মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!
কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন পত্রিকায় হেনাকে দোররা মেরে লাশ বানিয়ে ফেলার সংবাদের ফলো আপ দেখছিলাম। আজকাল কারো মৃত্যুতে তেমন শিউরে উঠি না, হয়তো প্রতিদিন পত্রিকাগুলোতে নানা রকমের মৃত্যুসংবাদ ছাপায় বলে চোখ সয়ে গেছে। তবুও কিছু কিছু মৃত্য নি্যে ভাবনার অবকাশ থাকে, ন্যায়-অন্যায় বিচারের প্রসংগ চলে আসে। আর এ ধরণের মৃত্যুর সাথে যদি কোনভাবে ইসলাম নামটি চলে আসে সেটা আমাদের চিন্তাজগতকে আরো নাড়া দেয় এজন্য যে ইসলামের সাথে ইনসাফ শব্দটি জড়িত। তো, ইসলাম কায়েম করতে গিয়ে যেসব মৃত্যু ঘটে সেসব জায়গায় ইনসাফ কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে।
এখন শিরোনামে আসি, কেউ কি বলতে পারেন আরো কয়েকবার বিচারের মুখোমুখী হওয়া, জুতাপেটা খাওয়া, বিয়ের আগে নিজ স্ত্রীকে ধর্ষণ করা, হেনকে গত জুলাইতে আরো একবার শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করা মাহবুবকে ঐ গ্রাম্য সালিশকারীরা কতটি দোররা মেরেছিলেন, ২০০টির মতো মারার কথা ছিল, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেয়ারও কথা ছিল। কিন্তু দোররা কি প্রয়োগ করা হয়েছিল তার উপর? ব্লগের মুসলিম ভাইয়েরা যারা সমাজে মাহবুবের মতো মানুষের উপস্থিতিতে খুব একটা চিন্তিত নন, কিন্তু হেনার মতো যৌন আসক্তিতে(??!!) আক্রান্ত নারীর উপস্থিতি টের পেয়ে যারপরনাই বিচলিত, সমাজের যাবতীয় অনিষ্টের কথা ভেবে রাতের ঘুম হারাম করছেন, তাদের কাছে জানতে চাচ্ছি মাহবুবের কয়টি দোররা খেতে হয়েছে? তাকে কোন হাসপাতালে চিকিতসাসেবা দেয়া হয়েছিল? তিনি কি দোররা খেতে খেতে মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন? আহারে!
নাকি আপনাদের সেই পুরোনো মনোভাব, ছেলেরা তো একটু খারাপই, ওরা অমন একটু আধটু করবেই। কিন্তু মেয়েদের হতে হবে পাক্কা ঈমানদার! একেবারে একশতভাগ খাঁটি মুসলিম। তা না হলে ঘর গেল, সংসার গেল, পরিবার গেল, সমাজ গেল, গেল গেল সব গেল! আমি বলতে চাই, যারা মাহবুবের পরকীয়ার চেয়ে হেনার পরকীয়ায় অনেক বেশি বিচলিত, তারা যতটা না ইসলামী মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা বা নৈতিক সমাজ নিয়ে ভাবছেন, তার চেয়ে বেশি ভাবছেন আসলে নিজেকে নিয়ে। এসব শহুরে শিক্ষিত মুসলিম পুরুষ ব্লগারদের যতটা না ধর্মপ্রেম, তার চেয়ে বেশি নিজের স্বার্থ।
কারণ, তারা খুব ভাল করে বোঝে দোররা মারার মত ঘটনা শহরে ঘটার সম্ভাবনা অনেক কম, সে তুলনায় পরকীয়া ঘটবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ধর্ম কই গেল, ঠিকমত আছে কিনা, ঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, তার চেয়ে বড় কথা উনাদের বর্তমান/ ভবিষ্যত বৌয়েরা আবার কারো সাথে পরকীয়া করছে বা করবে না তো? নাহ্, উনাদের এই চিন্তা দোষণীয় কিছু নয়, নিজের পরিবারের ভাল চিন্তা করবে না কেন? কিন্তু উনাদের প্রতি অনুরোধ থাকলো, এইসব কথাবার্তার সাথে যেন ইসলামসেবাকে গুলিয়ে না ফেলে। যেন তারা এসব বলে খুব ইসলামের উপকার করছেন, ইসলামকে ধন্য করছেন, তা না ভাবেন।
