আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চির নিভৃত বাবা

পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম...

পেশার প্রয়োজনে দিনের বেশির ভাগ সময়ই কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে হয়। আর রাতের সময়টা নির্জন থাকাতে কাজে মনযোগটা একটু বেশি হয়। ধীরে ধীরে রাত জাগার অভ্যাসটা পাকাপাকি হয়ে গেছে। কিছুদিন ধরে মাথাধরাটাও তাই অনেকটা ছায়াসঙ্গী হয়ে আছে। রাত ১২টার দিকে প্রচণ্ড মাথাধরায় একটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে সজল।

ক্লান্ত দেহে ঘুম আসতে খুব বেশি সময় লাগেনা। বেশ কিছুদিন পর ভালো একটা ঘুম হয়। সারে পাঁচটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। নামাজ পড়তে উঠতে হবে। হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে।

অনেকদিন বাবার ডাকে ঘুম ভাঙ্গেনা। ভোরবেলা উঠে বাবা প্রতিদিন সবাইকে ডেকে তুলতেন নামাজ পড়ার জন্য। এই দূর শহরের বুকে একলা জেগে থাকা সজলের চোখে চেনা কষ্টে আর্দ্রতা জমে ওঠে। কেন যেন কাঁদতে ইচ্ছে করে খুব। অনেকদিন পর কান্নার তৃপ্তি নিয়ে জায়নামাজ ছেড়ে ওঠে সজল।

বন্ধু বলে- “চল্, বাইরে থেকে ঘুরে আসি। ” সকালের মৃদু শীতল বাতাসে গা জুড়িয়ে যায়। একটা চেনা ভালো লাগায় মন ভরে ওঠে। বন্ধু এটা সেটা কথা বলে। সজল হু হা করে যায়।

খুব একটা মনযোগ দিতে পারেনা। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে বাসায় চলে আসে। কেন যেন বাবার কথাটা মাথা থেকে সরাতে পারেনা সজল। কথা বলতে ইচ্ছে করে খুব। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে রেখে দেয় পাশে।

ল্যাপটপটা খুলে বসে পড়ে। একটা ডক ফাইল খুলে কিবোর্ডে আঙ্গুল রাখে। আনমনে বাবাকে উদ্দেশ্য করেই লিখতে শুরু করে। ------------------------------- বাবা, প্রথম বার তোমাকে লিখছি এভাবে। জীবনে অনেকবার অনেক মানুষকে চিঠি লিখেছি।

সময়ের পরিবর্তনে চিঠির জায়গা নিয়েছে ইমেইল। সেখানেতো আর বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তাই নিয়মিত বেহিসেবি লিখে চলা। কিন্তু তোমাকে এভাবে কখনো লেখা হয়নি। কেন লিখছি, কি লিখবো কিছুই জানিনা।

আর তুমি হয়তো এ লেখা কোনদিন পড়বেওনা। কিভাবে শুরু করবো তাও জানিনা। শুধু জানি খুব বেশি মনে পড়ছে তোমাকে, খুব। বাবা, তোমার মনে আছে?- সেইযে ছোটবেলায় সারাদিনের ছুটোছুটির ক্লান্তি শেষে সন্ধ্যের একটু পরে ঘুমিয়ে পড়তাম সামনের ঘরে। তুমি কাজ-টাজ সেরে আমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে যেতে।

আমি আধোঘুমে কি যে নির্ভরতায় তোমার গলা জড়িয়ে ধরতাম। উপর তলায় বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিয়ে টুকটুক করে কথা বলতে। কখন গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম টের পেতামনা। আর এখন কত নির্ঘুম রাত কাটে। ইচ্ছে করেও ঘুমাতে পারিনা।

হয় কাজ থাকে না হয় এমনিতেই ঘুম আসেনা। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি। বুকের ভেতরটা খালি হয়ে থাকে কোন একটা স্পর্শের জন্য। সময় এত কঠিন কেন বাবা, বলতে পারো? সময় সব কিছু কেড়ে নেয় কেন? একবার সেইযে আমার একটা পরীক্ষা নিলে। তখন কোন্ ক্লাসে পড়ি ঠিক মনে নেই।

