আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক মুঠো সুখ

পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম...

রাতের অন্ধকার একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে। কাদের মিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গে। বড় করে একটা হাই তোলে। হাতদু’টো পেছনে টানটান করে শরীরটাকে একটু জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। দুহাতের পিঠ দিয়ে চোখ ডলে দেয় একটু।

“টুলটুলির মা, ও টুলটুলির মা! কই গেলা? আমার অজুর বদনাডা দিয়া যাও তাড়াতাড়ি। আইজ সহাল সহাল কাজে যাওন লাগবে। সহালের ভিড়ডা ধরন না গেলে হারাদিনে আর তেমুন কিছু অয়না। বইয়া বইয়া মাছি মারোন আর কি। নামাজডা পইড়া লই আগে।

আর কিছু খাওনের ব্যবস্তা করো। ” একটা হোগলা পাতার মাদুর পেতে বারান্দায় নামাজ পড়ে কাদের মিয়া। নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। সামনের ঘরের দরজাটা ফাঁক হয়ে যায় একটু। ছোট্ট একটা মুখ বের হয়ে আসে।

সদ্য ঘুম থেকে ওঠা ফোলা ফোলা চোখ, চুলগুলো আলুথালু, তুলতুলে গাল। দেখেলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। কাদের মিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে মেয়েটা। “আব্বা...” “আরে... আমার ময়না পাখি, টুলটুলি, ঘুম শ্যাষ? আয় এদিগে আয়। ” টুলটুলি এক দৌড়ে বাবার কোলে উঠে যায়।

গলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কাদের মিয়া পরম মমতায় চুলে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। কি রকম একটা ভালো লাগায় মন ভরে ওঠে তার। চোখ দু’টো ভিজে ওঠে একটু। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে এভাবে।

মেয়েটাকে দুহাতের উপরে করে মুখটা সামনে আনে কাদের মিয়া। “টুলটুলি, মা আমার, আমার কইলজার টুকরা। আইজকা কি আনমু মা তোর লাইগ্যা?” “লদেন্স আনবা, তিনডা আনবা। ” কাদের মিয়া হেসে ফেলে। লজেন্স ছাড়া আর কিছুর কথা বলেনা এই মেয়ে কখনো।

তিনটা আনতে বলেছে শুনে হাসি পায় তার। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিইবা দিতে পারে সে তার মেয়েকে। কতটুকুই বা সামর্থ আছে তার। মেয়ের মুখের দিকে ভেজা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে।

আবার বুকের মধ্যে চেপে ধরে। চোখ ফেটে পানি আসে ঝরঝর করে। “আব্বা তুমি কান্দো ক্যান?” কাদের মিয়া প্রশ্ন শুনে থমকে যায়। কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা। একটু থেমে বলে, “কানলে চোউখ ভালো থাহে মা, তাই কান্দি।

” “তাইলে আমিও কানমু আব্বা...!” “না মা, তোর কান্দনের দরকার নাই। তোর চোউখ এমনি বহুত ভালো আছে। ” “আচ্ছা, তাইলে কানমুনা!” কাদের মিয়া ভাবনায় তলিয়ে যায়। অভাবের সংসার। জমি জমা নাই কিছুই।

সম্পদের মধ্যে আছে শুধু এই ভিটেটা। তাও ভালো করে একটা ঘরও তুলতে পারে নাই। মাইলখানেক দূরে একটা লঞ্চঘাট আছে। ওখানে ছোট্ট একটা টং ঘরের মধ্যে চা, বিড়ি, সিগারেট, আচার, লজেন্স এসব টুকটাক জিনিস বিক্রি করে সে। যা রোজগার হয় তাতে কোন রকমে বউ আর মেয়ে নিয়ে চলে যায় সংসার।

বাড়তি কিছু করার কোন উপায় নাই। অসুখ বিসুখ বা কোন ঝামেলা হলে সে ধকল সামলাতে পারার মতো অবস্থাও নাই কাদের মিয়ার। তার মধ্যে আবার এই মেয়ে। দেখতে দেখতে চার বছর হয়ে গেলো। এত লক্ষ্মী একটা মেয়ে কি মনে করে যে খোদাতালা তার ঘরে দিলো চিন্তা করে পায়না কাদের মিয়া।

মেয়ের চোখে পানি দেখলে অস্থির লাগে তার। অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়। কি করে এই মেয়েকে সে বড় করে তুলবে, পড়ালেখা করাবে, বিয়ে সাদি দিবে? বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে আশ্রয় চায় সে। ‘তুমি দেইখো খোদা, তুমি দেইখো।

আমি কিছু জানিনা, কিছু না। ’ কাদের মিয়ার বউ এক হাতে একটা থালায় ভাত আর এক হাতে একটা পানির গ্লাস নিয়ে বারান্দায় আসে। ভাতের প্লেটে একপাশে অল্প করে রাখা সিমের ভর্তা, কচু শাক, এক টুকরা নারিকেল আর দুইটা পোড়া মরিচ। “টুলটুলির বাপ, আহো পানতা দিছি। মাইয়ার লগে আর কতো আহ্লাদ করবা? এতক্ষণতো চিল্লাচিল্লি করতে আছিলা।