এবার আমার "অতীব পরহেজগার" ইউনিযন পরিষদের সদস্য ইদ্রিস শেখের কাছে জিজ্ঞাসা (উনি সদস্য নির্বাচিত হবার সময়ে কোন দূর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন কিনা, উনি ব্যক্তিগতভাবে কতটা ধার্মিক আপাতত এই বিষয়গুলো আমরা অনুসন্ধান না করি) [মনে করলাম যে আপনি উচ্চ আদালতের ফতোয়া সংক্রান্ত রায়ের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল], আপনি যে প্রচলিত প্রশাসনের প্রতিনিধি, তার প্রতি আপনার নিজেরই আস্থা নেই, তাহলে আপনি কেন এই কুফরী প্রশাসনের সদস্য হতে গেলেন? এতে করে তো ঐ কুফরী প্রশাসনের প্রতি আপনার আনুগত্যই প্রকাশ পায়। ধরে নিলাম আপনি নিরুপায়, একা কিভাবে পুরো ব্যবস্থা পাল্টে ফেলবেন, কিন্তু আপনি ইসলামী শরিয়া আইন প্রচলনে তো মারাত্মক সতসাহস দেখিয়ে ফেলেছেন! সাধুবাদ! আপনি একটা সালিশবোর্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে বোর্ড কিনা আপনার ইউনিয়নের নীতি-নৈতিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে দারূণ এক কাজ করেছে।
প্রায় "রজম" তথা পাথর মেরেই হত্যা করে ফেলতো দুই পাপাচারীকে, তাও রক্ষে! কেউ কেউ আপত্তি জানিয়েছিল রজমে, তাই দোররাই সাব্যস্ত হলো। আপনার কাছে সবিনয় জিজ্ঞাসা দোররা আগে কাকে মারা উচিত ছিল? অবিবাহিত হেনাকে নাকি বিবাহিত মাহবুবকে? এখানে কার অপরাধ বেশি ছিল, এক্ষেত্রে কোরআন কি বলে? না হয় আপনাকে মাদ্রাসার সুপার সাহেব শাস্তির রকম বাতলে দিয়েছিল, কিন্তু কাকে আগে এবং বেশি গুরুত্বসহকারে শাস্তি দেবার দরকার ছিল, এইটুকু বিবেচনাবোধ বা প্রজ্ঞাও কি আপনার নেই? তবে কেন জনপ্রতিনিধি হতে যান? যে আপনার শরীয়া আইনের প্রতি এতোটা শ্রদ্ধা, দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি বুড়ো আংগুল দেখালেন, সে আপনি আজ পুলিশ আর মামলার ভয়ে পলাতক কেন? আবার ফোনে হুমকি দিচ্ছেন মামলা তুলে নেয়ার, টাকা দিয়ে মীমাংসা করতে চাইছেন, আপনার ঈমানী জোশ কোথায় হারিয়ে গেল? ইসলামের সেবা করতে গিয়ে এমন সহজে শহীদ হবার রাস্তা আপনি পাবেন কোথায়, কবে আবার সে সুযোগ মিলবে? হেনা হত্যার দায়ে প্রচলিত আইনে হয়তো আপনার ফাঁসী হতে পারে, আপনাকে অনুরোধ ইসলামের রাস্তায় শহীদ হবার এমন সুযোগ হেলায় হারাবেন না। বরং, বীরদর্পে মাথা উঁচু করে আত্মসমর্পণ করুন, আল্লাহ্র নামে দাবী করুন "যাহা করিয়াছেন, ঠিক করিয়াছেন, ইসলাম তো ইহাই করিতে বলিয়াছে, তোমাদের ঐ কুফরী আইন আমি মানি না। এই আমি জিহাদ ঘোষণা করিয়াছি যাবতী্য কুফরী আইনের প্রতি। "
মাননীয় মাদ্রাসা সুপার সাইফুল ইসলামকে বিনীত জিজ্ঞাসা (মনে করলাম আপনি উচ্চ আদালতের রায়ের ব্যাপারে বেখবর), আপনার দেয়া ফতোয়ার ব্যাপারে কি আপনার আস্থা নেই? আপনি কি সেটা আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য দেননি? তাহলে আপনি ভয় করছেন কাকে? কেন আপনি পলাতক? ইসলামের পথে শহীদ হবার এমন সুযোগ কি বারে বারে আসবে? আপনারা যারা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন, তাদের অন্তরে জিহাদের লিপ্সা আমাদের মতো সাধারণদের তুলনায় অনেক বেশি থাকে।
আপনি তো দেশের প্রচলিত আইনের বিপরীতে বিরাট বিদ্রোহ করে ফেলেছেন! তারপরও কি বিবেক কোথাও খোঁচাচ্ছে? কোথাও কি কিছু ভুল হয়ে গেল? আপনাদের এই শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইসলাম যে ইনসাফের কথা বলে তা কি ছিল? যদি থেকে থাকে তবে কেন পুলিশ, প্রশাসনকে এতো ভয়?
