আবার কালি-কলমের যুগে ফিরে যাব ভাবছি। দু’দিন থেকে প্রযুক্তির বাইরে। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করে প্রযুক্তির অসহযোগিতা চাপে ফেলে দিল। নিত্যব্যবহার্য ল্যাপটপের হার্ডডিস্ক ক্র্যাশ করেছে। বিনা বার্তায় প্রযুক্তি পণ্যের এমন বিদ্রোহে বেশ বিব্রত হলাম।
মাউস, কী-বোর্ডের যুগে হাত-কলমে লেখা হয়ে উঠে না বললে চলে। দু’ কলম লিখলে কেমন হাঁপিয়ে উঠি। হাত অবশ হয়ে যায়। চোখ ঘোলা হয়ে যায়। মেধা থমকে দাঁড়ায়।
অথচ কী-বোর্ডের ওপর মাঝে মাঝে আঙুল চলে পাগলা ঘোড়ার মতো। পাগলা ঘোড়া আসলে উপমার জন্যই বলছি। খুব দ্রুতবেগে ছুটে যেতে দেখা ঘোড়ার সংখ্যা দু’চারটে হবে না, তার ওপর পাগলা ঘোড়া! চাঁনখার পুলের খুড়িয়ে চলা ঘোড়াগুলো দেখে আর যাই হোক পাগলা ঘোড়ার উপমা দেওয়া যায় না। এর চেয়ে বরং ঝড়ো হাওয়ার কথা বলি। তা বাস্তবও হয়, যুক্তিসংগতও হয়।
কয়েকদিন থেকে এমনিতে ওই এক মহাসেন-টেন নিয়ে মিডিয়ায় যা লাফালাফি চলছে, তাতে মানুষ বরং উপমার যৌক্তিকতা খুঁজে পাবে। আজকাল তো আবার মিডিয়াগংদের কাছে সবকিছু তাণ্ডব হয়ে দাঁড়ায়। এতদিন শুনে এসেছি, ‘জমাতি তাণ্ডব’। তারপর বি-বাড়িয়ায় ঘটে গেল ‘টর্নেডো তাণ্ডব’। এরপর শুনলাম, ‘হেফাজতি তাণ্ডব’।
এবার এল, ‘মহাসেন তাণ্ডব’। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যেভাবে একের পর এক তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে তাতে বড়ো বিচলিত বোধ করছি। ‘শুনব না, দেখব না, বলব না’ এক পক্ষে এ রকম অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া যেভাবে হলুদে আক্রান্ত হয়েছে তাতে আসলে স্বস্তিবোধ করারও কোনো কারণ নেই।
দুর্নীতি তোর দুর্ভিক্ষ নাই
উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাদ দিলে আর কী থাকে? দুর্নীতি ও লুটপাট। বাংলাদেশে এই একটি বস্তুই অবাধ, এতে কখনো ঘাটতিও দেখা যায় নি (গত সেনা সমর্থিত সরকারের কয়েকটা দিন ছাড়া)।
প্রথমে শেয়ার বাজার বিধ্বস্ত হল। 'জন্মেছি বঙ্গেতে' তাই বাংলা ব্যাকরণ পড়ার কষ্ট ছাত্রজীবনে করি নি বললে চলে। অতএব প্রবাদ-প্রবচনের সঙ্গে খুব এটা জানাশোনা হয়ে উঠে নি। কিন্তু বাস্তবজীবনে এসে এখন হাতে-কলমে জ্ঞান লাভ করতে হচ্ছে। শেয়ারবাজার যেভাবে ধ্বসে গেল তাতে তাসের ঘর, বালির বাঁধ আর গুড়েবালি (ক্ষুদে বিনিয়োগকারীদের জন্য) প্রয়োগিক বিশ্লেষণ বুঝে নিতে খুব একটা কষ্ট হল না।
লাখ-লাখ বিনিযোগকারী পথে বসে গেল। কষ্টে, অভিমানে আর দায় বইতে না পারার শোকে দড়িতেও ঝুলে পড়ল কেউ কেউ। কিন্তু সবই অরণ্য রোদন। রাগব বোয়ালরা রইল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অর্থ নিয়ে যার কাজ কারবার সেই মাল সাহেবের নতুন নতুন অনর্থ সৃষ্টিতে জুড়ি মেলা ভার।
প্রথমে তিনি এটা ওটা বললেন। কাজ তো কিছু হল না, এরপর মন্ত্রী সাফ বলে দিলেন, তিনি শেয়ার বাজার বুঝেন না। তারপর বিনিযোগকারীদের ফটকাবাজ বললেন, রাবিস আর বোগাস বলে দায়িত্ব শেষ করলেন।
দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য প্লাবনে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে ডুবে গেল। একজন আবুলের কাছে হেরে গেল কোটি মানুষের স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা।
নিষ্পেষিত হল গোটা জাতির বিবেক। দুর্নীতি নাকি সীমানা মানে না। উন্নয়নশীল একটি জাতির জন্য সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি দুর্নীতি। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, বাঙালি জাতি এই এক দুর্নীতিতে বড়ই উদার, অকৃপণ। সুতরাং একের পর এক দুর্নীতি সূতো ছেড়া মালার মতো ঘটে চলল।
হলমার্ক-ডেসটিনি-এমএলএম চলছে তো চলছে। এদিকে ক্রমাগত দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত হয়ে ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি। কিন্তু মাল, আবুলরা নির্বকার। দেশের কী হল, অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।
চারদিকে মগার মল্লুক
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মগা পুলিশকে যেভাবে প্রতিবাদী মানুষের ওপর নির্বিচার গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছে, তাতে এতদিন শুনে আসা মগের মল্লুক থেকে মগার মল্লুক দেখে যারপরনাই তাজ্জব হচ্ছি।
