ধসে যাওয়া ভবন ‘রানা প্লাজা’র মালিক যুবলীগের নেতা সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা হলেও গ্রেপ্তারের কোনো চেষ্টা নেই। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও পুলিশ তাঁকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় দুটি মামলা করেছে।
রাজউকের মামলায় রানা একাই আসামি। আর পুলিশের মামলায় রানা ছাড়াও তাঁর বাবা আবদুল খালেক, ধসে পড়া ভবনের পোশাক কারখানার মালিক আমিনুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, বজলুস সামাদ আদনানসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।
এদিকে দফায় দফায় চেষ্টা করেও পাঁচ পোশাক কারখানার মালিকদের পাওয়া যায়নি।
প্রতিক্রিয়া জানতে প্রথম দিন থেকেই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। গতকাল দুপুরে বিজিএমইএর নেতাদের দিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। ফোনগুলো বন্ধ ছিল।
তবে তাঁদের সঙ্গে বিজিএমইএর সহসভাপতি আবদুল মান্নান কচির যোগাযোগ হয়েছে বলে গত রাতে জানান সংগঠনের সভাপতি আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁদের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে, যাতে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধসহ সার্বিক কাজে তাঁরা এগিয়ে আসেন।
পাঁচটি পোশাক কারখানার মধ্যে নিউওয়েভ বটমস্ ও নিউওয়েভ স্টাইলের মালিক হচ্ছেন বজলুস সামাদ আদনান, মাহবুবুর রহমান তাপস ও দেলোয়ার হোসেন। ফ্যানটম অ্যাপারেলস ও ফ্যানটম ট্যাকের মালিক হচ্ছেন আমিনুল ইসলাম, জাফর আহমেদ ও স্পেনের ডেভিড মেয়র। ইথারটেক্সের মালিক হচ্ছেন আনিসুর রহমান।
নিউওয়েভের আরও একটি কারখানা রানা প্লাজাতে ছিল। সেটির নাম নিউওয়েভ অ্যাপারেলস।
এটি বছর খানেক আগে রাজধানীর মিরপুর-কল্যাণপুরে স্থানান্তর করা হয়।
ভবন-মালিক ও পোশাক কারখানার মালিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার মুখার্জি বলেন, তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
জানা গেছে, স্থানীয় রাজনীতিতে সোহেল রানার গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা না থাকলেও তরতর করে বনে যান রাজনীতিবিদ। সাংসদ তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদের সাহচর্যে হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। একপর্যায়ে তাঁকে দেওয়া হয় পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কের পদ।
হরতালবিরোধী মিছিল, সাংসদের জনসভা, সরকারি সম্পদের ইজারা—এসবে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। জমি ব্যবসার নামে নিরীহ লোকজনের জমি দখলের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত বুধবার ভবন ধসের আগেও হরতালবিরোধী মিছিল করার জন্য লোক জড়ো করেছিলেন রানা।
রানার সম্পদ: সাভার পৌরসভা সূত্র জানিয়েছে, ‘রানা প্লাজা’র নির্মাণ শুরু হয় ২০০৭ সালে। এর আগে জায়গাটি ছিল পরিত্যক্ত।
পেছনের দিকে ছিল জলাশয়। ভবন নির্মাণ করার আগে বালু ফেলে ভরাট করা হয়। এর উদ্বোধন হয় ২০১০ সালে। ভবনের পেছনের অংশ রানা দখল করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাভার পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজার পেছনের অংশ সরকারি খাল হিসেবেই দেখেছেন তিনি।
নাম ছিল সাধাপুর খাল। এটি দখল করে ভবন নির্মাণ করেন রানা। এ ছাড়া সাভার বাজার রোডে রানার রয়েছে আটতলা ভবন ‘রানা টাওয়ার’। এটির একটি পিলারে ফাটল দেখা দেওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার ভবনটি বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। আটতলার ওপরে এখনো নির্মাণকাজ চলছে।
তবে ইতিমধ্যে পার্কিং থেকে তিনতলা পর্যন্ত ভাড়া দেওয়া হয়েছে। রানা টাওয়ারের পাশেই তাঁদের ছয়তলা বাসভবন রয়েছে। এ ছাড়া ধামরাইয়ের কালামপুরে রানার পরিবারের একটি ইটভাটা আছে।
হাইকোর্টের তলব: সাভারের ধসে পড়া ভবনের মালিক সোহেল রানা এবং সেখানকার পোশাক কারখানাগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ৩০ এপ্রিল সকালে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ রানা প্লাজার মালিক ও পোশাক কারখানাগুলোর চেয়ারম্যান/সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আদালতে হাজির করতে সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন।
এদিকে একই ঘটনা নিয়ে করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চ রুল জারির পাশাপাশি ভবনের মালিক ও পাঁচ তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ওসিকে তলব করেছেন।
