আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেই হারিয়ে যাওয়া কানামাছি মন

আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই..পাই যদিবা.ক্ষণেক্ষণে হারাই
এক বিরাট বড় ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করে মেয়েটা। অনেক ছোট,সাদা ধবধবে একটা কুঁচি দেয়া ফ্রক দুলিয়ে কানামাছি খেলছে। ছোট ছোট হাত, ছোট একটা অবয়ব, নিজেকে নতুন করে দেখা, সময়যাত্রা করে যাওয়া যেন। কি অদ্ভুত! কোন কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দেয়া নেই চোখ, খেলার সাথীও তো নেই কেউ, মেয়েটা চোখ বন্ধ করলেই যেন খেলা শুরু হয়। চোখটা খুললে শূণ্য ফাঁকা ঘর,আর চোখ বন্ধ করলে শতশত চেনামুখের ভীড় যেন।

চোখ খুললে সেই শূণ্য ঘরের চেয়ে এটাই বোধকরি ভাল। তাই গোলাপি-সাদা আলোয় ভরা ঘরটাতে চোখ বন্ধ করে মেয়েটা। চোখের সামনে দেখতে পায় খুব পরিচিত একটা চিত্র। হুম,একটা ছোট মেয়ে নীল রংএর একটা টুলে উঠে শোকেসের উপর রাখা সেই পুরোনো তারওয়ালা ফোনটা কানে চেপে আছে, ঐপাশ থেকে খুব প্রিয় একটা কণ্ঠ বলে উঠছে... -আসলে না কেন আজ স্কুলে?আমি স্কুলে যেয়েও কান্নাকাটি করে ফিরে এসেছি। তুমি স্কুলে না গেলে আমার ভাল লাগে না তুমি জানোনা? সাথে সাথে চোখে ভেসে উঠে ছোট্ট বেলার প্রিয় সেই বান্ধবীকে, ফোলাফোলা গাল আর দুইটা ঝুটি করা, ঘিয়ে রংএর একটা ফুল দেয়া জামা পরা ছোট একটা মেয়ে, আর আহলাদি একটা চেহারায় জমে থাকা কত ভালবাসা.. চোখ খুলে ছোট মেয়েটা।

মেয়েটা নিজেকে আবিষ্কার করে আরেকটু বড়, কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়া একটা ছটফটে প্রাণবন্ত মেয়ে রূপে। হালকা গোলাপী সেলোয়ার কামিজ টা তে নিজেকে দেখে মনে হয়-যাহ, বড়ই হয়ে গেলাম বোধহয়। অতীতের ছোটবেলার বন্ধুর স্মৃতি,তাকে হারানোর রেশ তখনও লেগে আছে মনের মাঝে, মনে হচ্ছে-এইতো দেখলাম বুঝি! এত বড় ঘরটার একাকিত্ব ভুলতে যেন আবারও চোখ বুজে মেয়েটা। আবিষ্কার করে, একটা চঞ্চল ছেলের পাশে, ওর মত শ্রীমতি বকুনতুড়েও যেন চুপচাপ লক্ষী মেয়ে হয়ে আছে। ছেলেটা আপন মনে বকবক করেই যাচ্ছে, নীরব শ্রোতা যেন সেই কিশোরীটি।

এই ছেলেটার সব জালাতন সহ্য করে মেয়েটা, বেস্টফ্রেন্ড কি আর এমনিতে ওরা, মেয়েটাও রাগ দু:খ সব কিছুতে রাগ ঝাড়ে এই বন্ধুটার উপরে, ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্বও যে হয়,এবং সেটা খুব ভাল ভাবেই হয়, দেখিয়ে দেবার পণ করেছে যেন ওরা। মেয়েটা দুমদাম রাগ করে, আর ঝাড়ি মারে,আবার কখনও ছেলেটাও তার রাগের চোটে গালি দিতে শুরু করে, কিন্তু দিনের শেষে বন্ধুত্বের প্রতিজ্ঞা স্বরূপ কেউ কা্উকে ছেড়ে যায় না, বন্ধুটা ওকে "লিটেল এন্জেল" ডাকত। আর মেয়েটা ডাকত-ডেভিল! কষ্টের বাষ্প যেন গলা পর্যন্ত উঠে আসতে যাচ্ছে, এক সমুদ্রে যেন হারিয়ে যাচ্ছে ওর প্রিয় বন্ধুটা, আর চিৎকার করে বলছে- লিটেল এন্জেল, আমার হাতটা ধর দোস্ত, আমিতো ডুবে যাচ্ছি!! আর মেয়েটা হাত বাড়িয়ে আছে, কিন্তু কোনভাবেই যেন নাগাল পাচ্ছেনা ও ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটাকে...... একসময় শুধু ঢেউটাও যেন থেমে যায়, ডুবে যায় সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাও। এক হারানোর সমুদ্র থেকে ডুব দিয়ে উঠল যেন মেয়েটা। চোখ খুলতেই যেন শান্তি লাগল।

