এর আগেও এখানে সৈন্য এসেছিলোঃ ওরা এত খারাপ ছিলো না
ফ্রন্ট
কান ঝা ঝা। শুধু গুলি আর গুলি। ঝড়ের আগের বৃষ্টির লা’ন (লাহান) । বাবুরে এতো গুলি আমার বাপের (গোতে) দেখি নাই। মানুষ দিশাহারা।
সবাই পূব দিকে ছুটছে। সব ফেলে, সর্বস্ব খুইয়ে। কাঁধে মা, হাতে ছাওয়াল। ছুটতে ছুটতে কেউ কাউকে হারিয়ে ফেলছে। ওমা আমার পুত কই?
ঝি, ওলো আমার কলিজার টুকরা ঝি কই।
।
আমি কোথায়! আল্লা, এত ছিদ্দত, এতো লান্নত আমার কপালে ছিলো! আমার নিমাই, তাপসী, মা রে, দৌড়া।
ওনারে মারি ফালাইছে।
কিন্তু একদল কিশোর যারা শালবাগানের প্রান্তে খেলা খেলা করছিল, তারা জানে না, কী ঘটেছে।
এলা হিমুই (হেই দিক) ন’যাইস।
আহারে, আম্বিয়ার বাপ আর নাই। লুতা কই কেউ জানে না। লুতার বউ কাঁদছে। মানুষের সর্বস্ব শেষ। যুদ্ধে সামাজিক সম্পর্কের বাঁক বদল ঘটে।
যুদ্ধ মানুষকে মর্যাদাবান করে। আমাদের দেশে মুসলিম লীগের ভাবধারায় যে মুসলিম অভিজাতশ্রেণী গড়ে উঠেছিল, তাদের অনেকেই মনে মনে, কেউ কেউ প্রকাশ্যেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পরেও এদের অনেকেই আবার মাথা চাড়া দিয়েছি। গরীব, মেহনতী মুক্তিসেনানী একটি নবতর সামাজিক সম্পর্কের স্বাদ পায় না। পুরান অভিজাতরাই সমাজের কর্তা হয়ে রইল।
এওরকম বেশ কয়েকজন অভিজাতকেও তাদের চাকর-বাকর চেলা-চামুন্ডা নিয়ে আশে পাশে ঘুর ঘুর করতে দেখা যাচ্ছে।
এলো, তোর মা কই।
জানি না গো, বুজি। আঁই জান লই পালাই আইচি। কেবল গুলি।
কত মানুষ জান বাঁচনর লাই কাকুতি-মিনতি করের।
অরা আজরাইল। জান কবচে সিদ্ধহস্ত। কোন হায়া-দয়া-মায়া নাই।
তোগরে মারে, কারণ তোরা হিন্দু!
ও মা! কি কন আঁই পাঁচ ওক্ত নমাজ পড়ি, আঁই কিল্লাই হিন্দু হইতাম!
এই দেশে আর কোন মোছলমান নাই, বেকে হিন্দু অই গেছে।
আঁইও হিন্দু!
অনেক বৃদ্ধ, বহুত পোলাপাইনের রথ চলে না। অতিক্রান্ত শৈশবের শব্দের প্রতিধ্বনি এখনো মনে বাজে। শব্দের ক্ষমতা আমরা একাত্তরে দেখেছি। এখন যে শব্দ তা গোঙানির, আর্তনাদের, হাহাকারের। একেকটা স্মৃতি যেন আসামি।
স্মৃতি, এমনকি, আধা ঘণ্টা আগের স্মৃতি, বুক থাপড়ে, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নার অবিনাশী অসংবাদিত কারণ।
এর আগেও এখানে সৈন্য এসেছিলোঃ ওরা এত খারাপ ছিলো না
এই রাস্তায় একদিন গোরা সৈন্য হেঁটেছিল। মার্চ ফাস্ট।
এই রাজপথ দিয়ে একদিন পাঠান, আরব … সুজা বাদশা’র সাথে রেঙ্গুনের দিকে ধাবমান।
এই রাজপথে শমসের গাজির সেনানির সে কী নাচন-কুর্দন।
কোন ঐতিহাসিক সময়ে, কোন সমাজে গণ অভ্যুত্থান হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে, শাসকের চরিত্র।
শাসক হয়ে উঠবার সে কী উল্লাস!
