আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কষ্টের লোনা জল,

সকালের মিষ্টি রোদ পেরিয়ে আমি এখন মধ্যগগনে,
এক বিকেলে অফিস থেকে ফেরার গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাল শাহেদ। আর স্ত্রী ত্রপার জীবনে নেমে এল এক অদ্ভুত আকষ্মিক বিমুঢ়তা। যদিও ত্রপা বরাবরই বাস্তববাদী। ঠুনকো কোনো আবেগ তাকে সহজে ছুঁতে পারত না। স্বামীর মৃত্যুতেও গুণে গুণে কয়েক ফোটা লোনা জলই কেবল চোখের কোণ থেকে ঝেরে ফেলেছে।

এরপর শাহেদের লাশ কবরে লুকিয়ে রাখা অবধি নির্বাক-নীরব থেকেছে শুষ্ক চোখে। এতে কাছেপিছের একদুজন প্রতিবেশি এবং আত্মীয় কেউ কেউ বাঁকাচোখে তাকিয়ে ত্রপাকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখে নানারকম অশস্তিকর মন্তব্য ও তীর্যক বাক্যবাণে বিদ্ধ করার চেষ্টাও করেছে। ত্রপা যে একেবারে বুঝেনি তা নয়। ওসব মানুষের কিংবা দুর্মোখের কাছে দরদী সাজবার অভিপ্রায় তার মোটেও নেই। যার কাছে সে দরদী ছিল, বুকে আগলে রেখেছিল যে মানুষটা তাকে, সেই তো চলে গেছে তাকে ছেড়ে; এখন সে দরদ দেখাবে কাকে, কোন দুখে? সে জানে তার অন্তর কতটা কষ্টের লোনা জলে হাবুডুবু খাচ্ছে।

চোখের লোনা জলের দাম কী তার অনু পরিমাণও আছে? চোখের জল ঢেলে দেখাতে হবে সে কতটা ভালোবাসত শাহেদকে? শাহেদের সাথে ত্রপা যেদিন ঘর বেঁধেছিল, শাহেদের বুকের জমিনে মাথা রেখে বিলি কাটতে কাটতে প্রতিশ্র“তি করিয়েছিল, কখনোই যেন শাহেদ তাকে ছেড়ে না যায়, একটুও দুঃখ না দেয়। কথা রাখেনি শাহেদ। তাকে ছেড়ে গিয়ে, রাজ্যের সব দুঃখ তার মাথায় চাপিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে। উফ্, কী পাষাণ মানুষটা! এই প্রতিশ্র“তি নেয়ার কারণ সে দুঃখ মেপে মেপে বড় হয়েছে। বাবাহীন মায়ের সংসারে বড় হয়েছে দিনক্ষণ গুণে গুণে।

ত্রপার বয়স যখন সবে একবছর সাত মাস, ঠাস করে মরে গেলেন তার বাবা। মা চাকরি নিলেন একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে। যত ক্লায়েন্ট তত কমিশন। তত ইনকাম। তাই মাকে সময়ে-অসময়ে কাজে যেতে হয়েছে হুটহাট।

ফিরেছেনও তেমনি। ত্রপাকে বড় করে তোলার দায়িত্ব পড়েছিল নানির কাছে। খাওয়ানো-পড়ানো, আদর-যতœ নানি বিলিয়ে দিয়েছেন তার সামর্থ অনুযায়ি। মায়ের আদরটা বিদ্যুতের লোডশেডিং এর মতো আপডাউন করতো। এতে যা হয়, মায়ের আদর-সোহাগে ত্রপার মনটা পুরোপুরি ভেজেনি কখনো।

এভাবেই বড় হওয়া। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে একটা চাকরি নেয়া। শিক্ষিকার চাকরি। চাকরি সূত্রেই পরিচয় কলিগ শাহেদের সাথে। প্রথমে ভালোলাগা।

ভালোবাসা। এবং একদিন এক কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলা। বিয়ে যে করলে বাবা-মাকে বউ দেখাবে না? কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে রিকসায় বসে স্বামীকে বলা ত্রপার প্রথম কথা। দেখাবো, স্কুল বন্ধ হলে বাবা-মাকে নিয়ে আসবো ঢাকায়। না।

বাবা-মাকে আনতে হবে না। চট করে স্বামীকে দ্বিতীয় কথাটি বলে। কেন কেন? স্বামীর অবাক হওয়া প্রশ্ন। তোমার সাথে আমিও যাবো। বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে সালাম করে আসবো।