ক্লাস থ্রি হবে হয়তো। বাংলা পরীক্ষা। তুমি সব কেটেকুটে নাম্বার দিলে। তিন নাম্বারের জন্য লেটার পেলামনা। তারপর থেকে আমার সেকি কান্না, সে যেনো আর থামার নয়।

মা’তো রেগে মেগে অস্থির। অনেকবার বারণ করলো। কে শোনে কার কথা? কান্না কি আর রাগ মানে? মা যতো রাগে আমি ততো ফুঁসে উঠি। আমার যে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো তোমার উপরে। এখন মনে করে খুব হাসি পায়।

কি যে ছেলেমানুষ ছিলাম। অথচ তখনকার সেই রাগটুকু, অভিমানটুকু একটুও কৃত্রিম ছিলোনা বাবা। মা শেষ পর্যন্ত বের করে দিলেন ঘর থেকে। শীতের রাত ছিল সেদিন। সামনের বাসার বড় ভাইটা, সবসময় আমাকে ক্ষেপাতো যে, একদম তার সামনে পড়ে গেলাম।

তখনতো আর বুঝতামনা বড় ভাইরা আমাকে আদর করে বলেই ক্ষেপাতো। তাকে দেখলেই রাগ হতো তখন। আর সেই অপমানের সময় কিনা পড়ে গেলাম ঠিক তারই সামনে! আমারতো লজ্জার আর শেষ নেই। তোমার উপর রাগটা আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু সেই তোমাকেই যখন দেখলাম একটু পরে মিটমিট করে হাসতে হাসতে আমার কাছে এলে, আমি কিন্তু তোমার বুকেই আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন।

তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁসিয়ে ফুঁসিয়ে সেই ছেড়ে দেয়া কান্না। সেযে কতোটা মায়া আর ভালোবাসায় জড়ানো ছিলো তখন হয়তো কিছুই তার বুঝিনি। এখন বুঝি হয়তো কিছুটা। যখন খুব কষ্ট পাই, খুব বেশি অসহায় লাগে নিজেকে, একটা বুক খুঁজি মুখ লুকাতে, একটা গলা খুঁজি জড়িয়ে ধরতে। শূন্যতায় হাতড়ে বেড়াই, পাইনা কিছুই।

বাইরের শূন্যতা গ্রাস করে আমার ভেতরের সবটুকু। বুকের পাঁজরগুলো দুমড়ে মুচড়ে যেতে চায় যেনো। একটা আশ্রয় আর বুঝি মিলবেনা কখনো। বাজারের দিন একহাতে খালুই ঝুলিয়ে আর একহাত দিয়ে তোমার হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম। এত মানুষের ভিড়ে ভয় লাগতো।

তোমার হাতটা আঁকড়ে ধরে থাকতাম। ঘুরে ঘুরে বাদাম, মোয়া, জিলাপি এসব দোকানের সামনে যখন থামতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো আমার। আবার যেদিন সাথে যাওয়া হতোনা, নিজের যত ছেলেমানুষী ব্যস্ততার ফাঁকেও কান পেতে থাকতাম দরজার দিকে। কখন তুমি আসবে, ডাক দিবে। কাগজে মোড়ানো কিছু একটা এগিয়ে দেবে আমার দিকে, যাই থাকুক ওটার ভেতরে।

সে যে কি আনন্দ ছিলো কিভাবে বোঝাবো বলো? বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় দিনে তোমার সাথে সাথে যেতাম মসজিদে বা ঈদগাহে, টুপি পাঞ্জাবী পড়ে ছোট্ট শান্ত বাবুটি হয়ে। আবার তোমার সাথে তোমার স্কুলেও যেতাম। তোমার ছাত্র-ছাত্রীরা নানান কথা বলে ক্ষেপাতো। বড় বোনের বান্ধবীরা দুষ্টামী করতো খুব। লজ্জায় লাল হয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম।

