ইতোমধ্যে যতীন বাবু একদিন পরোক্ষভাবে প্রিয়ন্তীর কথা দীপক বাবুকে বলেছে। দীপক বাবু মনে মনে প্রিয়ন্তীর ওপর রেগে গেলেও যতীন বাবুর কথাকে না শোনার ভান করে পাশ কাটিয়েছে।
দূর্গা পূজায় সুশান্তর সঙ্গে প্রিয়ন্তীর মেলামেশা, যতীন বাবুর কথা, বজ ঠাকুরের কান ভারী করা সবকিছু মিলিয়ে দীপক বাবু প্রিয়ন্তীর ওপর খুব রাগান্বিতছিল। তারওপর জামাইবাবুর কথা যেন ভস্মে ঘি ঢাললো। জামাইবাবু প্রিয়ন্তীর কথা আরো হাজারগুণ বাড়িয়ে যখন দীপক বাবুকে বলল, তখন প্রিয়ন্তীর ওপর তার রাগ আরো সহস্রগুণ বেড়ে গেল।
বজ ঠাকুরসহ আত্মীয়-স্বজনদেরঅনেকেই তাকে প্রিয়ন্তীর লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কিন্তু শত রাগেও প্রিয়ন্তীকে উচ্চ শিক্ষিত করার স্বপ্নটাসে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি তাই কোনভাবে প্রিয়ন্তীর বিয়ের কথাও ভাবেনি। আজ নিজের জামাই যখন বলল তখন সে কিছুক্ষণ মাথা নত করে বসে রইল।
জামাইকে সে বিশ্বাস করে, সব সময় স্নেহের সঙ্গে কথা বলে। আজ প্রিয়ন্তী সম্পর্কে সে যা বলল তাতে দীপক বাবুর অবিশ্বাস নেই। প্রিয়ন্তী লেখাপড়ায় ভালো তাতে কোন সন্দেহ নেই, হয়ত পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করবে সেটাও মোটামুটি নিশ্চিৎ কিন্তু লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না এই বিশ্বাসটা দিনে দিনে ক্ষীণ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর দীপক বাবু যখন মাথা তুলল তখন তার চোখ দু’টো লাল, গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের আভা ষ্পষ্ট। তার মুখচ্ছবিতে যেন সমপ্রতি বয়ে যাওয়া ঝড়ের চিহ্ন। জামাই সত্যই বলেছে, তার কথার প্রতিবাদ করার ইচ্ছাও দীপক বাবুর নেই। প্রিয়ন্তীকে নিয়ে দেখা স্বপ্নটা আজ স্মৃতি থেকে মুহূর্তে মুছে গেল।
দীপক বাবু মাথা তুলে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তুমি আমার জামাই, অরুণ ছেলে তোমাদের দু’জনের যা ইচ্ছা হয় করো।
অরুণ বলল, বাবা আমরা আসলে প্রিয়ন্তীর লেখাপড়া বন্ধ করার কথা বলছি না, আজকাল মেয়েরা লেখাপড়া শিখে অনেক বড় অফিসার হচ্ছে, আমাদের সবার ইচ্ছা ছিল সেও একদিন অনেক বড় অফিসার হবে কিন্তু প্রিয়ন্তীর ওপর কি আর আমাদের মান-সম্মান ছেড়ে দেওয়া যায়?
কিন্তু প্রিয়ন্তী যদি রাজি না হয়?
সবাই মিলে তাকে বোঝাতে হবে।
বোঝাও।
বাবা তাহলে প্রিয়ন্তীকে আসতে বলি।
দীপক বাবু মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।
সেদিনের পর থেকে প্রিয়ন্তীর চিন্তার অন্ত নেই।
জামাইবাবু সুশান্তকে তার জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছে, আবার দুজনে একসঙ্গে বের হবে একথাও জেনে গেছে। প্রথমতঃ সে জটিল প্রকৃতির মানুষ, দ্বিতীয়তঃ তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রিয়ন্তীর বিয়ে দেওয়ার জন্য তার ইচ্ছাও অনেক বেশি। এতদিন প্রিয়ন্তী তার লেখাপড়ার কথা বলে বিয়ের কথা এড়িয়ে গেছে। অবশ্য তার বিয়ে করার কথা এড়িয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় ভিত্তি ছিল তার বাবা। বাবা ঠিক থাকলে তার আর কাউকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই।
প্রিয়ন্তী একবার মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকাল, রাত দশটা বাজে।
তার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।
তার দিদি মোবাইল করেছে, হ্যালো প্রিয়ন্তী।
হ্যাঁ দিদি বলো।
ভালো আছিস?
হ্যাঁ, তোমরা সবাই ভালো আছ।
না, আমরা ভালো নেই, বাবার অসুখ, আমি এসেছি তুইও কাল সকালেই চলে আয়।
দিদির কণ্ঠস্বরেতার বাবার অসুখ বলে প্রিয়ন্তীর মনে হলো না। তার কণ্ঠস্বরেকোন অস্বাভাবিকতানেই, একেবারে স্বাভাবিককণ্ঠ।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, কী অসুখ দিদি?