বাবা মা কেন ছেলের বউর সালাম নিতে এখানে আসবেন! ওনাদের এমন কী ঠেকা পড়েছে। আমি কি তা বলেছি। তুমি আবার কষ্ট করে এই গরমে গ্রামের বাড়ি যাবে? গ্রামের বাড়ি যাওয়া যে কী বিড়ম্বনা তুমি জানো না ত্রপা। জানি না বলে কী হয়েছে। তোমার সাথে গেলেই জানা হয়ে যাবে।

আর এ কথা বলছ কেন, বিড়ম্বনা বলে কী বাবামাকে দেখতে হবে না? প্লিজ শাহেদ, আমাকে এধরণের কথা শুনাবে না। আমি অন্য আটদশটা বউর মতো হতে চাই না। আমি তোমাকে যেমন ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমার বাবামা, ভাইবোনকেও। নতুন বউর মুখে এ কথা শুনে শাহেদের মনটা ভালো হয়ে যায়। এ যুগে এমন লক্ষ্মি বউ হয়? মনের গোপন কথাটা কী করে যেন মুখ ফুটে বেরিয়ে যায় শাহেদের।

শ্বশুর শ্বাশুরিকে সালাম করলেই বুঝি বউ লক্ষ্মি হয়ে যায়? এটা তো আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আমাদের বিয়ের ব্যাপারেও তো তোমাকে বলেছিলাম, মোবাইলে না করে বাড়ি গিয়ে অনুমতি নিয়ে এসো। বললে কী, আমার বাবা-মাকে তুমি চেন না। আমার কাজের প্রতি তাদের অগাধ বিশ্বাস। বিয়ে করছি শুনেই তো বাবা মা খুব খুশি।

ঠিক আছে তুমি যখন বলছ, দুজনেই একদিন সময় করে বাড়ি যাবো। যাই যাই করে আর শাহেদের যাওয়া হয়নি। বরং হুট করে চিরতরে হারিয়ে গেল। তাহলে ক্ষোভটা কি মানুষটার উপর পড়বে না? ত্রপা নীরবে ক্ষোভ ঝেরেছে শাহেদের উপর। তুমি এভাবে যদি চলেই যাবে তো কেন এসেছিলে জীবনে? এলেই যখন আমাকে সাথে নিলে না কেন? তুমিহীন আমি বেঁচে থাকতে পারব কিনা অন্তত একটিবার ভেবে দেখতে পারতে? আমার ভালোবাসার বান্ধব কে আছে তুমি ছাড়া? আমি এখন কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? তুমিহীন শূন্য পৃথিবীতে কীভাবে বাঁচবো? আসলেও ত্রপা বুঝতে পারছে না সে এখন কী করবে।

স্কুলের চাকরিতে যাওয়া হয় না শাহেদ মারা যাবার পর থেকেই। কী হবে চাকরি করে? চাকরি তো করেছে সুন্দর একটা গোছানো পরিপাটি সংসার সাজানোর জন্যে। এছাড়া একই প্রতিষ্ঠানে, একই ছাদের নিচে স্বামী-স্ত্রী দুজন একই সাথে কাজ করছে, ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে, অফিসে পাশাপাশি বসে আড্ডা দিচ্ছে, কী আনন্দের কথা! অথচ শাহেদের মোটেও সায় ছিল না বিয়ের পরে ত্রপা চাকরিটা করুক। শাহেদের যুক্তি, ছোট্ট ছেলেমেয়েদের পড়াতে পড়াতে টিচাররা একসময় হাঁপিয়ে উঠে। তখন নিজের সন্তানকে অন্তর নিংড়ানো আদরটা দেয়া যায় না।

ত্রপাও যদি হাঁপিয়ে উঠে। তাদের অনাগত সন্তানকে যদি নিংড়ানো আদর না দিতে পারে! তাহলে কি তুমি বলতে চাইছ দুজনেই স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দেই? অনেকটা ক্ষোভ আর ম্রিয়মাণ জেদ ঝরে পরে ত্রপার কথায়। দুজন কেন চাকরি ছাড়তে যাবো! তুমি একা ছাড়বে। তার মানে সন্তানকে বাবার আদর দরকার নেই? তুমি চাকরি করলে আমার সন্তান বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে না? আমি তা চাই না। আরে না, আমি তো পুরুষ মানুষ।

বাবার আদর কমতি হলেও মায়ের আদর সন্তানের জন্য খুবই জরুরী। ভেতরে ভেতরে একটু রাগ হয় ত্রপার। তাকে কি শেখাতে হবে মায়ের আদর না পেলে সন্তানের বুকের ভেতরটা কীভাবে হু হু করে উঠে! কেন দীর্ঘশ্বাস ভারি হয়ে উঠে। বাবার আদর পেতে না পেতে বাবা চলে গেলেন। আর মায়ের আদর? ত্রপার নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে।