আর সুযোগ খুঁজতাম কখন দৌড়ে পালাবো। সেই সব দিনের কথা তোমার মনে আছে বাবা? এখনো পথ চলতে গেলে যখন হঠাৎ নিজেকে খুব বেশি একা মনে হতে থাকে, কোন হাত এসে তোমার মতো আগলে ধরেনা। প্রতিদিন হারিয়ে যাই একটু একটু করে শত মানুষের ভিড়ে। মায়ের বকুনি আর পিটুনি সেতো নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় ছিলো। কিন্তু এই তুমি কখনোই কিছু বলতেনা।

একটু উচ্চ স্বরে কথাওনা। তবুও কেন যে তোমাকে এতটা সমীহ করতাম জানিনা। তোমার স্কুলে ছাত্র হয়ে গেলাম। প্রতাপশালী প্রধানশিক্ষক হিসেবে তোমাকে অন্যরা যেরকম শ্রদ্ধা করতো বা সমীহ করতো আমি জানিনা আমার কাছে তুমি কিরকম ছিলে। বুঝতে পারতামনা ঐভাবে।

একবার মনে আছে?- ক্লাস এইটের বৃত্তি কোচিং মনে হয় চলছে তখন। আমি একটু দেরি করে ক্লাসে গিয়ে ঢুকতে চাইলাম। তুমি বললে- না। আমি এক মুহূর্তে নিভে গেলাম। আর একবারও অনুরোধ করলামনা।

ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে যখন আরেকজনকে দিয়ে ডাকিয়ে নিলে, আমি ভেতরে ঢুকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। সেদিনযে কেন কেঁদেছিলাম আমি নিজে আজও জানিনা। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন, খুব। তুমি হয়তো অপ্রস্তুত হয়েছিলে।

আমার মাথায় সেসবের কিছুই ছিলোনা। অভিমানে আর রাগে আমার সেই কান্না থামতে অনেক সময় লেগেছিলো সেদিন। স্কুলে প্রথম শাস্তিটাও আমি তোমার হাতে পেয়েছিলাম বাবা। মনে আছে তোমার? তুমি ইংরেজি পড়াতে। কিছু একটা পারিনি ক্লাসে।

অন্য না-পারাদের সাথে আমিও ছিলাম। বললে, পড়া না দিয়ে আজকে কারোর ছুটি নেই। জীবনে প্রথম সেদিন বেত এর আঘাত অনুভব করেছিলাম। শারীরিক ব্যথাটা কিছুই হয়তো মনে হয়নি। কিন্তু সেই শাস্তিটা বুকের গভীরে কোথাও লেগেছিলো সেদিন।

যে বাবা কোনদিন একটু উচ্চ স্বরে কথাও বলেনা, সেই বাবা যখন শিক্ষক হয় তার দেয়া শাস্তি আমি কিভাবে সেদিন গ্রহণ করেছিলাম জানিনা। তবে মনে হয় সেদিনের সেই অনুভূতি আজও বুকে আগলে রেখেছি। সেই ব্যথাটা মাঝে মাঝে নেড়েচেড়ে দেখতে খুব ভালো লাগে এখন। একলা চলার পথে সেই ব্যথার অনুভূতি পাথেয় হয়ে থাকে। আরেকদিনের কথা মনে পড়ে গেলো।

তখন ক্লাস টেন এ পড়ি সম্ভবত। তোমার ক্লাসে বসে আছি। হঠাৎ একজন ছুটে এলো দৌড়াতে দৌড়াতে। এসে একদম আমাদের ক্লাস রুমের সামনে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে জামাকাপড়।

ফিনকি দেয়া রক্তে বারান্দাটাও ভিজে গেলো নিমিষে। একটু আগেই পিঠের উপর থেকে নিচে ধারালো কিছু দিয়ে কেটে দিয়েছে কেউ একজন। পরে জেনেছিলাম তার নাম। জীবনে প্রথম সেদিন অনেক রক্ত দেখলাম, তাজা ফিনকি দেয়া রক্ত। বন্ধুরা মিলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।

