আজ বিজয়া দশমী। সকাল থেকে সুশান্ত প্রিয়ন্তীকে কয়েকবার মোবাইল করেছে, কি রে কখন আসছিস্? নাকি আমি গিয়ে নিয়ে আসবো?
না রে আমাকে নিতে আসতে হবে না। আমি নিজেই যেতে পারবো।
বিকেলবেলা প্রিয়ন্তী বাবাকে পূজা দেখার কথা বলে বের হলো। প্রিয়ন্তীদের বাড়ি থেকে সুশান্তদের বাড়ি আলাদা আলাদা উপজেলায় দূরত্ব বেশ কয়েক কিলোমিটার।
বাড়ির অদুরে রাস্তায় যেতেই একটা রিক্সা ভ্যান পেয়ে প্রিয়ন্তী উঠে বসল। কয়েকমিনিটের মধ্যে প্রিয়ন্তী সুশান্তদের বাড়ির সামনে গিয়ে পৌঁছে গেল।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর সামনে এসে দাঁড়ালো, প্রিয়ন্তী ভিতরে আয় বউদি তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
তারমানে তুই আমার সম্পর্কে বউদিকে কিছু বলেছিস?
হ্যাঁ বউদিকে বলেছি প্রিয়ন্তী নামে আমার এক বন্ধু আছে।
বউদি কী বলেছে?
তোকে দেখতে চেয়েছে, আমাকে কয়েকবার করে বলল, ঠাকুরপো মেয়েটার হেঁটে আসতে কষ্ট হবে তো, যাও না মোটর সাইকেলটা নিয়ে।
তুই কী বললি?
আমি বললাম, মেয়েটা একটু গোঁড়া টাইপের সে আমার মোটর সাইকেলে উঠবে না।
প্রিয়ন্তী মনে মনে বলল, যে মেয়ে একাই বরের সঙ্গে গিয়ে মন্দিরে বিয়ের মন্ত্র পড়তে পারে সে আর গোঁড়া!
কথা বলতে বলতে প্রিয়ন্তী সুশান্তর সঙ্গে তাদের বাড়ির ভিতরে গেল।
বউদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সুশান্তর সঙ্গে প্রিয়ন্তীকে ঢুকতে দেখে সামনে এগিয়ে এলো।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীকে পরিচয় করে দিল, বউদি এ হচ্ছে প্রিয়ন্তী আমরা এক সঙ্গে পড়ি আর প্রিয়ন্তী আমার বউদি, বাসন্তী।
প্রিয়ন্তী বাসন্তীকে প্রণাম করল।
বাসন্তী প্রিয়ন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ঠাকুরপো তোমার পছন্দ আছে, আগে থেকেই তুমি প্রিয়ন্তীর খুব প্রশংসা করতে, কাল যখন দূর্গা দেখতে যাওয়ার জন্য মোটর সাইকেল চাইলে তখন মনে হলো তুমি বুঝি দূর্গা দেখতে যাচ্ছ কিন্তু আজ দেখি তুমি শুধু দূর্গা দেখে আসোনি একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ। মা এদিকে এসে একবার দেখে যান ঠাকুরপো একেবারে সাক্ষাৎ দূর্গা নিয়ে এসেছে।
প্রিয়ন্তী লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেল।
প্রিয়ন্তী বসো, ঠাকুরপো তুমি বসো, গল্প করো আমি খাবার নিয়ে আসছি, বলে বাসন্তী চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর সুশান্তর মা এলো। সেও প্রিয়ন্তীর খুব প্রশংসা করল। কথায় কথায় বলল, তুমি বুঝি লেখাপড়ায় খুব ভালো মা, আমার গাধাটাকে তো কোনদিন লেখাপড়া করতে দেখি না।
প্রিয়ন্তী কিছু বলল না, সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী তুই বল আমি কি লেখাপড়া করি না?
প্রিয়ন্তী বলল, না মাসী ও তো কলেজে ভালো লেখাপড়া করে।
সুশান্তর এক প্রতিবেশী বউদি আছে, সে তাকে খুব স্নেহ করে কিন্তু তার স্নেহের মাঝে যেন এক ধরণের মাধুর্য আছে।
সবকথা উল্টা করে বলে সুশান্তকে ক্ষেপানোর জন্য কথা বলে। সে কাছে এলো, আপনাদের মুখে এতক্ষণ যা শুনলাম তাতে তো মনে হচ্ছিল এ বাড়িতে স্বয়ংদূর্গা এসেছে, এখন যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে দূর্গার রুপ সম্পর্কে ঠাকুরপোর কোন ধারণাই নেই।
সুশান্ত বলল, দূর্গা না হোক তোমার চেয়ে তো ভালো। তোমাকে দেখলে তো বউদি পরিচয় দিতে-
কী এত বড় কথা? আজ তোমার দাদা আসুক তারপর বলব, বলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল।
সুশান্ত মুখ কালো করে বসে রইল।
সুশান্তর মা রাগান্বিতচোখে তার সেই প্রতিবেশী বউদির দিকে তাকিয়েই বিষয়টা হালকা করার জন্য একরকম হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, বউমা তোমরা বউদি আর ঠাকুরপো মিলে বাড়িতে যত ইয়ার্কিই করো না তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তুপ্রিয়ন্তী আজই প্রথম এ বাড়িতে এলো ওর সামনে কি সব কথা বলা দরকার আছে?