প্রতিবাদী ও শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ ভবিষ্যতের জন্য এক নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছে। ১৯৭১ সালের পাক হানাদারের নির্মমতার কথা এতদিন কেবল বই-পুস্তক বা লোকুমখে শুনে এসেছি। কিন্তু ২০১৩ সালে স্বদেশি হানাদারের নিষ্ঠুরতার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার মতো দুর্ভাগ্যের অংশীদার হতে হয়েছে।
ইট-পাথরে চাপা পড়ে দাস জীবনের স্বপ্ন
তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডে কেবল কতিপয় দাস জীবনই নয় বরং জ্বলসে গেছে আমাদের মানবতার বোধটিও। শূন্য অনুভূতির দৈহিক অবয়টি নিয়ে বেঁচে আছি আমরা।
নতুবা রানা প্লাজায় ইট-পাথরে যখন হাজারও স্বপ্ন এক মুর্হূতে ধূলিস্মাৎ হয়ে যায় তখনও কথিত বুদ্ধিজীবীদের সুশীলপনায় ভাটা দেখি না। বুর্জোয়া অর্থনীতির এমনই প্রভাব- রাজনীতি আর সমাজপতিদের গুণগানে কে কত লাইন বেশি লিখবে, কে কার চাইতে শ্রুতিমধুর শব্দ প্রয়োগ করবে তা নিয়ে চলছে নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। বিবেকের এই নিদারুণ বন্ধকী দেখে বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া আর উপায় কী? এর আগে একজন আবুলের শক্তিমত্তা দেখেছে জাতি। এবার দেখল জং-রানাদের প্রভাব প্রতিপত্তি। নূন্যতম মজুরির এই শ্রমদাসদের জীবন কত তুচ্ছ ও নগণ্য এদের কাছে! যে দেশে খুনের দায়ে দণ্ডিত আসামি রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ধন্য হয়, যে দেশে শান্তিপূর্ণ মিছিল-অবরোধে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে রাস্তায় পড়ে থাকে প্রতিবাদী মানুষের নিথর লাশ, সেদেশে কয়েকটি টাকায় কিনে নেয়া দাসদের জীবন ও স্বপ্ন ইট-পাথরের নির্দয় ভারে চাপা পড়তেই পারে? মানবিক অবয়বে বিবেকের দ্বার যখন রুদ্ধ, অনুভূতিরা যখন শূন্য তখন বোবা ইট-পাথরের আর দায় কতটুকু? একজন রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকারের ভার বইতে না পেরে সেসব ইট-পাথর লজ্জায় ভেঙে পড়েছে।
সে সঙ্গে ভেঙে পড়েছে হাজারও দাস জীবনের স্বপ্ন। যে সমাজ জংদের সমাজ, যে সমাজ রানাদের সমাজ, যে সমাজ মাল আর মগাদের সমাজ, সে সমাজে স্বগৌরবে মাথা উঁচিয়ে থাকার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে।
ওই পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত সমাজের প্রতি বিদ্রুপ
ইট-পাথরের জঞ্জাল থেকে বাইরে ঝুলে থাকা একটি পায়ের দিকে ইশারা করে একজন সম্পাদক বিবেকের খানিকটা দায় থেকে লিখেছিলেন, এই পা তোমাদের দিকে ওহে সমাজ অধিপতিরা!
আমার জানা নাই ইট-পাথরের এই পশুর শহরে ওই পা সভ্যতার শেষ নিদর্শন কিনা? তবে ওই একটি পা যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত সমাজের প্রতি প্রকৃতির নিষ্ঠুর বিদ্রুপ। যদি একজন রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘশ্বাসে নয়তলা ভেঙে পড়তে পারে, হাজার হাজার জরিনা-সকিনার হৃদয়ের ঘামে তবে ভেঙে পড়তে পারে একটি জাতি। এর জন্য কোনো মহাসেনের দরকার নাই।
সমাজের ভেতরের ঘুণে খাওয়া মানবতাবোধ একদিন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। আজকের কথিত সুশীল গণমাধ্যম চারদিকে যে তাণ্ডব দেখতে পাচ্ছে তাদের বিবেচনাহীন বোধ, অন্ধ মনুষ্যত্ব আর নৈতিক দেউলেপনার ভেতরেই তা লুকিয়ে রয়েছে। মিথ্যেবাদী রাখাল বালকের মতো চারদিকে যারা শুধু তাণ্ডব আর তাণ্ডব দেখতে পাচ্ছে, সত্যিকারের তাণ্ডব যেদিন ধেয়ে আসবে সেদিন কোনো চিৎকার আর কাজে আসবে না। মতিঝিলে রাতের আধারে যাদের মেরে ফেলা হয়েছে আর সারাদেশে যারা নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে, তাদের সম্মিলিত ক্রোধ-ক্ষোভ আর ঘৃণার ভার কবে কুল চাপিয়ে বানের তোড়ে এসব কথিত সুশীল ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের ভাসিয়ে নেবে দুর্ভাগা জাতি সেদিনটির জন্য অধীর অপেক্ষায় চেয়ে আছে।
http://jashimইট-পাথরে চাপা পড়ে দাস জীবনের স্বপ্ন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।