আর আমার মাইয়া আমার ধারে দ্যাও। হারাদিনতো খবর থাহেনা কুনো। ” “হ মাইয়াতো খালি তোমারই! আমারতো কিছুইনা। ” কাদের মিয়ার কণ্ঠে একটু ঝাঁঝ অথবা অভিমান। মন খারাপ হওয়া ভাবটা লুকাতে পারেনা সে।

বউটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলে। “আইচ্ছা ঠিক আছে তোমারও মাইয়া। এহন গরজ কইরা খাইয়া লও। আর হুনো, আমার লাইগ্যা একটা জিনিস আনবা?” এইটুকু বলে থেমে যায় বউটা। কাদের মিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়।

কিছু বলেনা। “আমার লাইগ্যা একটা নখ পালিশ আনবা?” বউটা লজ্জা পেয়ে যায় কথাটা বলে। ঘোমটাটা আরেকটু টেনে দিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। পায়ের কাছে পাতা মাদুরটার বের হয়ে থাকা হোগলা পাতাটা হাত দিয়ে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করে। কাদের মিয়ার দৃশ্যটা দেখতে খুব ভালো লাগে।

মন খারাপ ভাবটা দূর হয়ে যায় একটু। “আচ্ছা ঠিক আছে আনমু। তয় খালি তোমার লাইগ্যা না। আমার টুলটুলি মায়ও দিবো। তুমিতো দেহি মেলা স্বার্থপর হইয়া গেছো আইজকাইল।

” “হ হইলে হইছি। ” ছোট্ট করে একটা ভেংচি কাটে বউ। কাদের মিয়া শব্দ করে হেসে ওঠে। কাদের মিয়া তৃপ্তি নিয়ে পানতা খায়। পাশে বসা মেয়েকে মাঝে মাঝে এক-দু’নেলা তুলে দেয়।

মেয়ে চুপচাপ বসে খুব মজা করে খায়। কাদের মিয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার নিজে একটু খায়। বউটা হাঁটুর উপর চিবুক রেখে বসে বসে দেখে। সকালের সূর্যের আলো বারান্দাটা ছেড়ে দিয়ে একটু একটু করে ছোট উঠোনটার দিকে নেমে যায়।

ছনের চালের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো টুলটুলির মুখের উপর পড়ে। অদ্ভুত সুন্দর লাগে মেয়েটাকে। _____________ কাদের মিয়া একটা নরম ভালোলাগা নিয়ে পথ চলে। লঞ্চঘাটের কাছাকাছি আসতেই অনেক লোকজনের সমাগম দেখে। বড় একটা এলাকা পুলিশ ঘিরে রেখেছে।

ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা। একটা বড় মতো বুলডোজার এদিক ওদিক আসা যাওয়া করছে। সামনে যা পাচ্ছে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে নিমিষে। কাদের মিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখের সামনে টং ঘরটা ভেঙ্গে যেতে দেখে সে।

_____________ একটা লোক হঠাৎ ঘিরে রাখা জায়গাটায় ঢুকে পড়ে। ভাঙ্গা টং ঘরটার দিকে ছুটে যায়। নিচু হয়ে কিছু একটা তোলার চেষ্টা করে। কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে আসে। মাথার পিছন দিকে ভারী কিছু একটার আঘাতে লোকটা জ্ঞান হারায়।

হাতটা মুঠো হয়ে থাকে। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় লোকটাকে। একসময় হাতের মুঠিটা খুলে যায়। তিনটা লজেন্স টুপ করে নিচে পড়ে যায়। কেউ খেয়াল করেনা।

_____________ চলার পথে, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট অথবা বাসস্ট্যান্ড-এ একটু সময়ের জন্য থেমে এক কাপ চা খাওয়া অথবা একটু অপেক্ষা করার সময় কত মানুষের সাথে টুকটাক কথা হয়, গল্প হয়! ক্ষণিকের এসব অল্প পরিচিত মানুষগুলোর অনুভূতির কতটুকুইবা আমরা মনে রাখি বা মনে রাখার সময় থাকে। প্রতিদিন এভাবে হাজারো গল্প জমতে থাকে সময়ের পাতায় পাতায়। আমরা সেগুলোর কয়টাইবা জানি অথবা লেখি অথবা পড়ি। প্রিয় অগ্রজ, স্বদেশ হাসনাইন এর একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে- যে লেখেনা তার লেখা কোথায় পড়তে পাই? হৃদয়ের সবটুকু শুভকামনা তার জন্য। এভাবেই উঠে আসুক মানুষের কথা, জীবনের কথা- গল্প, কবিতা, কথামালায়।

ভালো থাকুক পৃথিবীর সব সহজ সরল সাধারণ জীবন। সুখে থাকুক সব বাবা, সব মা, সব সন্তান।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।