দীপক চক্রবর্তীর সঙ্গে তার প্রতিবেশী যতীন বাবুর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। যার বহিঃপ্রকাশ নেই, দুই পরিবারের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের কারণ সকলের জানাও নয়। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। দুজনের লোক দেখানো সখ্যতাও আছে কিন্তু দ্বন্দ্বটা কীসের তা কেউ কোনদিন কাউকে মুখ ফুটে বলে না। দারিদ্রের দ্বন্দ্বকে ঝগড়া বলে যা মানুষের মুখে মুখে মুখরোচক কথার খই ফোটায় কিন্তু ধনীর দ্বন্দ্বের কথা সংকোচের সঙ্গে উচ্চারণ করতে মানুষ ইতস্তত করে।
এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কথা বজ ঠাকুর জানতো কী না তা দুজনের কেউ-ই জানে না। পুরোহিত হিসেবে, ধর্মগুরু হিসেবে বজ ঠাকুরের প্রতি দীপক বাবুর শ্রদ্ধার কমতি নেই কিন্তু বার বার করে তার পারিবারিক সম্মান নিয়ে বজ ঠাকুরের আচরণ দীপক বাবুর মনে তার প্রতি একটা ঘৃণা সৃষ্টি করেছে।
সেদিন পথিমধ্যে বজ ঠাকুরের সঙ্গে যতীন বাবুর সাক্ষাৎ হলো। সাক্ষাৎটা ঘটনাক্রমে নয়, বজ ঠাকুর এক রকম ইচ্ছা করে যতীনের সঙ্গে দেখা করল, যতীন তোমাকে মনে মনে খুঁজিতেছিলাম।
কেন ঠাকুর মশাই?
রাম, রাম কী যে কলিযুগ আসিলো।
আমি বাপু তোমাকে কথাটা বলিতে চাহি নাই কিন্তু কী করিব সমাজে একটা কলংক রটিয়া যাইলে তো আর জাত বলিতে কিছু থাকিবে না। তুমি কিছু মনে করিও না, আমি গোটা সমাজের মঙ্গল চাই বলিয়াই শুধু তোমাকে বলিতেছি।
আজ্ঞে ঠাকুর মশাই, বলুন।
ব্যাপারটা তোমার না, তবু তোমাকেই বলিতেছি।
আজ্ঞে বলুন।
বজ ঠাকুর একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে চাপাস্বরেবলল, দীপকের মেয়ে প্রিয়ন্তী একটা নিচু জাতের ছেলের সহিত যেইভাবে ঢলাঢলি করিতেছে, ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ। এইভাবে অনাচার করিলে সমাজ রসাতলে যাইবে। তোমার সঙ্গে বাপু দীপকের ভালো সম্পর্ক তুমি ইশারা ইঙ্গিতে একটু বুঝাইয়া বলিও। বিষয়টা এখনো তেমন কেউ জানে না, জানিলে সমাজের কাছে আমি যে কী জবাব দিব ভগবানই জানেন।
আচ্ছা ঠাকুর মশাই দীপকের সঙ্গে দেখা হলে আমি বলব।
যতীন বাবুর সঙ্গে বজ ঠাকুরের একথার কয়েকদিন গত হলো সে মনে করেছিল যতীন বাবু বিষয়টা দীপক বাবুর সঙ্গে আলোচনা করে ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলবে কিন্তু তার কোনটাই ঘটতে না দেখে একদিন বজ ঠাকুর নিজেই দীপক বাবুর সঙ্গে কথা বলল।
দীপক হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। ঠাকুর হাতের ইশারায় ডাকল, এই যে দীপক কোথাও যাইতেছ নাকি?
আজ্ঞে ঠাকুর মশাই।
কয়েকদিন ধরিয়া একটা কথা তোমাকে বলিব বলিব ভাবিতেছিলাম কিন্তু তোমাকে সেইভাবে দেখাও পাইনা আর কথাটা বলাও হয় না।
কী কথা বলে ফেলুন?
