শান্তির জন্য সংগ্রামী
৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ কামালের ৬৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এই দিনে তিনি তদানীন্তন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাত্রিতে মাত্র ২৬ বছর বয়সে জাতির জনকের হত্যাকারী মানবতার ঘৃণ্য শত্রুদের নির্মম-নিষ্ঠুর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
আজ বন্ধু দিবস। প্রতি বছর আগষ্টের প্রথম রবিবারে এই দিবস পালিত হয়। সবাইকে বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা।
শেখ কামালের জীবন অধ্যায়ের শুরু কথা বঙ্গবন্ধু তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে লিখেছেন এভাবে,
"একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর 'আব্বা' 'আব্বা' বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, "হাচু আপা, হাচু আপ, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।
" আমি আর রেণু দুজনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, "আমি তো তোমারও আব্বা। " কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না।
নিজের ছেলেও অনেকদিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারনে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। "
একই সঙ্গে সঙ্গীত সংগঠক, ক্রীড়া সংগঠক ছাত্ররাজনীতি সংগঠক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ কামালের ছাত্ররাজনীতির টুকরো কথা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন তার ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা নিয়ে লেখা গ্রন্থে এভাবেই লিখেছেন,
"১৯৬৯ সাল। সেই উত্তাল সময়ের ফেব্রুয়ারীর ১৯ অথবা ২০ তারিখ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা শহরে এক বিশাল মিছিল বের করা হয়েছিল। দুই লাইনের বিশাল সেই মিছিলটি উত্তেজনা, বিশালতা এবং নিয়ন্ত্রনের বিবেচনায় আজও সম্ভবত অনন্য।
যাহোক, সেই মিছিলে আমরা পূর্বপরিকল্পনা মতো ছড়িয়ে ছিলাম এবং ভাগ ভাগ করে দুই লাইনের মাঝখান দিয়ে হেটে স্লোগান দিচ্ছিলাম। আমার পরেই ছিল শেখ কামাল। মাথায় রুমাল বেধে শেখ কামাল তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় আগে পিছে দুলে দুলে স্লোগান দিচ্ছিল আর তার চারপাশের সঙ্গীরাও বেশ সাড়া দিচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষন পরে খেয়াল করলাম লোকজন আস্তে আস্তে শেখ কামালের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। বেশ কিছু লোক এগিয়ে আমার দিকে চলে এসেছে আবার কিছু লোক পিছিয়ে সৈয়দ শাহেদ রেজা এবং নজরুল ইসলাম(ঢাকা কলেজ) যেখানে স্লোগান দিচ্ছিল সেদিকে চলে যাচ্ছে।
বিষয়টি চোখে পড়ার মতো, আমি আমার স্লোগান সহকর্মী শাহাবউদ্দিনকে ধরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসা একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম তাদের সামনে-পিছনে সরে পড়ার কারন। লোকটি কোনরকম দ্বিধা না করে সরাসরি শেখ কামালের দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বেশ জোরে প্রচন্ড ঝাঝের গলায় বলল, 'ওই বেটা ন
িশ্চয়ই পাকিস্তানীদের দালাল, সব স্লোগান দেয় কিন্তু শেখ মুজিবের মুক্তির স্লোগান দেয়না। ' স্পষ্টতই আমি হতবাক। কামালও ওইভাবে ওর দিকে আঙ্গুল উচিয়ে জোরে কটাক্ষ করে কথা বলায় হতভম্ব হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম যাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে একথা বলছেন, সে শেখ মুজিবের বড় ছেলে শেখ কামাল।
সেজন্যই বাবার মুক্তির স্লোগান নিজে দিতে পারছে না। লোকটি কতক্ষন শেখ কামালের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে এক দৌড়ে গিয়ে সোজা শেখ কামালকে ঘাড়ে তুলে নিল, তারপর শুধু একই স্লোগান, তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব, জেলের তালা ভাংবো শেখ মুজিবকে আনবো, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, দিতে হবে ইত্যাদি। সেদিন মিছিলের অন্যান্য যায়গায় দুই লাইন রাখা সম্ভব হলেও শেখ কামালের স্থানে আর সেটি রাখা সম্ভব হয়নি। আর দেখলাম সদা প্রাণচঞ্চল শেখ কামালকে, একটু আগেও যে নেচে নেচে হেলে দুলে তার স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় স্লোগান দিচ্ছিল, এখন বাকহারা হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে নীরবে হেটে চলছে। হয়ত সে মুহুর্তে সাধারন মানুষের ভালোবাসার অনুভুতি তার অন্তরকে গভীরভাবে আপ্লুত করেছিল।
