কারো চোখে ঘুম নেই। সুশান্ত এককেবার একেকটা চিন্তাকরছে আর প্রিয়ন্তীকে মোবাইল করছে। প্রিয়ন্তীর কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না। আবার প্রিয়ন্তী কোন একটা চিন্তা বের করলে সেটা সুশান্তরচিন্তারসঙ্গে মিলছে না। এমনিভাবে চিন্তাকরতে করতে সুশান্ত মনে মনে খুঁজছে এ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করেছে এমন কাউকে পাওয়া যায় কি না? খুঁজতে খুঁজতে তার মনে হলো তার রুম মেট মিজানের এক মামাতো ভাই কিছুদিন আগে কোর্টে এ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করে এখন সংসার করছে।
এখনো মিজানের কাছে মাঝে মাঝে আসে একবার মিজানকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়। মিজান সুশান্তর সঙ্গে পড়ে, অন্য সাবজেক্টে।
সুশান্ত একবার মিজানের দিকে তাকাল। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আগেও এরকম কিছু হলে তাকে ডাকলে সে কিছু মনে করে না, খুব সহজে বিরক্ত হয় না। সুশান্ত একবার মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকাল, রাত একটা বাজে।
সুশান্ত আস্তে আস্তে ডাক দিল, মিজান, মিজান।
মিজান চোখ মেলে তাকাল, কে?
মিজান আমি সুশান্ত।
মিজান হাত দিয়ে দু’চোখ নেড়ে বলল, কী ব্যাপার সুশান্ত?
মিজান আসলে তোকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, সুশান্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল।
কোন ফরমালিটিজ দরকার নেই, কী হয়েছে বল? বলে মিজান বিছানায় উঠে বসল।
মিজান তোর মামাতো ভাই তো এ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করল, তাই না?
হ্যাঁ।
এখন কেমন আছে?
ভালো, দিব্বি সংসার করছে, বলে মিজান একটু মিটমিট করে হাসল।
কোন আইন আদালত, পুলিশি ঝামেলা হয়েছিল নাকি?
না তো কোন কিছু হয়নি, কেন কি ব্যাপার খুলে বলতো।
মিজান তুই তো জানিস আমি প্রিয়ন্তীকে ভালোবাসি।
হ্যাঁ, শুনেছি।
আমি প্রিয়ন্তীকে বিয়ে করব।
তোরা না কোনদিন মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে এলি?
হ্যাঁ, আমরা দু’জনে ঠাকুর সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছি কিন্তু সেই বিয়ের তো কোন স্বীকৃতিনেই।
স্বীকৃতিনেই মানে?
মানে সেটা তো বিয়ে না আবেগের বশে দু’জনে একটা সান্ত্বনা দাঁড় করিয়েছি, কার্তিক মাসে। আমাদের ধর্মে কার্তিক মাসে বিয়ে হয় না। সেকথা ঠাকুর মন্ত্র পাঠের সময় বলে দিয়েছে।
তাতে কী?
আমাদের সমাজে বিয়ের চিহ্ন সিঁদুর আর সাক্ষী সমাজ, আমরা যদি সাক্ষী রেখে অন্য কোন মাসে, যেসব মাসে বিয়ে হয় সেসব মাসের মধ্যে কোন একদিন সমাজ সাক্ষী রেখে বিয়ে করতাম আর প্রিয়ন্তী যদি সেদিন থেকে সিঁদুর পরতো তবে সবাই সে বিয়েকে স্বীকৃতিদিত কিন্তু তাকে তো কেউ সিঁদুর পরতে দেখেনি।
গ্রহণযোগ্য কোন সাক্ষীও নেই। তাই সে বিয়ের না আছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি , না আছে সামাজিক স্বীকৃতি।
এখন কি তোরা এ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করতে চাস?
হ্যাঁ, সেজন্যই তো তোকে বলছি।
মিজান যেন ব্যাপারটা সহজে হেসে উড়িয়ে দিল, সেজন্য রাত জেগে নিজের ঘুম নষ্ট করছিস আর বার বার করে মোবাইল করে বেচারীরও ঘুম নষ্ট করছিস? ঘুমা।
সুশান্ত অসহায়ের মতো বলল, তাহলে এখন কী হবে?