বেলা আড়াইটার দিকে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) পক্ষে ড. কামাল হোসেন একটি আবেদন উপস্থাপনের অনুমতি চান। একপর্যায়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে আবু ওবায়দুর রহমান তাঁদের একটি আবেদন আছে বলে জানান। তখন আদালত সবাই মিলে একটি আবেদন নিয়ে আসতে বলেন। পরে আদালত আদেশ দেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আল আমিন সরকার।
পরে আল আমিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের অনুমোদন-সংক্রান্ত কাগজপত্র ৩০ এপ্রিল আদালতে দাখিল করতে সাভারের মেয়রকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার আগের দিন ভবন পরিদর্শনকারী প্রকৌশলী ফজলুল হককেও হাজির হতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ভবন নির্মাণের বিষয়ে রাজউকের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করতে বলা হয়েছে। ওই ভয়াবহ ঘটনায় বিবাদীদের কেন দায়ী করা হবে না এবং শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় ব্যর্থতায় কেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, সাভারের মেয়র, বিজিএমইএ, ভবন-মালিক সোহেল রানা ও ছয়টি পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সাত দিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
হাইকোর্টে রিট: গতকাল বিচারপতি নাঈমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে একদল আইনজীবী রিট আবেদন দাখিল করলে প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি ও তলবের আদেশ দেন।
রুলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। ভবন-মালিক ও পোশাক কারখানাগুলোর চেয়ারম্যানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ নেওয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া রুলে শ্রম আইন-২০০৬, অগ্নি প্রতিরোধক ও নির্বাপণ আইন-২০০৩, ফ্যাক্টরি রুলস-১৯৯৭ অনুসারে অর্পিত দায়িত্ব পালনে বিবাদীদের ব্যর্থতা এবং পোশাক-কর্মীদের সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্রসচিব, শ্রমসচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রাজউকের চেয়ারম্যান, পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ভবন-মালিকসহ ১০ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে আবেদনের পক্ষে আইনজীবী ফাওজিয়া করিম, সালমা আলী, ইউনুস আলী আকন্দ, ইকবাল কবির ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নূসরাত জাহান। পরে আদালত আদেশ দেন।
মোখলেছুর রহমান জানান, চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। অন্য একটি বেঞ্চও এ বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন। ওই দিন তাঁদের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে হাজির হতে বলা হয়েছে।
বিজিএমইএর সদস্যপদ স্থগিত: রানা প্লাজায় কারখানা থাকা পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানার সদস্যপদ স্থগিত করেছে বিজিএমইএ। ভবনে ফাটল দেখা যাওয়ার পর কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ না মানায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠনটি।
গতকাল বিজিএমইএ ভবনে সাংবাদিকদের এ কথা জানান সমিতির সহসভাপতি মো. শহিদউল্লাহ আজিম ও রিয়াজ-বিন-মাহমুদ।
সদস্যপদ স্থগিত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে: ইথারটেক্স লিমিটেড, নিউওয়েভ বটমস্ লিমিটেড, নিউওয়েভ স্টাইল লিমিটেড, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেড ও ফ্যান্টম ট্যাক লিমিটেড।
শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, বিজিএমইএর নির্দেশ উপেক্ষা করে কারখানা খোলা হয়েছিল। তাই তাদের সদস্যপদ স্থগিত করে সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। বিজিএমইএ নেতারা বেশ কয়েকজন শ্রমিক নেতার সঙ্গে বৈঠকও করেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান ও গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশনের সমন্বয়কারী সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুকুর, ডোবা-নালার ওপর গড়ে ওঠা পোশাক কারখানাগুলো বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এ জন্য আমরা বিজিএমইএ ও শ্রমিক নেতাদের সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক কমিটি করতে বলেছি। এ ছাড়া হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বিষয়েও কথা হয়েছে। ’।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।