বাবার অসুখ, আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছি, তোকে আসতে বলছি, তুই বুঝছিস না। আমি কি ডাক্তার নাকি, কী অসুখ আবার তোকে বলতে হবে।
আগে আয়, তারপর দেখবি।
ঠিক আছে দিদি, বলে প্রিয়ন্তী মোবাইল রেখে দিল।
বাবার অসুখ শুনে প্রিয়ন্তীর যেমন ভেঙ্গেপড়ার কথা ছিল সে রকম কিছু হলো না। আবার বাবার অসুখ শুনে চুপ করে থাকতেও চায় না। ক্ষণিকের মধ্যেই যেন তার ঘাড়ের রগ দু’টো ব্যথা শুরু করল।
সে জানে যে কোন দুশ্চিন্তায় তার রক্তের চাপ বেড়ে যায় আজো তাই হয়েছে। তার মনে হচ্ছে বাবার অসুখের নাম করে বিয়ে দেওয়ার জন্য এটা একটা কৌশল মাত্র।
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে মোবাইল করল, হ্যালো সুশান্ত।
প্রিয়ন্তী বল।
প্রিয়ন্তী রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, সুশান্ত দিদি মোবাইল করেছিল, বাবা নাকি অসুস্থ?
আমি কাল সকালে তোকে তুলে দিয়ে আসছি, তুই বাড়ি যা।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বাবা অসুস্থ না।
তবে?
সুশান্ত আগেও আমাকে একবার বিয়ে দিতে চেয়েছে কিন্তু আমি বিয়ে করিনি। অবশ্য তখন আমার মনোবল ছিল। কিন্তু এবার আমরা দূর্গা পূজায় একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতে বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেছে। তারওপর সেদিন জামাইবাবু তোকে আমার মেসে অপেক্ষা করতে দেখেছে।
হয়ত সে রকম কোন চেষ্টা আবারো হচ্ছে।
তাহলে কী করবি? বাড়ি যাবি না?
বাবার অসুখ শুনেও বাড়ি না গেলে হয়?
তাহলে সবাই যদি তোকে বিয়ে দিতে চায়?
চাইলেই বিয়ে দিতে পারবে? তুই আমার ওপর বিশ্বাস রাখ, আমি সোজা তোর কাছে চলে আসবো।
হ্যাঁ, অবশ্যই আসবি।
তারচেয়ে আমি বলি তুই সিঁদুর পরে যা, তাহলে কেউ আর বিয়ের কথা বলতে পারবে না।
না সুশান্ত তুই আমার ওপর বিশ্বাস রাখ, প্রিয়ন্তীর শেষের কথাগুলোতে তার দৃঢ় মনোবল ফুটে উঠল।
প্রিয়ন্তীর চোখে ঘুম নেই। অনেক আজে-বাজে স্বপ্নেরমাঝে বার বার করে তার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। সে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছে। প্রিয়ন্তীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল।
একটা অপরিচিত নাম্বারথেকে কল এসেছে, সে রিসিভ করল, হ্যালো নমস্কার।
নমস্কার, আপনি কি প্রিয়ন্তী চক্রবর্তী বলছেন? নারী কণ্ঠের আওয়াজ, কণ্ঠস্বরেবেশ বিনয় আছে।
হ্যাঁ বলুন।
আমার নাম বর্ণালী। আমি অনেক কষ্টে আপনার মোবাইল নাম্বারযোগাড় করেছি।
বলুন আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?
বিদ্যুতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের।
আমি ওকে খুব ভালোবাসি, এক সময় ও আমাকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু এখন শুনছি আপনার সঙ্গে নাকি ওর বিয়ে।
আমার বিয়ে, আমি তো কিছু জানি না।
শুনলাম বিয়ের কথাবার্তা নাকি এক রকম পাকাপাকি হয়েছে, শুভ দিনক্ষণ দেখে একটা তারিখও নির্ধারিত হয়েছে।
বর্ণালী আমি আসলে কিছু জানি না, আপনার মুখ থেকে বিদ্যুতের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা শুনলাম।
যাক আপনি আমাকে জানিয়ে খুব ভালো করেছেন, না হলে হয়ত আমাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হতো।
বর্ণালী মিনতির সুরে বলল, দিদি আমাকে কথা দিন আমার বিদুৎকে আপনি কেড়ে নিবেন না?
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি আপনার বিদ্যুৎকে বিয়ে করব না। আপনি আমারো উপকার করলেন। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
রাখি দিদি, ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।
মোবাইল রেখে দিয়ে যেন প্রিয়ন্তী হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত চলতে লাগল। কয়েকমিনিট পর সে সুশান্তকে মোবাইল করল।
সুশান্ত রিসিভ করল, হ্যালো প্রিয়ন্তী ঘুমাসনি?
না।
কেন?
সুশান্ত একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
কী ঘটনা?
প্রিয়ন্তী বর্ণালীর মোবাইল করার কথা বলে বলল, সুশান্ত তোকে আমার জন্য অনেক ঝড় সামাল দিতে হবে।
দিব।
চল আমরা কালকে এ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করি।
কিন্তু আমি তো এত সব বিষয় জানি না।
জানিস না এখন জানতে হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দেখছি, তুই কিচ্ছু ভাবিস না।
তুই সব ম্যানেজ করতে পারবি?
পারতে হবে, যে কোন মূল্যে আমাকে পারতে হবে। আমি তোকে হারাতে পারবো না প্রিয়ন্তী।
আমিও।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।