আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয়ন্তী-০৮ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী )



দূর্গা পূজা শেষ হয়েছে। এবার দুজনেরই রাজশাহী ফেরার পালা। আগামীকাল বরেন্দ্র এক্সপ্রেসে সুশান্ত উঠবে ফুলবাড়ি আর প্রিয়ন্তী বিরামপুর একই স্টেশনে উঠলে আবার কথাটা দুজনেরই গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারে। তারপর দুজনে এক সঙ্গে গল্প করতে করতে রাজশাহী পৌঁছাবে। প্রিয়ন্তীদের বাড়ির অদূরে একটা সুপারি বাগান আছে, সেই বাগানের এক কোণায় একটা সিমেন্ট কংক্রিটের বেঞ্চ বানানো হয়েছে অনেক আগে, যখন এলাকায় বিদুৎ পৌঁছায়নি তখন গরমের দিনে অনেকেই বসে আড্ডা দিত।

আজকাল আর কেউ তেমন একটা বসে না। গতকাল প্রিয়ন্তী সেই বেঞ্চের ওপর বসে সুশান্তর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলল। যেন কথার শেষ নেই। বিজয়া দশমীর দিন বজ ঠাকুর সুশান্তর সঙ্গে কথা বলেছিল, তুমি কে বাবা? আমার নাম সুশান্ত। সুশান্ত কি? নামের শেষে একটা পদবি আছে না? সুশান্ত দত্ত।

বজ ঠাকুর মুখ আংশিক বিকৃত করল, ও তাহাই বলো, তোমার বাড়ি কোন গ্রামে? সুশান্ত তার গ্রামের নাম বলল। প্রিয়ন্তী তোমার কে হয়? আমার ফ্রেণ্ড, আমরা একসঙ্গে পড়ি। ও তাহাই বলো, বলে বজ ঠাকুর ফিসফিস করে চাপা স্বরেকি যেন বলতে বলতে চলে গিয়েছিল। প্রিয়ন্তী সুশান্তর সঙ্গে কথা বলে বাড়িতে ঢুকবে এমন সময় ঠাকুর ঘরের কাছে বজ ঠাকুরের দেখা। হয়ত বজ ঠাকুর প্রিয়ন্তীর সঙ্গে কথা বলার জন্যই দূর থেকে দেখছিল।

প্রিয়ন্তী কাছে যেতেই তাকে ডাক দিল, প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তী দাঁড়ালো, বলুন ঠাকুর মশাই। তুমি এখন বড় হইয়াছ, অনেক বেশি লেখাপড়া শিখিয়াছ তোমাকে নতুন করিয়া কিছু বলিতে হইবে এমন জ্ঞান আমার নাই। তবুও একটা কথা না বলিলেই নয়। কী ঠাকুর মশাই? এতক্ষণ কাহার সহিত কথা বলিলে মা? প্রিয়ন্তীর সমস্ত শরীর রাগে রি রি করে উঠল, সে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বলল, আমার এক ফ্রেণ্ডের সঙ্গে।

তা বেশ, তা বেশ। আজকাল এই মোবাইল নামক যন্ত্রটা আসিয়া পৃথিবীতে অনাচার আরো বাড়িয়া গিয়াছে, সেইদিন তোমার সহিত একটা ছেলে আসিয়াছিল, নামটা কি যেন, সুশান্ত দত্ত। আমার ফ্রেণ্ড। রাজশাহীতে থাকে, না? হ্যাঁ আমরা একসঙ্গে পড়ি। আমি ছেলেটিকে চিনি, তাহার বাবা-মা’সহ গুষ্ঠিসুদ্ধ চিনি।

তাহাদের বংশে তেমন খারাপ কেউ নেই। আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে যতটুকু জানি মন্দ না। কিন্তু হিন্দু ধর্মে গোত্র-বর্ণ বলিয়া একটা কথা আছে, তোমরা হইলে চক্রবর্তী, জাতে বামুন আর সুশান্ত দত্ত কী তাহা তো তুমি বুঝিতেই পাইতেছ। প্রিয়ন্তীর বুক ধক্ করে উঠল, সে প্রচণ্ড রেগেও গেল, ঠাকুর মশাই দয়া করে আপনি আর এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলবেন না। বজ ঠাকুর রাম, রাম বলতে বলতে মন্দিরের দিকে গেল।

