আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা যদি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হয়



বাংলা যদি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হয়, আমরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাব না তো? বইমেলায় আসা-যাওয়ার পথে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের কাছাকাছি এলে মাইক্রোফোন থেকে ভরাট কণ্ঠের আওয়াজে যা শোনা যায়, তার সারমর্ম: বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবিতে পাঁচ কোটি মানুষের স্বাক্ষর নিয়ে একটি আবেদন জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বের সব দেশের সরকারপ্রধানকে দেওয়া হবে। গণদাবির ইতিহাসে এটাই হবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের স্বাক্ষরিত দাবি। অত্যন্ত শুভ উদ্যোগ; অত্যন্ত প্রিয় দাবি। মূল আবেদনটি নিশ্চয়ই জাতিসংঘের মহাসচিব পাবেন, অন্যরা অনুলিপি। কাগজের প্রতি পৃষ্ঠায় যদি ১০০ জনের স্বাক্ষর গ্রহণ করা সম্ভব হয় (চিঠিপত্রের প্রকৃত আকার এ-ফোর সাইজের কাগজ), উভয় পৃষ্ঠাই যদি কাজে লাগানো হয়, তাহলে পাঁচ কোটি স্বাক্ষরের জন্য দুই লাখ ৫০ হাজার শিট কাগজের প্রয়োজন হবে এবং প্রতিটি খণ্ডে যদি ৫০০ পৃষ্ঠা থাকে, সব স্বাক্ষর মলাটবদ্ধ করতে ৫০০ খণ্ড স্বাক্ষরগ্রন্থের প্রয়োজন হবে।

একটি আবেদনের সঙ্গে ৫০০ খণ্ড স্বাক্ষর সংযোজনী নিঃসন্দেহে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেবে, এবার বাংলাদেশের নাম বিশ্বরেকর্ডধারীর খাতায় না তুলে উপায় নেই। ভালো দিকটা হচ্ছে, আবেদনটি ভাষার জন্য। আবেদন মঞ্জুর হওয়ার আগেই একটি বড় প্রাপ্তি গিনেসের খাতায় নাম ওঠানো। আর আবেদন মঞ্জুর হয়ে গেলে তো আনন্দের সীমা থাকবে না। জাতিসংঘই হয়তো মূল আবেদনটি গিনেস জাদুঘরকে দিয়ে দেবে।

যাঁদের কাছে আবেদনের অনুলিপি দেওয়া হবে, তাঁরা স্বাক্ষরের এতগুলো ফটোকপি পেলে বিব্রত হবেন, কাজেই উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই ডিজিটাল কপির কথাই মাথায় রেখেছেন। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ছয়টি: ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানীয়, রুশ, চীনা ও আরবি। আরবি ছাড়া বাকি পাঁচটি একেবারে শুরু থেকেই অন্তর্ভুক্ত। নিত্যকার কাজের ভাষা শুরুতে দুটি—ইংরেজি ও ফরাসি। ১৯৪৮ সালে এর সঙ্গে যোগ হলো স্প্যানীয়, ১৯৬৮ সালে রুশ, ১৯৭৩ সালে চীনা এবং ১৯৮০ সালে আরবি।

১৯৮৩ সালে এসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্বীকৃত দাপ্তরিক ভাষা ছয়টি। নিত্যকার কাজের ভাষাও ছয়টি। জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলার জন্য দাবি পেশ করা অন্যায় নয়। জাতিসংঘের ভাষা হওয়ার প্রকাশ্য দাবিদার ভাষার মধ্যে বাংলা ছাড়াও রয়েছে হিন্দি, উর্দু, পর্তুগিজ ও এসপারেন্তো। প্রতিযোগিতায় হিন্দি এগিয়ে থাকার কথা হলেও অ্যান্টি-হিন্দি লবি হিন্দিকে জাতিসংঘের নিজস্ব ভাষায় তালিকাভুক্ত না করার আবেদনও জানিয়েছে।

কারণ: ১. হিন্দি জাতিসংঘের ভাষা হলে ভারত সরকার মাথায় উঠে যাবে এবং আরও বিক্রমের সঙ্গে অহিন্দি রাজ্যগুলোতে হিন্দি চাপিয়ে দেবে। ২. হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করার পরই কেবল রাজ্যগুলো এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ রাখতে পারে। ৩. হিন্দিকে বিলিয়ন মানুষের ভাষা বলে জাতিসংঘকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে, এ সংখ্যা কেবল ৩০০ মিলিয়ন। ৪. তামিলনাড়ু রাজ্য এর মধ্যেই হিন্দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অফিশিয়াল ভাষা ঘোষণা চ্যালেঞ্জ করে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ৫. হিন্দি আরও সুযোগ পেলে ভারতে ভাষাভিত্তিক বৈষম্য বেড়ে যাবে।

৬. হিন্দি নিয়ে ভারত সরকার বিষয়টি আগে গণভোটে দিক। গণভোটের ফলাফলের ওপর হিন্দির ভাগ্য ছেড়ে দেওয়া হোক। একইভাবে উর্দুরও বিরোধিতা করছে স্বদেশি অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠী (বিশেষ করে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা পাঞ্জাবি দাবি ছাড়বে কেন?)। বাংলাদেশ বড় সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের ভেতর থেকে বাংলার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর আদায় করে বাংলা ভাষার জাতিসংঘ-বিজয় ঠেকানোর দুঃসাহস, আশা করা যায় কেউ দেখাবেন না।

আশার কথা, বাংলার জন্য চাপ অব্যাহত রাখলে, আন্তর্জাতিক লবিস্টরা ঠিকভাবে বাংলার পক্ষে থাকলে এ দেশের ভাষা জাতিসংঘে হরদম উচ্চারিত হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। আশঙ্কার কথা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা বাংলা কিছুটা বুঝলেও পরের প্রজন্মের প্রায় সবাই বাংলা বুঝতে, পড়তে, লিখতে ও বলতে পারবে না। ভাষার র্যাঙ্কিংয়ে তাদের সবচেয়ে প্রিয় ভাষা ইংরেজি, তারপর হিন্দি এবং তারপর আরবি। জাতিসংঘের বাংলা কার্যক্রম বুঝতে তাদের কারও হিন্দি দোভাষীর দরকার হচ্ছে, হেডফোনে কেউ বক্তৃতার ইংরেজি কিংবা আরবি ভাষান্তর শুনছে। যে পাঁচ কোটি বাঙালির স্বাক্ষর দাবিনামায় থাকবে, তাঁদের সন্তানেরা বাংলা বলতে, পড়তে ও লিখতে পারে তো? নয়তো বাংলা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হয়ে গেলে আমরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতে পারি।

আশরাফুল কবির

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।