মনে হয়না কোনদিন ভুলতে পারবো সেই দৃশ্য যার সাথে তুমিও মিশে আছো কোনভাবে। আমি কখনোই কোন কিছুতে সিরিয়াস ছিলামনা। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার সময় মনে আছে টেনশনে তোমার সেকি অবস্থা! আমার টেনশন হবে কি, উল্টো তোমার অবস্থা দেখে হেসেই খুন। এসএসসি পরীক্ষার পরে সেই প্রথমবার বাড়ির বাইরে বের হওয়া। এতটা বছর যাকে বুকে করে আগলে রেখেছো হাতে ধরে পথ চলতে শিখিয়েছো, সেই আমাকে একা ছেড়ে দিতে হলো তোমার।

কিছু করারও ছিলোনা। তোমার সেই উদ্বেগ মাখা মুখ প্রথম দিনের সেই বিদায়বেলা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো কিনা জানিনা। নিজের কষ্টের কথা কোনদিন ভাবোনি। তোমার যা কিছু সম্বল সব দিয়ে সন্তানের মঙ্গল চাইতে। সেইযে ভোর রাতে উঠে তেলাওয়াত, এবাদতের পরে হাত তুলে অধীর হয়ে কাঁদতে।

আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, শব্দ শুনতে পাই এখনো। আমিওতো তোমার ছেলে বাবা, কিন্তু তোমার মতো করে এতটা আকুল হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে কোনদিন হাত তুলতে পারিনি, পারবোওনা মনে হয়। সেই ঝরঝর করে কান্না তার কতটুকু তোমার নিজের জন্য ছিলো আর কতটুকু সন্তানের মঙ্গলের জন্য ছিলো তা আমি জানি বাবা, খুব বেশি জানি। আত্মীয়-স্বজন এমনকি মা’র নানান পরিকল্পনার কথা তুমি শুনেও না শোনার ভান করে থাকতে, সেটা অন্য কেউ না জানলেও আমি খুব ভালো করে জানি। তোমার বুকের জমানো ভালবাসার সবটুকুযে জমিয়ে রেখেছিলে আমাদের জন্যে।

নিজের কষ্টের কথা কোনদিন একটা বার মুখ ফুটে বলোনি। শূন্য থেকে উঠে আসা বলতে যা বোঝায় তার চেয়েও হয়তো বেশি কিছু। সেই প্রত্যন্ত অজ পাড়া গাঁয়ের এক বিত্তহীন কৃষকের ছেলে ছিলে। পঞ্চাশের দশকের সেই একেবারে অন্ধকারপ্রায় দুর্গম একটা গ্রামে কি থাকতে পারে তা না দেখলেও কিছুটাতো বুঝি বাবা। বাবার স্নেহ বলতে যা বোঝায় তা পাওনি কখনো।

বুঝতে শুরু করার আগেই চলে গেলেন তিনি। মাকে পেয়েছো হয়তো কিছুদিন। কিন্তু সেই সময়কার একজন বিধবা নারীর পক্ষে তার সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলার চিন্তা করাটাও যে কতো অসম্ভব ছিলো সেটা বোঝা খুব বেশি কঠিন কিছু না। ভাইদের অবহেলা, অনাদরকে উপেক্ষা করে তুমি সংগ্রাম করে গেছো। না ছিলো ভালো রাস্তাঘাট, না ছিলো ধারে কাছে কোন স্কুল কলেজ।

দক্ষিণের সেই জলবেষ্টিত জনপথ কখনো কখনো কতটা দুর্গম হতে পারে তার কিছু অংশ আমার খুব ছেলেবেলায়ও দেখেছি আমি। অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে অনেক দূরের একটা স্কুলে যেতে। কারণ পথে নদী পরতো আর সেখানে কোন সাঁকো ছিলোনা। সাঁতরে পার হতে হতো। তারপরে কাপড় পাল্টে স্কুল।