সব হবে, কাল সকালে দু’জনকে নিয়ে কোর্টে যাবো, সেখানে যে উকিল আমার মামাতো ভাইয়ের এ্যাফিডেভিট করেছিল তার কাছে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।
তাহলে এটা একই বউয়ের সঙ্গে তোর দ্বিতীয়বার বিয়ে?
সুশান্ত হাসলো।
সুশান্ত অনেকটা নিশ্চিৎ হলো। সে প্রিয়ন্তীকে মোবাইল করে বিষয়টি বলল। প্রিয়ন্তী শুনে কিছুটা আশ্বস্থ হলেও তার মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা রয়েই গেল।
সে সুশান্তকে মোবাইলে বলল, সুশান্ত একটা কথা চিন্তা করেছিস?
কী কথা?
ওরা মুসলমান আর আমরা হিন্দু।
সুশান্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ল, হ্যাঁ তুই তো ঠিকই বলেছিস।
সুশান্ত আবার মিজানকে বলল, মিজান একটা সমস্যা হয়ে গেল যে?
কী সমস্যা?
আমরা তো হিন্দু, এ্যাফিডেভিট করে আমাদের বিয়ে হয় কিনা এটা তো আমার জানা নেই।
মিজান কিছুটা ধমকের সুরে বলল, দেখ সুশান্ত তোকে আমি বলেছি তুই ঘুমা, তুই ঘুমাবি। ঐসব তফাত আছে মন্দির, মসজিদ, গীর্জায়। রাষ্ট্রের কাছে সবাই মানুষ।
তুই আর একটা কথাও বলবি না এখন লাইট অফ করে ঘুমা।
সুশান্ত আর কিছু বলল না।
পরদিন সকালবেলা সুশান্ত তার একজন বন্ধুকে বলল। সে আর মিজান একটা রিক্সায় এবং প্রিয়ন্তী আর সুশান্ত আরেকটা রিক্সায় চেপে কোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। সুশান্তর চোখে-মুখে একটা আতংকের ছাপ পড়েছে, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত।
সে মাথা নিচু করে আপন মনে অনেক কথা ভাবছিল।
প্রিয়ন্তী সেটা খেয়াল করেছে সে অনেকক্ষণ সুশান্তর চিন্তামগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সুশান্তকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, এই সুশান্ত কী ভাবছিস?
না কিছু না।
কিছু তো অবশ্যই ভাবছিলি? সন্দেহ হচ্ছে আমি তোকে কোন বিপদে ফেলি কি না? তাই না?
না।
ভয় হচ্ছে?
সুশান্ত সায় দিল।
কোন ভয় নেই আমি তোর সঙ্গে আছি না, কিচ্ছু হবে না।
রিক্সা কোর্ট এলাকায় পৌঁছালো। মিজান কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর এসে বলল, উকিল সাহেবের একটা মামলার শুনানী চলছে, সেটা শেষ হতে সময় লাগবে। তারপর এ্যাফিডেভিট হবে। তোরা দু’জনে বস।
সুশান্ত আর প্রিয়ন্তী একটা হোটেলে বসল। দুজনে মুখোমুখি বসেছে, ফিস্ফিস করে অনেকক্ষণ কথা। প্রিয়ন্তীর চোখে মুখে কোন অস্বাভাবিকতা নেই কিন্তু সুশান্তর মুখ থেকে কালো মেঘটা সরেই যাচ্ছে না। কথার মাঝে মাঝে সুশান্ত আনমনা হয়ে যাচ্ছে তখন প্রিয়ন্তী আবার বলছে এই সুশান্ত কী হচ্ছে? কী চিন্তা করছিস?
সুশান্ত চমকে উঠছে, না কিছু না।
প্রিয়ন্তী এবার ধমকের সুরে বলল, বেশি ভয় পেলে, আমাকে বোঝা মনে করলে থাক।
আমার জন্য তোকে কোন বিপদে পড়তে হবে না, আমি চলে যাচ্ছি।
সুশান্ত অনুরোধের সুরে বলল, প্রিয়ন্তী রাগ করিস না, প্লিজ বস।
বসবো তো কিন্তু তুই এমন নার্ভাস হচ্ছিস কেন?
প্রিয়ন্তী একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফিস্ফিস করে বলল, আজ আমাদের আনন্দের দিন, আনন্দের দিনে কেউ এমন মুখ গোমরা করে থাকে?
