বাঙলা কবিতা । । বাঙলায়ন : রহমান হেনরী । ।
--------------
'All goeth but Goddis will.' -- Old Poet.
--------------
আমার বাসনাজুড়ে স্বপ্নদ্বীপ
যাকে দূর-সমুদ্রটি করে রাখে একা
সেই মুখ দ্যাখে শুধু আকাশপ্রদীপ
আর কোনও চোখ যার পায় নাই দেখা
ওই যে উজ্জ্বল, স্থির, কী রূপসী, তারা দেখা যায়!
ততোধিক আলোকস্থিরতা, চাই না এ-মনোবাসনায়।
২.
একটি সামান্য দ্বীপ পাহাড় ও বনানীতে ঘেরা,
ছড়ানো ছিটানো আর যথেষ্ট বন্ধুর
হঠাৎ উপচে পড়া অতিগাঢ় সবুজের ডেরা
উপত্যকা সর্বদাই সুগন্ধীবিধুর,
এতো ঢালু, এতোটা গভীর, যেন মাতৃহাওয়ায়
মিষ্টিতর বাতাসের দোলনাটি সস্নেহে দোলায়।
৩.
আলো চেয়ে পাহাড়েরা আকাশের ঠিকানায় ছোটে
গভীর বনের পথে, সেই পথ অর্ধেকে লীন;
যেন-বা উন্মত্ত ভূমি মানবিক উন্মাদনা লোটে
আর তার বুকে ধরে হৃদয়, রঙিন:
আমি চাই, সেই দ্বীপ বেনজীর সবুজে বিধৃত,
আনন্দিত হৃদয়ের চেয়ে আরও ঢের পুলকিত।
৪.
আরও চাই, সে পার্বত্যদ্বীপ হবে যথাযথ,
দান্তের স্বর্গসমান;
সে সবুজ স্বপ্নদ্বীপ, পর্বতময় শত শত,
উচ্চতায় যেন দূর সুনীল আসমান
ভূমিতে ছড়াবে রেখা সমস্ত মূলের
যা কিছু বেহেস্তীবৃক্ষ, ফলের, ফুলের।
৫.
কেননা... বাঁচাতে হবে সমভূমি, যেখানে স্থবির
পাথরের আস্ফালন জন্ম নেবে খোলা ময়দানে
কিংবা যেখানে নদী খরস্রোতা, গর্জনগভীর;
দুঃখ-ক্ষতের মত ঝরনা সহসা ফুটে উঠবে যেখানে,
(এবং সেখানে যদি কেউ বসে মনোকান পাতে,
শোনা যাবে, পাতার সঙ্গীত বাজে ঝরনার সাথে,)..
৬.
সেই স্থান বৃক্ষ-ঢেউয়ে সমগ্র উত্তাল,
পত্রগুল্ম, পুষ্পঝোপ, রক্তবর্ণ ফুলের বিছানা;
আকাশমণির গাছ পাতালের তলানী-মাতাল,
রাত্রি-শিশির পানে ঝিমুনীপ্রবণ, তালকানা;
অস্পষ্ট ধূসর ঘন জলপাই বন
মনে হবে, কী যথার্থ স্বপ্ন-আয়োজন!
৭.
চারিদিকে গাছ, গাছ, গাছেদের সারি! ছায়াসম্মেলন,
ঝকঝকে ফল আর কী বাহারি পুষ্পদলফাঁকে
ছুঁড়ে দেবে হাতের তালুর মত ঘনছবি, রৌদ্র যখন
ফিরে যাবে, দিনশেষে অন্ধকার রাত্রির ডাকে;
সে ছায়া জড়াবে তার ধারক-মাটিকে,
যেন-বা গীর্জার মুগ্ধ কাচসজ্জা সিলিংয়ের দিকে।
৮.
সামান্যই হয়তো দরকারী ওই ওপরের আলো
আমাদের দ্বীপদেশে, পুষ্পতারকাপুঞ্জ গাছে গাছে
(একটাও না ঝরে) যেই না চমকালো,
মনে হবে, বর্হিজাগতিক আলো কী দরকার আছে!