আরো কতো কি তা বলেতো আর শেষ করা যাবেনা। আর তোমার কথা তোমাকে বলারও কোন মানে নেই। হয়তো তুমি ভেবেছিলে তুমি একাই তোমার কষ্টের স্মৃতিগুলো বহন করে যাবে আজীবন। কিছু অংশ যে তোমার সন্তানও জেনে ফেলেছে বাবা। আর সে যে সেই অংশটুকু কখনো ভুলে যেতে পারবে তারও নিশ্চয়তা দিতে পারেনা।

অনেক সংগ্রামের শেষে মাকে যখন ঘরে নিয়ে আসলে তারপরে শুরু হলো আরেক গল্প। সেটা না হয় আরেকদিন বলবো। সেই অনেকটা এক কাপড়ে আমার বড় দুই ভাইবোন নিয়ে নিজের পিতৃপুরুষের ভিটা ছেড়ে বের হয়ে এলে বলতে গেলে চিরদিনের জন্য। নতুন জায়গায় নতুন সংসার। সেখানে আমার আগমণ তারপরে আরও কতো কি! এত কিছু চেপে রেখেছিলে বুকের ভেতরে।

আর সে বুকের বাইরে চেপে রাখতে আমাদের। কখনো বুঝতে দাওনি ভেতরে কতটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে সন্তর্পনে। সেই আটাশি বা নব্বইয়ের দিকে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে একবার। আমার তখনকার কথা মনে নেই, মায়ের মুখে শুনেছি। মরেই যেতে হয়তো।

সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেবার তোমাকে অর্ধেকটা করে দিয়ে যায় সেই ধকল। আরেকবার যখন খুব ভেঙ্গে পড়েছিলে আমি তখন ছিলাম তোমার কাছে বাবা। নিজের সন্তানের মতো এত ছাত্রছাত্রী রেখে যখন অবসরে গেলে তোমার সেই ভেঙ্গে পড়া সময়টা কাছে থেকেই দেখেছিলাম আমি। ইউনিভার্সিটির ক্লাস ফেলে রেখে প্রায় দুইমাস আমি বাড়িতে ছিলাম তখন।

কেন যেন মনে হতো পাশে থাকি, কাছে থাকি, নাহলে কিছু একটা হয়ে যাবে, কিছু একটা হারাবো হয়তো। যখন অর্থহীন অযুহাতে তোমার খুব কাছের রক্তকে কাছে পেলেনা, তখন দেখেছিলাম কিভাবে একটা মানুষ অসহায় হয়ে যেতে পারে, ভেঙ্গে চূড়মাড় হয়ে যেতে পারে। ভেবেছিলে কষ্টের দিন হয়তো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আরো যে কষ্ট অবশিষ্ট ছিলো অদৃষ্টে সেটা তুমি হয়তো কখনোই কল্পনা করোনি, আমিও না। আপনজনের সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের দিনের কথা তুমি ভুলতে পারলেও আমি কোনদিন ভুলতে পারবোনা বাবা।

তুমি এত সরল, সহিষ্ণু কেন হলে বাবা? এত ক্ষমা বুকের কোথায় লুকিয়ে রাখো তুমি? তোমার অবহেলার সেই মুহূর্তগুলো আমি কোনদিন ভুলতে পারবোনা। তুমি অবসরে গেলে। আমিতো একাই হয়ে গেলাম। তারপর থেকে তোমার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারতামনা। সেখানে আমি স্নেহ যেরকম দেখেছি, দেখেছি অপরাধবোধও।

কেন বাবা? তোমার সেই সংগ্রামের ছিটেফোটাও কি তোমার জিন থেকে আমাতে আসেনি? আর আমিতো তোমার মতো অতটা ক্ষামাশীলও হতে পারিনি। কেন আমার জন্য এতটা উদ্বেগ তুমি ধরে রাখো? কেন অপরাধবোধে ভোগ এইভাবে? আমাকে একটু খানি একা হতে দিতে তোমার কেন এত ভয় বাবা? তারপরে আরো কতো কষ্ট পেয়েছো তার নিরব দর্শক হয়ে আছি আমি। অক্ষমের মতো দেখে গেছি সবকিছু। কিছু না করতে পারার সেই অসহায়ত্ব আমাকে সারাজীবন কুড়ে কুড়ে খাবে। এত কিছু নাহয় নাই বললাম।