সুশান্ত চুপ করে রইল।
প্রিয়ন্তী আবার বলল, তুই এমন করে থাকলে খুব খারাপ লাগে, আজ আমাদের বিয়ে, একবার অন্ততঃ শুভদৃষ্টি বিনিময় হওয়া উচিত। তুই একবার আমার চোখের দিকে তাকা।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে উঠল।
মিজান এলো, এই সুশান্ত আয় উকিল সাহেব এসেছেন। দু’জনে আয়।
দুজনে মিজানের সঙ্গে গেল। বিরাট এক কক্ষে অনেক উকিল বসে আছে, ভীড়ে গিজগিজ করছে।
মিজান দুজনকে একজন উকিলের কাছে নিয়ে গেল। উকিল সাহেবের টেবিলের সামনে দু’টা চেয়ার আছে।
মিজান বলল, তোরা বস।
সুশান্ত আর প্রিয়ন্তী চেয়ারে বসল।
উকিল সাহেব সুশান্তকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?
সুশান্ত দত্ত।
আর তোমার? বলে তিনি প্রিয়ন্তীর দিকে তাকালেন।
প্রিয়ন্তী চক্রবর্তী।
এই তো সমস্যা, তোমাদের বিয়েতে আবার বর্ণ মানতে হয়। পরে কোন ঝামেলাই হয় নাকি?
মিজান বলল, আংকেল আমি বলছি কোন ঝামেলা হবে না।
এস.এস.সি পাসের সার্টিফিকেট এনেছ?
সুশান্ত বলল, হ্যাঁ।
দেখি।
সুশান্ত তার এবং প্রিয়ন্তীর সার্টিফিকেট দু’টা এক সঙ্গে করে উকিল সাহেবের হাতে দিল।
উকিল সাহেব সার্টিফিকেট দেখে বলল, বয়সে কোন সমস্যা নেই? তারপর প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেছ তো?
হ্যাঁ।
পরে আবার বলো না যে ও তোমাকে জোর করে বা ফুসলিয়ে নিয়ে এসেছে?
প্রিয়ন্তী দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, না বলব না।
উকিল সাহেব তাদের নাম, ঠিকানাসহ প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে দুজনের ছবি সংযোজন করে দু’জনের স্বাক্ষর নিলেন, মিজান এবং সুশান্তর যে বন্ধু সঙ্গে এসেছিল সাক্ষী হিসেবে তাদের দু’জনের সাক্ষর নিলেন।
তারপর এ্যাফিডেভিটের কাজ সম্পন্ন করে তার এক সহযোগীকে দিয়ে ফটোকপি করতে দিলেন কিন্তু তখন বিদ্যুত না থাকায় সেদিন ফটোকপি করা হলো না। উকিল সাহেব বললেন সমস্যা নেই একজন এসে একটা ফটোকপি নিয়ে যেও।
মিজান সুশান্তর কাছ থেকে টাকা নিয়ে উকিল সাহেবকে দিয়ে বললেন, আংকেল তাহলে আসি।
আচ্ছা।
সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, কাজ শেষ।
হ্যাঁ।
কোর্ট এলাকা থেকে বেরিয়ে আবার সুশান্ত আর প্রিয়ন্তী একটা রিক্সায় উঠল। মিজান আর সুশান্তর বন্ধু আরেকটা রিক্সায় উঠল। নানকিং চাইনিজ রেস্টুরেণ্টের সামনে এসে মিজান রিক্সা থামালো। সুশান্তর রিক্সাটা পিছনে ছিল, মিজানের রিক্সার কাছে আসতেই সুশান্ত রিক্সা থামাতে বলল, কী ব্যাপার মিজান?
সুশান্ত ক্ষিদে লেগেছে, কোথায় খাওয়াবি? এখানে নাকি অন্য কোথাও?
চিলি’স-এ।
আচ্ছা।
চার জনে চিলি’স-এ খাবার পর মিজান আর সুশান্তর যে বন্ধুটা এসেছিল তারা চলে গেল। সুশান্ত আর প্রিয়ন্তী একটা রিক্সায় উঠল।
সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী এখন কোথায় যাবি?
মেসে।
কিন্তু-বলে সুশান্ত প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কিন্তু কী?
সুশান্ত কানে কানে বলল, আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে না?
তাতে কী?
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর কানে কানে কি যেন বলল, প্রিয়ন্তীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।