সে-অজস্র পুষ্পরাজ্যে হুলস্থূল রঙ
শিশির-বাতিতে জ্বলে দ্বীপময় ছড়াবে বরং!
৯.
প্রশস্ত পত্রালিঋদ্ধ গাছপালা সবল চুম্বনে
উজার করে দেবে আসমানের অমৃতের বাটি,
মুদিত-নয়ন যারা ডুবে থাকবে বিভোর উন্মনে,
এবং নাজুক কুঁড়ি, আধোলাজে মগ্ন-পরিপাটি;
অগণন এরা সব, কিন্তু এরও পাশে
সবুজ উদিত হবে লতা আর ঘাসে।
১০.
এবং স্রোতস্বী খাল, আয়নার বিম্বিত স্বভাবে
পালাক্রমে বর্ণ ঝরাবে বারে বারে।
কিংবা সকল রঙ শুষে নিয়ে দুহাতে জমাবে
হাওয়ায় উত্তাল তার রূপালী দু'পাড়ে,
বেহেস্তী স্বপ্নের মত শাদা লিলি ফুলেদের পাশে
হয়তো নিদ্রিত রবে, অস্পষ্ট, ভুতুরে, উদাসে।
১১.
বাগানজুড়ে গাছেরা খুব সন্নিহিতে
ঘেঁষা এবং জড়াজড়ি নয়
অনেকখানি পরিসরের গোছানো সারিতে,
জ্যোৎস্না যেন খুব অবাধে সঞ্চালিত হয়
কচিঘাসে মুখ ডুবানো হরিণ সারে সারে
আপন দেহের দ্বৈতছবি স্পষ্ট দেখতে পারে।
১২.
এ-দ্বীপের প্রাণিসবে সম্পূর্ণতা দিতে
(পূর্ণ আনন্দময়, নয় আধাসুখি)
লতাটানাভোজ শেষে ফের আচম্বিতে
মনোরম গাভী হবে বাছুরের তৃষ্ণা-অভিমুখি
স্নেহোষ্ণ ওলান থেকে তুলে দেবে অমৃত-দুধ
বাছুরের চোখেমুখে পরিতৃপ্তি, স্নেহের বুদ্বুদ।
১৩.
মুক্ত খেলুড়ে ঘোড়া, সাম্বার হরিণ,
মনোরম লম্ফমান কাঠবিড়ালির চঞ্চলতা,
পাহাড় ঢালুতে শত মহিষের দিন,
এবং রাখালহীন মেষেদের প্রিয় উচ্ছ্বলতা:
খরগোশ, অঞ্জনি, সজারু, ভোঁদর ও যথেষ্ট ইঁদুর,
সর্পদল, মধুখোর, ব্যাঙ আর প্রজাপতিদলে ভরপুর।
১৪.
পাখিসব দলবেঁধে বাঁচে, হয় উড্ডয়নরত,
লক্ষীপেঁচাও আছে, বুলবুলি অপরূপ গায়,
চিলেরা আকাশ চষে, ময়ূর গর্বিত
অতিদীর্ঘ নকশাকাটা পূচ্ছ নাচায়;
সর্বপ্রাণি নিরাপদ, সুখি; আর স্বপ্নে-উপাচারে
বন্দুক-নিশানা কোনও প্রাণ নাহি কাড়ে।
১৫.
দ্বীপের বর্ধিত দুটো প্রান্ত যেন একেকটি ডানা
উপচে-পড়া ডালপালাময় হাজার গাছে গাছে
কাদাখোঁচা পাখিদের সমুদ্রচিলেরা দেয় মুক্ত ঠিকানা
ডেকে বলে, জলে এসো, পরিবর্তনে সুখ আছে;
এবং ঘুঘুরা অর্ধনির্মীলিত চোখ তুলে, চেয়ে,
লাল ও বেগুনি যত মাছেদের কানে ওঠে গেয়ে।
১৬.
