মানুষ হিসেবে আমরা সবাই খুব একা
খুব ছোটবেলায় ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় পড়েছিলাম:
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই।
কবিতার সাথে কবির নাম হিসেবে বহুবার পড়েছি কবি জসীম উদ দীনের নাম। কিন্তু তখনো তাকে জানতাম না। চিনতাম না। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতৃর্থ শ্রেনীতে প্রিয় এ কবির আরও অনেক কবিতা পড়েছি।
আস্তে আস্তে প্রিয় হয়ে উঠেছে তার কবিতা আমার কাছে। একাদশ শ্রেনীতে এসে পড়েছি বিখ্যাত কবর কবিতাটি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বর্তি হয়েই দেখতে পেলাম কবি জসীম উদ দীন হল। ভর্তি হয়েছি বাংল বিভাগে। শিক্ষকদের কাছে শুনলাম তিনি এ বিভাগেরই শিক্ষক ছিলেন।
মাস্টার্সে এসে পড়লাম প্রিয় এ কবির নকশী কাথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রাখালি, ধানখেত, বালুচরসহ অনেক কবিতা। তবে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতেই হয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কবি (যিনি কিনা এ বিভাগেরই শিক্ষক ছিলেন!) বড় অবমূল্যায়িত হচ্ছেন। তার কবিতা ভালোভাবে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় না। আবার যাও পড়ানো হয়, তাতে তার স্বকীয়তা, প্রখার মেধার দিকগুলো যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না।
যাহোক, গত ১৬ জানুয়ারি অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনের জন্য ফরিদপুরে যাবার সুযোগ হলো।
দু'দিন ছিলাম। ফরিদপুর গিয়েই শুনলাম কবি জসীম উদ দীনের জন্মদিন (পহেলা জানুয়ারি) উপলক্ষ্যে ২১দিনের মেলা শুরু হয়েছে। নাম জসীম মেলা। কবির বাড়ি দেখার অদম্য বাসনায় রাতেই ছুটে গেলাম কবির বাড়িতে।
ফরিদপুর শহরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই গোবিন্দপুর গ্রামে কবি জসীম উদ দীন
এর বাড়ি।
বাড়ির সামনেই মাঠে মেলা। মেলা উপলক্ষ্যে জমজমাট পুরো এলাকা। রাত একটি বেশি হওয়ায় ভীড় কমলে একাকি প্রবেশ করলাম কবির বাড়িতে। শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় মন ছিল পুলকিত। এই কবির কতো কবিতা আমি ছাত্র জীবনে পড়েছি, পরীক্ষা দিয়েছি।
পাস করেছি। আর আজ তার বাড়িতে এসেছি। বাড়ির সামনেই কবির নিজের আর তার স্বজনদের কবর। মনে পড়লো কবির নিজের লেখা কবর কবিতাটি।
লোহার গ্রীল এর গেটটির ওপরে গাছের সঙ্গে সাইনবোর্ড আকারে টাঙানো রয়েছে কবির সেই বিখ্যাত নিমন্ত্রণ কবিতাটি----
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,
গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।
সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে - নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।
......................................................
সামনে যেতেই বড় একটি টিনের ঘর। কবির ছোটভাই ও বাবা-মা এ ধরে থাকতেন। ডানের গলি পেরিয়ে মূল বাড়ি।
কবির ঘররে বারান্দায় উঠলাম। ছোট্ট একটি ঘর। উপরে টিন। দেখে মনে মনে ভাবলাম-কবি কতো সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। বাড়ির কবির বড় ভাই, আরেক পাশে সেজ ভাইয়ের ঘর।
কবির ঘরের পাশে তাদের ঢেকি ঘর। কবি লিখেছেন, অভাকের সংসারে পিঠা খাওয়া হতো না খুব বেশি। মা এর কাঠে পিঠা মানে ছিল চালেল গুড়া আর চিনি বা গুড়। তাতেই মায়ের খুশি। তিনি আরও লিখেছেন, অভাবের কারনে বাজারে প্রতিদিন যাওয়া হতো না।
যদি কোনো দিন আমাদের বাড়িতে ইলিশ মাছ আনা হতো সেদিন বাড়িতে ছিল ঈদের খুশি। ইলিশ খাবার সামর্থ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের ছিল না।
বাড়ির পেছনে জঙ্গল আর নিচু জায়গা। বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে কুমার নদ। এ নদীর পাড়েই শিশু ও কিশোর বয়সে কবি বসে থাকতেন।
খেলাধুলা করতেন। কবির বাবার নামে পাঠাগার রয়েছে। নদীর পাড়েই জন্ম হয়েছিল বলেই হয়তো কবির
মন ছিল বড় উদার। তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন:
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা,
আমি বাঁধি তার ঘর
যে মোরে করেছে পথের বিবাগী
আজ কাঁদি আমি তার লাগি..।
বাড়ির সামনেই কুমার নদের পাড়ে রয়েছে জসীম মঞ্চ।
আর একটু দূরে কুমার নদের পাড়ে গিয়ে দেখলাম কবির বিখ্যাত রচনার সেই ঘাট- সোজন বাদিয়ার ঘাট। এ ঘাটের ঘটনা নিয়েই কবি এ কবিতাটি লিখেছিলেন। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।