শাহেদকে আর কিছু বলে না সে মুহূর্তে। সে জানে মানুষটার সবকিছুই তার জন্য। বউকে সুখ দেয়ার জন্য। বউপাগল স্বামীরা যেমনটি হয়। সারাদিন খুঁজে বেড়ানো কিসে বউর সুখ।

শাহেদ যতই বলুক সন্তানের আদরের কথা। ত্রপা জানে, এসবই ছুতা। ছল। বউকে কাজ করতে না দেয়ার ছল। কষ্ট না দেয়ার ছল।

সেই মানুষটা তার বুকে পৃথিবীর বেবাক কষ্ট ঢেলে দিয়ে চলে গেল! সব আনন্দ-স্বপ্ন, আয়োজন-প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে ত্রপার। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। চাকরি না করার সিদ্ধান্ত। মেয়ের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তার মা। চাকরিটা ছেড়ে দেয়া তোর ঠিক হবে না।

তুই বাস্তববাদী মেয়ে। স্বামীহারা আবেগটাকে কাজে লাগা কর্মের মাধ্যমে। তোকে তো বাঁচতে হবে। আমাকে দেখে কি তুই কিছু শিখিছ নি? আমিও তো স্বামীহারা অভাগী। আমি কি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম? তোর জন্য আমাকে নতুন করে বাঁচতে হয়েছে।

ঘরের বাইরে যেতে হয়েছে। কাজ জোগাতে হয়েছে। আর তুই কিনা রেডি চাকরিটাকে ছেড়ে দিতে চাইছিস? আরেকবার ভেবে দেখ। ভেবে দেখার কি আছে। বাবা মারা যাবার পর তুমি নতুন করে আমার জন্য বাঁচতে চেয়েছ।

কাজ নিয়েছ। কিন্তু আমার তো তোমার মতো কোনো ত্রপা নেই। যার জন্য চাকরিটাকে ধরে রাখতেই হবে। তা নেই। কিন্তু তোকে বাঁচতে হবে না? তোর সামনে অনন্ত সময় রয়ে গেছে।

তোকে খাওয়াবে-পড়াবে কে? মানুষ কদিন খাওয়াবে? আমিই বা কদিন খাওয়াতে পারবো? কিংবা ধরে নে মেয়ে হিসেবে আমিই তোকে খাওয়াতে পড়াতে বাধ্য থাকলাম। আমি যদি মরে যাই? তখন? তোকে কে দেখবে? এসব বৈষয়িক ব্যাপারগুরো খুব ভালো করেই বুঝে ত্রপা। সে জানে, মায়ের কথায় বিশাল একটা যোগবিয়োগ আছে। হিসাব-নিকাশ আছে। সে নিজেও জানে, ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের অন্যতম সাপোর্ট।

প্রধানও বলা যায়। কিংবা সে ধরে নিচ্ছে একমাত্র সাপোর্ট। কিন্তু বেঁচে থাকতেই হবে, এ বিষয়টা কি অন্যতম কিংবা বিশ্বাসের একমাত্র জায়গা? কোনো সিদ্ধান্তেই স্থির হতে পারে না ত্রপা। তাই মাকে সান্ত্বনা দিতে বলে, ঠিক আছে মা, আমি ভেবে দেখব। ভেবে দেখার কিছু নেই, আমি মা হয়ে তোকে রিকোয়েস্ট করছি, চাকরিটা ছাড়িছ না।

তোর জন্য না করিস অন্তত আমার জন্য চাকরিটা কর। আমি আর কত খাটবো রে। আমার আর ভাল্লাগে না। ছোটবেলায় তুই আমার মেয়ে ছিলি। আজ থেকে নাহয় তোর মেয়ে হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো? মা, চাকরিটা তুই কর।

মায়ের এরকম আবেগতাড়িত কথায় ত্রপার ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠে। কিন্তু ভেতরের কান্নাটা বাইরে প্রকাশ পায় না। তার চোখ গলে লোনা জল বেয়ে পড়ে না। মায়ের বুকে মাথা রেখে সে বলে, হ্যাঁ মা, তুমিই আমার ত্রপা। মা ত্রপা মেয়ে ত্রপার চোখের জল মুছে দেয় নিজের আঁচলে।

এক ত্রপা নতুন করে বাঁচতে চায় আরেক ত্রপার জন্য।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।