একটি বিশ্বাসী ঘুঘু মুহুর্মুহু দিয়ে যাচ্ছে সাড়া
প্রতিটি ঢেউয়ের কলধ্বনিটির কাছে,
এমন স্পন্দিত ধ্বনি উতলা হৃদয়মনকাড়া!
নিশ্চিত এই শব্দে প্রিয়টির ডাক মিশে আছে:
সঙ্গীতে-ধ্বনিতে মিশে একাকার সমুদ্রগর্জন
এতটা সুন্দরমাখা এ-দ্বীপের সব আয়োজন।
১৭.
ক্ষরণরঞ্জিত এই আত্মা আমার ছুটে যেতে চায়
সীমানা ছাড়িয়ে দূরে, উত্তাল ঢেউয়ে মিশে যেতে;
ওদের পাশেই এক ঋজুপথ গড়ি কল্পনায়
বাসের বাসনা রাখি সমুদ্রসংলগ্ন গুহাতে:
এবং আমারও পড়শি হতে পারে জনা দুই-তিন
যাদের কল্পনা-স্বপ্ন সুখপ্রদ, আনন্দ-রঙিন।
১৮.
দীর্ঘ ও হাওয়াখেলা সেই গহ্বর, ঝলমল করে দূর
দিগন্তের দিকে, স্ফটিকস্বচ্ছ দৃশ্যপটে!
সেই স্বচ্ছ ফানেল আকাশে, গিজগিজ তারা ভরপুর
অবাধে ছড়াবে দ্যুতি এ-দীপের ঘটে;
এবং ওসব জ্যোতি নামবে ফুলের ঘ্রাণে
অদৃশ্য উচ্চতা থেকে আমাদের প্রাণে।
১৯.
বলেছিলাম, দু'তিন জন বেছে নিতে পারে
আমার গৃহের পাশে নিজের ঘর:
যেসব মানুষ বদলে নেবে যাপনরীতিটারে
নিসর্গময় রচবে নতুন স্বর--
উদ্বেলিত মানব মনন এবং দেখার চোখ
মমতাময়, নিসর্গেরই আত্মীয় সে হোক।
২০.
আমরা যেন প্রকৃতিরই আস্থাভাজন হই,
বন্ধুসুলভ ভূমিকাতে থাকি;
বসুন্ধরার এই অপরূপ রূপের স্নেহছই
রুদ্র হয়ে দেয় না যেন মনভাঙা খুব ঝাঁকি:
তার সুরেলা গান যেন এই জীবন ছুঁয়ে থাকে
আমাদেরও হৃদয় যেন তার ছবিটাই আঁকে।
২১.
তথাপি সে তোমার আমার শাসনকত্রী নয়,
চাঁদটা যেমন মালকিন নয় বিপুল সমুদ্রের,
যদিও সে চাঁদের মতই স্নেহময়ী হয়
ভাবনাজুড়ে জ্যোতি এবং গতি ঢালে ঢের:
বরং সে তো শস্যগোলা, মাথার ওপর ছায়া,
ক্রীড়ামগ্ন সমুদ্রময় চাঁদটা যেমন মায়া।
২২.
এ-দ্বীপময় ঘাসবিছানো এক ইঞ্চি ভূমি
মৃতের লোভে হা-হাঙর খোলে না তার মুখ;
মীরজাফরের শপথ-বওয়া বাতাস খুঁজে পাবেনাকো তুমি;
এই ভূতলে পা ফেলে না শোকার্ত উজবুক;
কেউ বলে না স্রোতের পাশে ছায়ার পাশে ব'সে
'প্রতারিত-- দগ্ধ হলাম শুধুই দেশের দোষে। '
২৩.
আমরা কেবল 'বিদায়' বলি ঝাঁকিয়ে কাঁধ-মাথা
মেঘ ও প্রহর পালা শেষে যাচ্ছে যখন চলে,
এবং লিখি মনখারাপের শোকলিপিগাথা
কুঁড়িগুলো রূপান্তরে ফুল হয়েছে বলে:
দুচোখ থেকে অশ্রুবিন্দু তখন শুধু ঝরে
যখন মানুষ আনন্দিত কিংবা প্রেমে পড়ে।
২৪.