মগ-পুর্তগীজ জলদস্যুদের অত্যাচারে সন্দীপ থেকে যারা এসেছিলো, তাদের সন্দীপি বলা হয়।
গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের শ্রমিকদের এক বড়ো অংশ চাঁটগাঈয়া।
[এই সময় হিটলার সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু ঘটনা প্রত্যন্ত বাংলার এই অঞ্চলে ঘটে যায়। বয়ানের মাধ্যমে আমি বিনির্মানের চেষ্টা করবো।
]
নিলয় ঘাঁটি পশ্চিমে রেখে গোরা সৈন্য মার্চ করে যায় দক্ষিণ দিকে। বার্মা ফ্রন্টের দিকে। প্রায় ৫০০ কিলোমিটার বাকী। হাঁটা, তাবু ফেলা।
থাম, জিরাও, হাঁট।
চোখ রাখ খাটো…। । সব বিপদ কাট।
চোখ যেন দূরবীণ…। ।
লেফট-রাইট সুরহীন…
আলোতে দেখ, আন্ধারেও দেখ
খড়-খালি, খড়
এইম ঠিক কর। ।
এই ঐতিহাসিক মার্চ-ফাস্ট চাক্ষুষ করার জন্য রাস্তার দু’ধারে অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে হাজারো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের খাড়ানোর ভঙ্গির মধ্যে একটা অন্য ধাঁচের কোরিওগ্রাফিক স্টাইল। এই কোরিওগ্রাফিক স্টাইলের একটা বর্ণনা হোক।
- আসমান রসাতলে যাক, বিবির খরচা কাল
- ঠ্যাং ঝিন ঝিন ,ঠাডা রোদ যে এত মিঠা আগে জানতাম না। ।
- পাচা যদি চুলাকায়, হাত গেছে কোন চুলায়।
- পা স্থানু, পা ফাঁক, দর্শনের অবসাদ।
একজন বলে, আগেও দেখেছি।
অন্যজন বলে, গুল।
একজন গান ধরেঃ
গোরা তো গোরা নয়, আগে আসে ঘোর কালো
ঘোর কৃষ্ণ মেঘেরে ছাড়ায়
যদি থাকে সব ভালো গোরারা আগায়
আরেকজন কবিয়াল দুর্ভাগ্যবশত বলেঃ
শুনেন, শোনেন সর্বজনা, শোনেন খোশ সংবাদ
হিটলার নাকি করিয়াছে ইংরাজের জমানার পরমাদ
এই কথা শুনিয়া আচ্ছা তরফসে বকা দিলো কংগ্রেসি, খদ্দর সুশোভিত ললিত মাস্টার। কিন্তু যে বালকেরা যুদ্ধ বাধানোর জন্য মরিয়া, তারা কূট কুট করে হেসে উঠলো। কবিয়াল কী করে তাদের মনের কথা জানে। তবে কী কবিরা দরবেশ।
‘’তাহাকেই দরবেশ বলা হয়, অজ্ঞাত যার সজ্ঞাত। প্রজ্ঞা যার প্রখর। যিনি সহজ। যিনি প্রথার পায়রবি করেন না। সৎ বাক্যে, প্রকাশে কবি।
বাক্য সরল, কিন্তু নববধূর মত সালংকারা। দরবেশ দিব্য জ্ঞানের খবর রাখে। খরাক্ষিপ্ত মানুষকে বলে, আজ বৃষ্টি হবে। জমিনে গিয়ে দাঁড়ান। আকাশে মেঘের কোন আড্ডা নাই।
স্বৈরাচারি রোদ মগজ গলায়। এত তাপ। তার চোখ আসমানের মেঘেদের কিছু বলে। যখন বস্তুজগত স্মৃতিময়, শ্রুতিময় হয়ে ওঠে ও বাঙ্ময়, প্রাণময় হয়ে হুকুম মানতে শুরু করে, তখন জগতে “দরবেশ’ অবস্থা তৈরি হয়।
মানুষের জ্ঞাত স্বভাব-চরিত্রের বাইরে আর সবকিছুই মানুষের পরম অবলম্বন।
যেমন, কোন ল্যাঙটা ফকিরের কোন শিষ্যের অভাব হয় না। মানুষ বিপদে পড়লে অস্বাভাবিক মানুষের শরণাপন্ন হয়। “
পাগল, কুতুব, ফকির সংক্রান্ত বিষয়ে একটি পর্যালোচনা
এই অঞ্চলে বদরশাহ’র তাঈয়া আছে। কেউ কেউ একে মাজারও বলে। এই পথ দিয়ে বার আউলিয়া ও বদর পীর গেছেন।
তারা সমুদ্র শাসক ছিলেন। কত জায়গায় যে তারা আসন গ্রহণ করেছেন। ত্রিপুরার গভীর অরণ্যেও তার দরগা আছে। তার পথ পরিক্রমার একটা মানচিত্র পাওয়া যায় এই সব দরগার ভৌগোলিক অবস্থান থেকে। পৃথিবীর মানচিত্র অনেক কাল কলন্দর আর দরবেশরাই এঁকেছেন।
তাদের চরণছিহ্ন অনেক পথ তৈরি করেছে।
বার আউলিয়া তাদের মধ্যে সবচে খ্যাতিমান। রাত বড় উতালা। চৈত মাস। অস্তিমান সবকিছু।
বার আউলিয়া চক্রমন্ডলে বসেছেন। সারা পথ ছিলো চরণ সহিষ্ণু। এখন কিছুটা বিশ্রাম চায়।
যে পথ চরণ ফেলে আসে, সে-ই পথ আর ফিরে নাহি চান। বিশ্বাসের বিনাশ নাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।