দীপক বাবু বজ ঠাকুরকে কৈশোর থেকে চিনে সে যখন কিছু বলবে বলে ভাবছে তখন নিশ্চয়ই সেটা ভালো কিছু না।
হয়ত আবার কোন সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ করার কথা বলবে। তার তো মন্দিরে পূজা দেওয়া আর সমাজকে অনাচার থেকে বিরত রাখা ছাড়া কোন কাজ নেই।
তোমার মনে হয় তাড়া আছে, তাহা হইলে থাকুক আরেকদিন বলিব।
না, বলার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছেন তখন বলে ফেলাই ভালো।
আমি তোমাদের ভালো চাই বলিয়া বলিতেছি।
দীপক বাবু রাগান্বিত স্বরেবলল, হ্যাঁ আপনি আমার ভালো চান বলেই তো বলবেন। তবে তাড়াতাড়ি বলুন আমার আবার কাজের তাড়া আছে।
বিষয়টা না বলিলেই নয় বলিয়া বলিতেছি, কথাটা ধীরে ধীরে সবার কানে চলিয়া যাইলে তো ভীষণ একটা খারাপ কাজ হইবে।
ঠাকুর মশাই কী কথা বলে ফেলুন?
আমি বলিতেছলাম তোমার মেয়ে প্রিয়ন্তীর কথা।
কী হয়েছে প্রিয়ন্তীর?
দীপক বাবু বজ ঠাকুরের কাছ থেকে কোন পরামর্শ চায়নি তবুও ঠাকুর তার সংসারের বিভিন্ন বিষয়ে উপযাচক হয়ে পরামর্শ দেয়।
দীপক তার পরামর্শ শ্রবণ করে কিন্তু যা করে তা নিজের বুদ্ধিতেই, তুমি বাপু এক কাজ করো?
কী কাজ?
ভালো সম্বন্ধ পাইলে প্রিয়ন্তীর বিবাহ দিয়ে দাও।
ঠাকুরের অযাচিত পরামর্শে দীপক বাবুর সমস্ত গা জ্বলে উঠল, ঠাকুর মশাই আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিব কী না সেটা আমি বুঝব, আপনার এতটা চিন্তা না করলেও চলবে। সমাজের যেন কোন অনাচার না হয় সেটাও আমি দেখব।
তুমি দেখিলে তো হইবে না বাপু, সমাজের অনাচার দেখার দায়িত্ব সবার। তবে এই যাত্রায় কথাটা যেন কেউ না জানে বা কেউ কেউ জানিলেও আমি সেটা মানাইয়া লইব।
দীপক বাবু কোন কথা বলল না। তার বুকের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে গেল। মনে মনে সে প্রিয়ন্তীর ওপর প্রচণ্ড রেগে গেল। কিছুক্ষণ পর তার ছেলে অরুণ দোকানে এলে সে বাড়িতে চলে গেল, যাওয়ার সময় বলে গেল সে আজ আর দোকানে আসবে না।
দীপক বাবু কোনদিন বিকেলবেলা বাড়িতে আসে না।
সাধারণত অনেক রাতে বাড়িতে আসে, বাড়িতে ঢোকার সময় অরুণের মা, অরুণের মা বলে ডাকতে ডাকতে ভিতরে ঢুকে, আজ সন্ধ্যা বাতি জ্বালানোর আগেই অরুণের নাম ধরে না ডেকে গম্ভীর কালো মুখ নিয়ে সোজা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।
বাসন্তী অনেক বছর যাবৎ সংসার করছে, সে খুব সহজে দীপক বাবুকে রাগ করতে কিংবা ভেঙ্গে পড়তে কিংবা মুখ ভার করতে দেখেনি আজ তার চোখে মুখে এক অস্বাভাবিকতাদেখে সে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
বাসন্তী একবার মোবাইলটা দাও তো।
বাসন্তী দীপক বাবুকে মোবাইলটা দিল।
দীপক মোবাইলটা হাতে নিয়ে প্রিয়ন্তীকে মোবাইল করল। কিন্তু প্রিয়ন্তীর মোবাইল ব্যস্ত আর ব্যস্ত।
দীপক বাবু প্রচণ্ড রেগে গেল।
অনেকক্ষণ পর প্রিয়ন্তীর মোবাইলের ব্যস্ততা শেষ হলো।
প্রিয়ন্তী মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো বাবা।
কার সঙ্গে কথা বলছিলি এতক্ষণ?
বাবার কণ্ঠস্বরগম্ভীর, ভয়ংকর, তার বাবার রক্তাক্ত চোখ দু’টো যেন প্রিয়ন্তীর চোখের সামনে ভেসে উঠল, বাবা।
আমি জানতে চাচ্ছি তুই এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
আমার এক ফ্রেণ্ডের সঙ্গে।
ফ্রেণ্ড, ফ্রেণ্ড করেই তুই আমাকে ডুবাবি। তোকে আমি লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছি, বন্ধুত্ব করতে নয়। তোর নামে আজ এক অভিযোগ, কাল এক অভিযোগ, এসব শুনতে শুনতে আমার কখনো কখনো মনে হচ্ছে তোর লেখাপড়া বাদ দিয়ে তোকে বিয়ে দিয়ে দিই।
প্রিয়ন্তীর কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। সে ভীত কণ্ঠে বলল, বাবা কী হয়েছে?
