চলতি বাজেটে কৃষিতে সরকারের বরাদ্দ যত, টাকার অঙ্কে মোবাইল পরিষেবার টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে তার ১৪গুণেরও বেশি টাকা লোকসান হয়েছে সরকারের। সোজা হিসেবে, টু-জি স্পেকট্রামের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সরকার যে টাকা পেয়েছে, বাজার দরের থেকে তা ১লক্ষ ৭৬হাজার ৭শো কোটি টাকা কম।
সি এ জি বলছে :
২০০৮সালে ওই লাইসেন্স বিক্রি করা হয়েছে, বহু পুরানো, ২০০১সালের দামে। কেন্দ্রীয় হিসাব পরীক্ষক সংস্থা সি এ জি তার রিপোর্টে বলেছে, মাননীয় মন্ত্রী বোধগম্য কোনো কারণ ছাড়াই আইনমন্ত্রক এবং অর্থমন্ত্রকের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছেন। টেলিকম ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক ‘ট্রাই’র বক্তব্যও বিবেচনায় রাখেননি টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা।
টু-জি স্পেকট্রামের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের লাইসেন্স বিক্রি হয়েছে তার বাজার দামের চেয়ে অনেক কম দামে। যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল, তাতে পরিষ্কার, মুষ্টিমেয় একটি অংশের সুবিধার জন্য তা পরিচালিত হয়েছে। রিপোর্টে ‘ট্রাই’-য়েরও সমালোচনা করেছে সি এ জি। বলা হয়েছে, অসহায় দর্শকের মতো পুরো বিষয়টি না দেখে, নিজেদের সুপারিশ লঙ্ঘনের সময় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।
কীভাবে হল এই কেলেঙ্কারি?
মোবাইল পরিষেবার জন্য বেতার তরঙ্গকে পরিভাষায় বলা হয় ‘স্পেকট্রাম’।
টু-জি মোবাইল পরিষেবার জন্য বেসরকারী সংস্থাকে স্পেকট্রামের লাইসেন্স বিক্রি হয় ২০০৮সালে। কিন্তু, লাইসেন্সের জন্য কত টাকা নেওয়া হবে? কোনো নিলাম হয়নি। ‘আগে এলে আগে পাবে’ ভিত্তিতে লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০০১সালের দরে দাম নেওয়া হয়। বাজার দামের চেয়ে অনেক কম দামে।
আবার পছন্দের সংস্থাকে লাইসেন্স দিতে ওই আবেদন জানানোর দিন ইচ্ছে মতো পালটে দেওয়া হয়।
ফলে, ১২২টি লাইসেন্সের ৮৫টিই এমন সংস্থা পেয়েছে যারা মন্ত্রকের নিজের ঠিক করা যোগ্যতার মাপকাঠি অর্জন করতে পারেনি। সি এ জি রিপোর্টেই তার উল্লেখ করা হয়েছে। স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে যৌথ সংসদীয় কমিটির দাবিতে যখন সংসদ উত্তাল, তখন ‘ট্রাই’ নিজেই ৬৯টি লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করে।
টেলিকম মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করা এ রাজা ইউ পি এ’র শরিক ডি এম কে নেতা।
কংগ্রেস বোঝানোর চেষ্টা করে গিয়েছে, যে শরিক নেতা বলেই পদক্ষেপ নিতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী। অথচ, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এই বেনিয়মের বিষয়ে জানতেন। সি এ জি রিপোর্টে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। মন্ত্রী রাজাও দাবি করেছেন যে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েই সব হয়েছে।
লাভ কার?
আম্বানিদের বিপুল শেয়ার থাকা সোয়ান টেলিকম ১৫৩৭কোটি টাকায় লাইসেন্স কিনে তার অংশীদারিত্বের ৪৫শতাংশ বাজারে বেচে ঘরে তুলেছে ৪২০০কোটি টাকা।
তেমনই ইউনিটেক ১৬৬১টাকায় লাইসেন্স কিনে তার মাত্র ৬০শতাংশ বেচে পায় ৬২০০কোটি টাকা। অর্থাৎ, কেন্দ্রের ইউ পি এ সরকারের কৃপায় সরকারী কোষাগারে ক্ষতি হলেও বিপুল লাভ করেছে বেসরকারী সংস্থাগুলি।
রিপোর্ট জানিয়েছে, টু-জি স্পেকট্রামের ক্ষেত্রে ইউনিফায়েড অ্যাকসেস লাইসেন্স বাবদ সরকারের পাওয়ার কথা ছিল ১লক্ষ ১১হাজার ৫১১কোটি টাকা। বদলে সরকারের হাতে এসেছে মাত্র ৯হাজার ১৩কোটি টাকা। দ্বৈত প্রযুক্তির অনুমতি দিয়ে সরকারের পাওয়ার কথা ছিল ৪০হাজার ৫২৬কোটি টাকা, হাতে এসেছে ৩হাজার ৩৭২কোটি টাকা।
এই দুই খাতে লোকসান ১লক্ষ ৩৯হাজার ৬৫২কোটি টাকা। তার সঙ্গে, অনুমতির বাইরে সংস্থাগুলির হাতে থাকা স্পেকট্রামের হিসেব করেছে সি এ জি। দেখা যাচ্ছে, এই সংস্থাগুলি বিনা পয়সায় ৩৯হাজার ৭২৯কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে রেখেছে।
দায়ী প্রধানমন্ত্রীও
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়েছে সুপ্রিম কোর্টই। বেনিয়ম হচ্ছে জেনেও কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি।
দেশজুড়ে তোলপাড়ের সময়েও বা চুপ কেন প্রধানমন্ত্রী?
সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া টেলিকম মন্ত্রকের হলফনামায় এ রাজা দাবি করেছেন যে, ১৯৯৯সালের টেলিকম নীতি অনুসরণ করেই ২০০৮সালে টু-জি স্পেকট্রামের লাইসেন্স বিলি হয়েছে। সি এ জি রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, অর্থমন্ত্রক এবং আইনমন্ত্রকের আপত্তি অগ্রাহ্য করেছিলেন রাজা। কিন্তু, হলফনামায় রাজা লিখিতভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
প্রশ্ন উঠছে, কংগ্রেসের অবস্থান কী? টু-জি স্পেকট্রাম সংক্রান্ত পদ্ধতি ঠিক থাকলে, পরে, ২০০৮সালে থ্রি-জি স্পেকট্রামে লাইসেন্স বিলির সময় তা বদলানো হলো কেন।
কংগ্রেস দেখাতে চাইছে, যেন এই প্রথম অভিযোগ উঠলো।
কিন্তু, ২০০৮সালের ফেব্রুয়ারিতেই বেনিয়ম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেন সি পি আই (এম) সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি। ২০১০সালের মে মাসেও চিঠি দিয়েছেন তিনি। ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসটুকুও দেননি প্রধানমন্ত্রী। সুপ্রিম কোর্টও স্পেকট্রামের তদন্তে সি বি আই না এগোনোয় ভর্ৎসনা করে কেন্দ্রকে। ফলে, দায় কেবল ডি এম কে-র ওপর চাপানোর চেষ্টা করলেও কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
স্রেফ সরকার বাঁচানোর অঙ্কে দুর্নীতিকে সমর্থন দিয়ে চলেছে কংগ্রেস।
চাপ কাটানোর কৌশলে সি এ জি’র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, সি এ জি রিপোর্ট নিখুঁত, ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায্য হওয়া উচিত।
বামপন্থীরাই জনস্বার্থের প্রহরী
বিশাল অঙ্কের স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির এই রিপোর্টে কার্যত বামপন্থীদের অভিযোগের অভ্রান্ততা প্রমাণিত হলো। অবশ্য, সি পি আই (এম) বলেছে মোট কোষাগারে লোকসানের অনুমিত পরিমাণ ১লক্ষ ৯০হাজার কোটি টাকা।
টেলিকম কেলেঙ্কারি নিয়ে জাতীয় স্তরে প্রথম সরব হয় বামপন্থীরাই। ২০০৮’র জানুয়ারিতে এই স্পেকট্রাম বিলি হয়েছিলো। বামপন্থীদের পক্ষ থেকেই লাগাতার সংসদে এবং সংসদের বাইরে দেশের জনগণের সামনে বিপুল ক্ষতির কথা তুলে ধরা হয়। এন ডি এ জমানায় রেকর্ড নড়বড়ে থাকায় প্রধান বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও প্রায় নীরব থেকেছে বি জে পি। সি এ জি রিপোর্টে বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য থাকার পর মাঠে নামে প্রধান বিরোধী দল বি জে পি।
বস্তুত, বামপন্থীদের চাপ থাকায় চলতি বছর পরের ধাপে থ্রি-জি স্পেকট্রামের লাইসেন্স বিলির সময় সতর্ক ছিল সরকার। সেই প্রক্রিয়ায় বাজার দাম প্রতিফলিত হওয়ায় সরকারের কোষাগারে এসেছে প্রায় ৭০হাজার কোটি টাকা।
বামপন্থীদের দাবি
এক, এ রাজার ইস্তফাতেই এত বড় কেলেঙ্কারি চাপা যাবে না। গড়তে হবে সংসদের দুই কক্ষের সাংসদদের যৌথ সংসদীয় কমিটি।
দুই, সংসদে বিবৃতি দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে।
দেশের শীর্ষ আদালত প্রশ্ন তুলেছে তাঁর বিরুদ্ধে। স্পষ্ট করে জানাতে হবে তাঁর বক্তব্য। তিনি চুপ কেন।
তিন, জলের দামে যে সংস্থাগুলি লাইসেন্স পেয়েছে, তাদের থেকে আদায় করতে হবে বাজার দাম। অনুমতির বাইরে স্পেকট্রাম আছে এদের হাতে।
যার বাজার দাম ৩৯হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। সেই টাকা আদাব করতে হবে। সেক্ষেত্রে, সরকারের লোকসান কিছুটা কমবে।
চার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গেই কেলেঙ্কারিতে জড়িত সরকারী আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।