নাকি ধর্ম যেদিকে যায় যাক্, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!
যে সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতি, যে দেশ দূর্নীতিতে সারা বিশ্বে চ্যাম্পিয়নশিপে হ্যাট্রিক করে, সে দেশে চুরির দায়ে কারো হাত কাটার ফতোয়া দেয়া হয়েছে, আজ পর্যন্ত শুনিনি! বড় আফসোস!
একটা সমাজ যার বেশির ভাগ মানুষের তাকওয়ার অভাব, আস্তিক তো নামায পড়ে না, নামায পড়ে তো ঘুষও খায়, মিথ্যেও বলে, যে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্"র অর্থ ঠিকভাবে বোঝে না, সে সমাজের মানুষেরাই তসলিমারে নিয়ে, প্রভাবে নিয়ে, হেনারে নিয়ে সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে, কিন্তু তাদের বিবেকের ফাঁক গলে ঠিকই রুদ্ররা ছাড়া পায়, রাজিবেরা আড়ালেই থাকে, মাহবুবরা দোররার হাত থেকে বেঁচে যায়।
এমন এক সমাজ তৈরী হয়েছে আমাদের বিয়ের সময় খোঁজ করে পাত্রী কত সুন্দরী, বা পাত্র কত প্রতিষ্ঠিত, কে কেমন ঈমানদার তার খোঁজ নাই। আবার কিছু ধার্মিক ভাইয়ের পাত্রী কয় ওয়াক্ত নামায ঠিকমতো পড়ে, তার চেয়ে বেশি খোঁজ ঘর থেকে বের হতে বোরকা পরে তো? আবার বিয়ের পরে বৌ নামায-রোযা ঠিকভাবে করছে কিনা, তার চেয়ে বেশি খোঁজ স্বামীসেবা ঠিকমতো করছে কিনা!!!! স্বামী নামায পড়ছে কিনা তার চেয়ে বেশি খোঁজ অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ছে না তো!!!!
এই সমাজে মুসলিম ভাইয়েরা ব্যস্ত নারীরা কেন পর্দা করছে না, নারীরা কেন ঘর থেকে বের হয়, কেন চাকরী করবে, নারীর পোশাক ঠিক আছে কিনা, নারীরা ঠিকভাবে নির্দিষ্ট নিয়মে চলছে কিনা, এদিকে দূর্নীতি, ঘুষ, মিথ্যে, চুরি, অবিচার, অনাচার, শির্ক, কুফরীতে দেশ-শহর-গ্রাম ছেয়ে যাচ্ছে, সেদিকে বিশেষ পদক্ষেপ নাই। ভাবখানা এমন সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানে নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়া, নারীদের উপর খবরদারী করতে পারা গেল তো সব জয় হয়ে গেল!
সবশেষে আলেমসমাজের কাছে আমার আন্তরিক জানতে চাওয়া, যেহেতু কোরআনে শুধু দোররার কথা আছে, পাথর মারার কথা সরাসরি উল্লেখ নাই, কেবল কিছু হাদীসে পাওয়া যায়, তাই ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে পাথর মেরে হত্যাকে আধুনিক কোন প্রচলিত শাস্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব কিনা? দোররার রকম সম্বন্ধে কিছু বৈশিষ্ট্য বা সীমাবদ্ধতা কি দেয়া যেতে পারে, যাতে করে ৭০-৮০টি বা ১০০টি দোররা খাবার পর কাউকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে না হয়, সে যেন নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ পায়। হাদীসগুলোর আক্ষরিক অর্থের দিকেই কি সবসময় আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে, নাকি অন্তর্গত শিক্ষাটাই বেশি জরুরী?
রাসূল (সা: )-এর যুগে যেসব হাতিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার হতো বা যেসব রণকৌশল ব্যবহার হতো, তার অনেক কিছুরই আজ আর প্রচলন নেই।
আজ কিছু মুসলিম দেশ অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রও তৈরী করছে বা যুদ্ধে বা জিহাদে ব্যবহার করছে, কিন্তু এসব নিয়ে আলেমদের কোন আপত্তি শুনিনি। দাসপ্রথা আজ আর নেই বললেই চলে। রাসূলের যুগে ছিল বলে সুন্নাহ্ হিসেবে সে প্রথা কেউ চালু রাখেনি। তাহলে দোররা বা পাথর মারা ঠিক আগের মতই থাকতে হবে কেন?
রজমের ব্যাপারে কারো জানার ইচ্ছে থাকলে নিচের পোস্টটি দেখতে পারেন,
http://www.peaceinislam.com/bngsadat/4903/
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।