দ্বিতীয়বার যখন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে, হাসপাতালের সেই ২৩টি দিন, আমি ক্যালেন্ডারের পাতার মতো স্পষ্ট দেখতে পাই বাবা। খুব আপন মানুষের সেই নির্লিপ্ততা, সেই ব্যাখ্যা না থাকা আচরণ তুমি কিভাবে নিয়েছিলে আমি জানিনা। হয়তো সেই চিরাচরিত ক্ষমা। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে তোমার সেই ফ্যাকাসে মুখ; আমার যেই মাকে ছাড়া তোমার এক মুহূর্ত চলেনা, সব সময় ছায়ার মতো পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছে যে, সেই মায়ের ভেঙ্গে পড়া, সব কিছু আমার মনে আছে, সব। আপন মানুষের সাথে রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো, কিন্তু তার আগ্রহ ছিলোনা।

আমার বন্ধু দিতে চাইলো, তাও ধর্ম ভেদের অজুহাতে তাচ্ছিল্য করা হলো। আমি সেই কথা কোনদিন আমার বন্ধুকে বলতে পারবোনা বাবা। আমি তোমাকে ছোট করতে পারবোনা কখনো আমার বা তোমার আপনজনের মূর্খতায়। সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো। এযাত্রাও বেঁচে গেলে।

কিন্তু যে রক্তক্ষরণ হলো তার কতটা তোমার শরীরে আর কতটা তোমার আত্মায় তার কিছু অংশ হয়তো আমি বুঝেছি অথবা বুঝিনি, আমি জানিনা। তবে জীবনে প্রথমবারের মতো তীব্র ঘৃণা অনুভব করেছিলাম সেদিন। আমাকে ক্ষমা করো বাবা। আমি তোমার মতো ক্ষমাশীল হতে পারিনি, পারবোওনা হয়তো কোনদিন। আরও কত না বলা কথা যে বলতে ইচ্ছে করছে তোমাকে বোঝাতে পারবোনা।

কিন্তু কেন যেন আর লিখতে ইচ্ছে করছেনা। চির নিভৃত আমার বাবা, তুমি কোনদিন আমার ভেতরের না বলা কথাগুলো জানবে কিনা জানিনা। তোমার সামসামনি হয়ে এত কিছু বলার সাহস আমার কোনদিন হবেনা হয়তো। বলতে পারবোনা তোমাকে খুব বেশি ভালবাসি বাবা। তোমার রক্তের বিন্দু ভেঙ্গে ভেঙ্গে যে আমি আজ এত বড় হয়ে গেছি, তার ভেতরের কথাগুলো তুমি তোমার নিজের মতো করে বুঝে নিও বাবা।

আমার অসহায়ত্ব আর কাপুরষতাকে ক্ষমা করো। যখন আমাকে অথবা আমার আশেপাশের কাউকে মধ্যবিত্ত ট্যাগ লাগানো হয়, গেঁয়ো বলে তুচ্ছ করা হয়, গালি দেওয়া হয়, আমার একটুও গ্লানি হয়না জানো? তোমাকে দেখেছি শহরের চারদেয়ালে অস্থির হয়ে যেতে। তোমার মাটি তোমার কাছে মায়ের সমান বাবা, এটা আমি হয়তো সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারি অথবা বুঝিনা। শুধু জেনো তোমার সন্তানের রক্তে তোমার চেতনার প্রবাহ বইছে। তোমার সন্তান হতে পেরেছি এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার জীবনে আর কোনদিন আসবেনা বাবা, কোনদিন না।

------------------------------- কিবোর্ডে হাত রেখে স্থির হয়ে থাকে সজল। বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে চূরে একাকার হয়ে যেতে চাইছে। চোখ ফেটে জল আসে সজলের। একটা খুব চেনা বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে শুধু। কিন্তু সেতো আর হয়না।

বাবা যে অনেক দূরে। অনেক দিন বাড়ি যাওয়া হয়না, অনেকদিন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।