আমাদের কল্পসুখ পাখির পালক ছুঁয়ে আসে
এ-দ্বীপেরই মায়াকাড়া মনোহর পাখি,
যাদের ডিমের ফেটে অবিকল প্রতিরূপ হাসে,
জন্ম নেয় গান! আমরাও অন্তরালে রাখি
বর্ণিলতা আমাদের শব্দে-ছন্দে মেখে
বেগবান কল্পনায় রূপময় পাখির উল্লেখে।
২৫.
অবশ্যই, খুবই দ্রুত, খসখসে পাথরিত মুখ
হাসিফোটা ঠোঁটের আদল খুঁজে পাবে;
গ্রীক যুবকের কণ্ঠস্বরের মতন ধ্বনিসুখ
আমাদের কথোপকথনে খেলে যাবে:
(কী সে গান, ব্রজবালা, বলতে তুমি পারো?
দয়ার্দ্র স্বরেরও চেয়ে সুললিত, মায়াঝরা আরও?)
২৬.
এবং প্রায়ঃশ, এমন খুশি, আমাদের শূন্যতায়
কিংবা এই আমাদেরই মনোবন ছাপিয়ে-ছাড়িয়ে
চলে যাবে; আমরাও, আমাদের ধ্যানমগ্নতায়
ভাসতে দেবো এমন কবিতাগুলো-- জবান হারিয়ে--
যেমন পিন্ডার দিতো হয়তো-বা এমনই নির্দেশ
আর্কেডিতে যদি সে রাখাল হতো, যদি পালতো মেষ।
২৭.
অথবা এসিলাস-- দীর্ঘতম জেনে
যে আনন্দময়ী মাঠে মরে গিয়েছিলো;
কিংবা হোমার, মানুষের পাপ ও সুরক্ষাবর্ম টেনে
বনবিড়ালের ঘন দঙ্গলে হঠাৎ হারালো;
প্লেটোর কথাই ধরো, সে তো কবি, ধ্যানী-ঋষি দীলও,
অনুজ্জ্বল ঈশ্বরঃজ্যোতি তারই দেহে ধসে পড়েছিলো।
২৮.
আমাকে বাছাই করো, গুহাশ্রম, যথার্থ বাছাই,
প্রার্থনায় মগ্ন হবো খুঁজি নির্জনতা,
প্রার্থনাসম্মত কণ্ঠ উদ্ভাবন করে নিতে চাই
সেখানেই ঢেলে দেবো আত্মার পূতপবিত্রতা:
কী রূপালি প্রতিধ্বনি জাগে, ভেসে যায়!
তুমি পারবে, পারবে তুমি-- নিবেদন দেহে ও আত্মায়।
২৯.
বিনম্র অথচ খুবই অদ্ভূত আওয়াজ!
তারা এই স্বপ্নমগ্ন আমাকে জাগায়;
স্বপ্নদ্বীপ বিবর্ণে বিলীন হয়ে মিশে যাচ্ছে আজ
যেখানে অস্তিত্ব ছিলো, অনস্তিত্ব তাকে গিলে খায়:
স্রোতস্বী শুকিয়ে কাঠ, রৌদ্রমরা দিন---
ফলপতনের শব্দ, ঝড়হীন, বাতাসবিহীন।
৩০.
ঈশ্বরের ইচ্ছা এসে এভাবে হঠাৎ
মুছে দেয় আমাদের নির্বোধ বাসনা
এবং কোন সে স্বপ্ন সহসা নস্যাৎ
করে দিতে পারে এই সকালের রৌদ্র বা সোনা?
তা হলে কে বিড়বিড়াবে, সন্দেহজারিত করবে তাকে?
উদিত সূর্যের মহারোদে এসে চাক্ষুষে তুলে ধরে যাকে!
...........................
* First printed in the New Monthly Magazine January, 1837. ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।