বজ ঠাকুরের প্রশ্নবাণ এ পর্যন্ত শেষ হলেই ভালো হতো কিন্তু না, কথাটা এ পর্যন্তই থেমে থাকলো না। তার প্রশ্নবাণের প্রতিফলন ঘটল তার বাবা-মা’র গম্ভীর কালো মুখের প্রতিচ্ছবিতে। প্রিয়ন্তী রওয়ানা দেওয়ার জন্য কাপড়-চোপড় পরে যখন তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন বাবা তার হাতে টাকা দিল একটা কথাও বলল না। অন্যান্য বার বাবা তাকে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে নানান কথা বলতো। প্রিয়ন্তী বলল, বাবা তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ? না।

তার না বলার ভঙ্গীতে বোঝা গেল তার মনের মধ্যে প্রচণ্ড রাগ আর ক্ষোভের মেঘ জমাট বেঁধেছে। এই গাঢ়, কালো জমাট মেঘ দূরীভূত না করে তার চলে যাওয়া ঠিক হবে না। সে তার বাবার পাশে বসল, বাবা কী হয়েছে? আমাকে বলোতো? দীপক বাবু বলল, আমি তোকে রাজশাহীতে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছি কিন্তু এখন আমার আশংকা হচ্ছে তুই লেখাপড়া শেষ করতে পারবি কি না। বাবা বজ ঠাকুর তোমাকে কিছু বলেছে? শুধু বজ ঠাকুর বলবে কেন? আমি নিজে কি কিছু বুঝি না? সেজন্য একবার তোর বিয়ে দিতে চাইলাম, না তুই বিয়ে করবি না। ভালো কথা বিয়ে করবি না লেখাপড়া করবি কিন্তু এখন যা দেখছি তোর বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা অন্য।

প্রিয়ন্তীর বড় মুখ করে কথা বলার কিছু নেই। সে মাথা নত করে বসে রইল। দীপক বাবু বলল, তোর ইচ্ছা তুই লেখাপড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হবি, আমারো ইচ্ছা তাই কিন্তু কোনদিন যদি এর ব্যতিক্রম ঘটে তবে আর আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না। প্রিয়ন্তী জানে তার বাবার ইচ্ছার ব্যতিক্রমটা কী? সে তার বাবাকে চিনে, খুব সহজ-সরল কিন্তু কোন বিষয়ে একবার বাঁকা হলে তাকে আর সোজা করার মতো কেউ নেই। প্রিয়ন্তী বুঝতে পারল সুশান্ত আর তার সম্পর্ককে বাবা কোনভাবেই মেনে নিবে না।

এমনকি কোনদিন বাবার সামনে এসে সেকথা বলাও যাবে না। আবার সুশান্তকে সে ঠাকুর সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছে, সিঁথিতে সিঁদুর নেই মনের সিঁদুরটা যেন তাকে বাবা-মা’র স্নেহ ভালোবাসা, পুরোহিতের নীতিবাক্য, সমাজের অনাচার জ্ঞান সমস্ত কিছু থেকে আলাদা করেছে। প্রিয়ন্তী আর কথা বাড়ালো না। সে বাবার পা ছুঁয়ে বলল, আমার জন্য আশীর্বাদ করো বাবা। সবাই তখন বাইরে রিক্সা ভ্যানের ওপর তার ব্যাগ চাপিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

মা’র চোখের পানি গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। দীপক বাবুর একটা চাপা অশ্রুনিরুদ্ধ কণ্ঠেবুক চিরে বেরিয়ে এলো, ভালো থাকিস মা। স্টেশনে এসে বেশিক্ষণ দেরি করতে হলো না। কয়েকমিনিটের মধ্যে ট্রেন এলো। ট্রেন পুরোদমে না থামতেই প্রিয়ন্তীর চোখে পড়ল একটা লাল শার্ট পরা হাত কাকে যেন ইশারায় ডাকছে।

ট্রেন আরো কাছাকাছি আসতেই প্রিয়ন্তী সুশান্তকে না দেখেই অনুমান করল, এ যেন সুশান্তরই হাত, তাকেই ডাকছে। হ্যাঁ সুশান্তই তাকে ডাকছে। ট্রেন থামতেই প্রিয়ন্তী ট্রেনে উঠে সুশান্তর পাশে বসল। প্রিয়ন্তী কেমন আছিস? প্রিয়ন্তী একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, ভালো। কিন্তু সুশান্ত খেয়াল করল প্রিয়ন্তীর গণ্ডদেশ দিয়ে বেয়ে পড়া পানির আভা তখনো শুকায়নি।

দু’চোখ তখনো ছলছল করছে। সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কী হয়েছে? প্রিয়ন্তী রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, এখন আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিস না সুশান্ত, আমার মনটা ভালো নেই। আগে রাজশাহী যাই, কাল তোকে সবকিছু বলব। সুশান্ত আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। চলবে...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।