"
স্বাধীন বাংলাদেশে যে দুজন মানুষ নিজস্ব ধারায় বাংলাদেশের সঙ্গীত ও ক্রীড়া জগতে বিশাল ভুমিকা রাখেন তাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পপগুরু আজম খান এবং অপরজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল। দুজনই স্বাধীন বাংলাদেশে আলাদাভাবে সঙ্গীত জগতে তরুন প্রজন্মের অংশগ্রহনে অশেষ ভুমিকা রাখেন। আজ দুজনই প্রয়াত। দুজনই পরকালে শান্তিতে থাকুন এই কামনা করি।
বহুমাত্রিক অনন্য সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক শহীদ শেখ কামাল শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বি.এ. অনার্স পাস করেন।
বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনের শিক্ষার অন্যতম উৎসমুখ ছায়ানট-এর সেতার বাদন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচির পাশাপাশি সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে সমাজ চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণে মঞ্চ নাটক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি প্রথমসারির সংগঠক ছিলেন। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী। শেখ কামাল ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধূলায় প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল তাঁর। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়া সংগঠন, বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। শহীদ শেখ কামাল আমাদের দেশে নান্দনিক ফুটবল ও ক্রিকেটসহ অন্যান্য দেশীয় খেলার মান উন্নয়নে তাঁর অক্লান্ত শ্রম দিয়ে অপরিসীম অবদান রেখেছিলেন। নতুন নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টির লক্ষে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতেন এবং তাদের সাথে নিয়মিত অনুশীলন করতেন। ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামাল অমর হয়ে থাকবেন তার সৃষ্টি আবাহনীর মাঝে।
বাংলাদেশ তাকে মনে রাখবে আধুনিক টোটাল ফুটবলের জনক হিসাবে।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু, দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বাংলাদেশ ছাত্র লীগের একজন নিবেদিত, সংগ্রামী, আদর্শবাদী কর্মী হিসেবে ৬৯-র গণঅভ্যুত্থান ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যথোচিত সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত ৩২ নম্বর সড়কস্থ বাসভবন আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বাড়ি থেকে বের হয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানির এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর শেখ কামাল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন এবং শাহাদাত বরণের সময় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠন জাতীয় ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাত বরণের সময় তিনি সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের এম. এ শেষ পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তবে ভাইভা দিতে পারেন নি শেখ কামাল ও তার নবপরিনীতা সুলতানা কামালও।
একাত্তুরের রনাঙ্গনের সাহসী যোদ্ধা লে: শেখ কামাল পরে কাপ্টেন হিসাবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে, প্রেমে পড়েন একই বিভাগের ছাত্রী, ক্রীড়াবিদ সুলতানার। বিয়ে করেন তাকেই। ১৫ আগস্ট ঘাতকের গুলি তাদের বিচ্ছিন্ন করেছিল।
হয়ত কোনো এক শ্রাবণ রাতে ৩২ নং এর কোনো বাড়িতে বেজে উঠবে মেঘমল্লারের রাগে বেজে উঠবে সেতারের চেনা সুর, কোনো এক রোদেলা দুপুরে টিএসসির আড্ডায় একঝাঁক তরুণ গিটার বাজিয়ে কামালের মতই গেয়ে উঠবে, " এই যে দুনিয়ায় মানুষ আর মানুষ নাই, কোথায় গেলে মানুষ পাই.....হাইকোর্টের মাজারে কত পাগল ঘুরে, আসল পাগল কয়জনায়"।
শুভ জন্মদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামাল।
তোমার প্রতি বিনম্র সালাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।