বাসন্তী কাছেই দাঁড়িয়েছিল, সে চাপাস্বরেবলল, চুপ করো, মেয়েকে মানুষ এভাবে কথা বলে? তারওপর আবার মোবাইলে।
বাসন্তী কথা শুনে দীপক বাবু একটু ক্ষান্ত হলো, থাক মোবাইলে সব বলছি না, তবে তুই যদি লেখাপড়া করতে চাস তবে তোকে ঐ ছোট জাতের ছেলেটার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
বাবা।
হ্যাঁ, কথাটা মনে রাখবি আর যদি কোনদিন কথাটা আমার কানে আসে তবে কোনদিন আর আমার বাড়ির দিকে মুখ করে তাকাবি না। সোজা ঐ দত্তের বেটার সঙ্গেই চলে যাবি। আর হ্যাঁ মোবাইল প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য, বলে দীপক বাবু প্রিয়ন্তীকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রেখে দিল।
সেদিন বাবার সঙ্গে কথা বলার পর প্রিয়ন্তী অনেকটা সাবধান হয়ে গিয়েছিল। সুশান্তর সঙ্গে খুব সহজে দেখা করতো না। তার এক বান্ধবীর মোবাইলে সুশান্ত মোবাইল করতো, প্রিয়ন্তী নিজের মোবাইলকে সব সময় ফ্রি রাখতো। কিন্তু তাতেও রক্ষা হলো না একদিন প্রিয়ন্তীর জামাই বাবু রাজশাহী এলো। শহরে কাজ সেরে সে এলো প্রিয়ন্তীর মেসে।
গার্ডের মাধ্যমে প্রিয়ন্তীকে খবর দিতেই সুশান্ত এসে দাঁড়ালো। তার সঙ্গে জামাইবাবুর পরিচয় নেই, খুব সম্ভব তার সঙ্গে প্রিয়ন্তীর কথা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, আর গার্ড প্রিয়ন্তীকে খবর দিতে গেল এইমাত্র।
কিছুক্ষণ পর প্রিয়ন্তী এলো।
প্রিয়ন্তীকে দেখে সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী তাড়াতাড়ি চল দেরি হয়ে গেল।
প্রিয়ন্তী ইশারা করল কিন্তু সুশান্ত বুঝতে পারল না।
স্বাভাবিকভাবেপ্রিয়ন্তী জামাইবাবুকে কখনো প্রণাম করে না, নমস্কারদেয় কিন্তু আজ সুশান্তকে জামাইবাবুর গুরুত্ব বোঝাবার জন্য প্রণাম করল।
জামাইবাবু প্রিয়ন্তীর চালাকি বুঝতে পেরেছে সে দেখেও কিছু বলল না। তার মনে সন্দেহ হলো এই ছেলেই নিশ্চয়ই প্রিয়ন্তীর সেই ফ্রেণ্ড।
সুশান্ত আর জামাইবাবুকে এক সঙ্গে দেখে তার বুক শুকিয়ে গেল।
প্রিয়ন্তী এই ছেলেটির নাম সুশান্ত?
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে আবার ইশারা করল কিন্তু সুশান্ত তার দিকে না তাকিয়েই সে বলল, হ্যাঁ।
তুমি সুশান্তর সঙ্গে কোথাও যাবে নাকি?
প্রিয়ন্তী থতমত খেলো, হ্যাঁ স্যারের কাছে কোচিং আছে।
সুশান্ত কিছু বলল না।
প্রিয়ন্তী জামাইবাবুর কাছ থেকে বাড়ির খোঁজখবর নিয়ে চলে গেল।
জামাইবাবু চলে যাবার পর প্রিয়ন্তী সুশান্তকে বলল, সুশান্ত তোর এতটুকু বোঝা উচিত ছিল। এখন বুঝতে পারলি কে এসেছিল?
সরি প্রিয়ন্তী।
সরি বললেই যদি সব হয়ে যেত তবে তো ভালোই হতো। এখন কী যে হবে ভগবানই জানেন।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।