ে জাগরণ মঞ্চ একটিবারের জন্যও মুখ খুলবে না, পাছে তাদের লাইভ টেলিকাস্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেড়ে নেওয়া হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
তাই শেষে এসে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা করে, বাঙালির যখন উঠে খুব জোরেশোরেই ওঠে; কিন্তু খুব অল্পতেই সব পড়ে যাই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।