কেমন একটা শূন্যতা থেকে মুক্তি পেল যেন। বেশ কিছু ক্ষণ সময় লাগে নিজেকে সামলে নিতে! শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নিজের সামনে নিজের প্রিয়বন্ধুটার মৃত্যু...বেসামাল করে দেয় যেন তাঁকে। আর চোখ বন্ধ করতেই ভয় পায় যেন মেয়েটা, কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে যে সারাটাক্ষণ চোখ খুলে থাকা যায়না, পলক যে ফেলতেই হয়, এক অজানা আশংকা নিয়েই ভয় ভয় করে চোখটা বন্ধ করে মেয়েটা। নাহ! মেয়েটাকে এখন আর ফ্রক দোলানো ছোট মেয়ে বলা যাবেনা। নিজেকে সাদা নীল আবছা শাড়িতেই দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

তারুণ্য তখন রোদের প্রথম আলোর মত নিষ্পাপ আলো ছড়িয়ে মেয়েটার চোখমুখে নিজেকে নতুন করে খুঁজে নিচ্ছে যেন। আর সেই লাবণ্য এসে মিশেছে যেন সব কিছুর মাঝেই। আবিষ্কার করে নিজেকে এক খোলা ছাদে, বন্ধুদের আড্ডা থেকে একটু আড়ালে এসে, আকাশের দিকে উদাস চেয়ে থাকা কোকড়াচুলের এক ছেলেটার পাশে, সেদিন ছিল পূর্ণিমা, ঘটা করেই দেখতে আসা সব বন্ধুরা মিলে। মেয়েটা পাশে এসে দাড়াতে ছেলেটা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, আর কিছুক্ষণ পর একটা ছোট অনুরোধ করে..... -আমার হাতটা একটু ধরবে? মেয়েটা হাত বাড়ায়, কিন্তু চাঁদের মায়াবী আলোর মত করে যেন সেও অদৃশ্য হয়ে আছে, প্রিয় মানুষটাকে ছুঁয়ে দেয়া হয়না, তার কোকড়াচুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয়া হয়না, তার গাল টেনে দিয়ে তাঁর দিকে ভেংচি কাটা হয়না। কে হারালো এবার? সে নাকি তার প্রিয়জন? স্বপ্নের মত আচ্ছন্ন হয়ে ছিল যেন! নাহ , চোখ খুলতে চা্য়না সে, চোখ খোলার পরের শূন্যতা যে তার সহ্য হয়না।

আর যে সে পারেনা এভাবে হারানোর যন্ত্রণা সইতে। আর যে ইচ্ছা হয়না!!! মেয়েটা বিভ্রান্ত বিষন্ন হয়ে এলোমেলো ভাবে হাঁটতে থাকে। অচেনা এক রাস্তায় নিয়ন আলোতে আরও নির্জন লাগতে থাকে সব! কখন যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে খেয়াল ই নেই তাঁর। হঠাৎ পিছন থেকে একটা চিৎকার.... -কিরে! অমন করে ভিজছিস যে ? ঠান্ডা লাগবে তো ! ছোটাপুটা এমন করলে হয় বলতো ? কবে বড় হবি তুই ? তোকে নিয়ে যে আমি কি করব! আয় জলদি আয়, ছাতার নিচে আয়, ভাইটাকে জালাতে খুব ভাল লাগেনা??? মেয়েটা পিছন ফিরে তাকায়, হুম! এ যে তার ভাই! একটা নীলরং এর ছাতা ধরে এই মুষল-ধারা বৃষ্টিতে তাড়া দিচ্ছে ফিরতে.....মেয়েটা হাঁটতে থাকে, তাকে যে যেতেই হবে, আঁকড়ে ধরতে হবে ভাইটাকে, কত কি যে বলার আছে আজ তার। সারাদিনের ফিরিস্তি, ছোটখাটো খুনসুটি, আর ভাইটাকে অকারণে বকা দেয়া.....সব বাকি আছে।

দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে সে। যেতে তাঁকে হবেই, এখন এই ছাতাটা-মাথার উপরের এই ছায়াটা যে তাঁর বড্ড প্রয়োজন..। আমি আসছি ভাইয়া, একটু দাড়াও, একটু,,,এই যে চলে আসছি...। সেই জায়গাটায় এসে খুঁজতে থাকে সে.। কই গেল তাঁর ভাই? ভাইটা তো এখানেই ছিল? আরে!! আমার ভাইকে দেখেছো কেউ?? ভাইয়া......ভাইয়া.............।

চিৎকার করতে থাকে সে! কোন জবাব পায় না, কেউ উত্তর করেনা, "এই যে পাগলি,আমি এখানে,এত অধৈর্য হলে হয় বলতো?" মেয়েটা আর চোখ বন্ধ করতেই ভয় পায়, তার চোখের বন্ধ হওয়ার সাথেই যেন সব কাছের মানুষগুলোর হারিয়ে যাওয়া! তার তো কাউকে আপন করতেই নেই..হারিয়ে ফেলার দোষটা যে তার জন্মগত..যাকে আকড়ে বাঁচতে চাইবে সে যেন চলে যাওয়ার জন্যই কাছে আসে। এরপর থেকে মেয়েটা শুধু হেঁটেই যায়, ক্রমাগত এক শূণ্য গন্তব্যের দিকে..... উৎসর্গ: সব হারিয়ে যাওয়া মানুষদের, যাদের আকড়ে ধরার যোগ্যতা বা ক্ষমতা দুটোই বোধহয় নেই আর।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।