প্রিয়ন্তী একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, না মাসীমা আমি কিছু মনে করিনি। আসলে বউদির সঙ্গে সুশান্তর সম্পর্কটা খুব ভালো তাই ইয়ার্কি-ফাজলামিটা একটু বেশি হয়।
ও প্রিয়ন্তী, তুমি ছোট মানুষ-
বউদির কথা শেষ হওয়ার আগেই সুশান্তর মা রাগান্বিতচোখে তাকাল।
বউদি বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না, মেয়েটা একদিন এ বাড়ির বউ হবে ওকে তো সবকিছু বলতে হবে আমরা সবাই মিলে এবাড়িতে এবং পাশের বাড়িতে কেমন একটা আনন্দময় সময় উপভোগ করি তাও তো জানতে হবে।
সুশান্তর মা চেয়ার থেকে উঠল, বউমা তুমি আমার সঙ্গে এসো তো, মেয়েটা অনেকদুর থেকে এসেছে আগে কিছু খেতে দিই, শুকনা মুখে চিড়া ভিজালে তো চলবে না।
না হলে সেও আবার তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে না।
না মা তা বলবে না প্রিয়ন্তী খুব শান্ত-শিষ্ট মেয়ে, দেখেন না তার মুখের ওপর একটা কেমন সাদাসিধে প্রকৃতির ছাপ আছে। তা সুশান্ত তোমাকে পটিয়েছে ভালোই, না হলে তোমার মতো একটা সুন্দর, শান্ত-শিষ্ট, বুদ্ধিমতী মেয়ে সুশান্তর মতো একটা ছেলের প্রেমে পড়বে কেন? ভগবানের এই এক নিষ্ঠুরতা, সুন্দর ছেলেরা পাবে অসুন্দর মেয়ে আর খুব ভালো মেয়েরা পাবে খারাপ স্বামী।
সুশান্তর মা আবার বলল, এসো তো বউমা।
সুশান্তর মা আর তার প্রতিবেশী বউদি চলে গেল।
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে বলল, তোর এই বউদি বুঝি তোর সঙ্গে খুব ইযার্কি করে।
সুশান্ত একটা ঢোক গিলে বলল, হ্যাঁ, একটু বেশি কথাও বলে।
তবে বউদি কিন্তু অনেক ইয়ার্কি-ফাজলামির মধ্যে একটা সত্য কথা বলে ফেলেছে।
সুশান্তর বুক কেঁপে উঠল। সে চুপ করে রইল।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, এই সুশান্ত কী ভাবছিস?
না ভাবছি বউদির কোন কথাটা তুই সত্য বলে মনে করছিস?
আরেকদিন বলব।
বউদি খাবার নিয়ে এসে টেবিলে খাবারের ট্রে রাখতে রাখতে বলল, সুশান্ত আমাকে বলে ওর দাদার কাছ থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে গেল, আমি মনে করেছিলাম তুমি ওর সঙ্গে মোটর সাইকেলে চলে আসবে।
না বাবাকে বলা হয়নি তো, তাই কাল আসতে পারিনি।
হ্যাঁ মেয়েদের আবার অনেক কিছু মেনে চলতে হয়, এখন বাবার অনুমতি নিতে হচ্ছে, এরপর ঠাকুরপো’র অনুমতি নিতে হবে, তারপর ছেলে বড় হলে ছেলেদের অনুমতি নিতে হবে। সারাজীবনই যেন শিকলে বাঁধা।
বাঁধা বলছেন কেন বউদি এটাই তো সমাজের নিয়ম, তাছাড়া মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপার তো আছেই।
সেই প্রতিবেশী বউদি আবার এলো, তবে তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, এই গ্রামে এমন কেউ নেই যে আমাদের ঠাকুরপো’র বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে, ওর হাড় গুঁড়া করে দিবে।
প্রিয়ন্তী অভিমানের সুরে বলল, কারো হাড় কোনদিন গুড়া করেছে নাকি বউদি?
না করেনি তবে ও কারো হাড় গুড়া করতে পারে এই ভীতিটা সবার মনে আছে। তুমি বোধ হয় জানো না বোকারা একবার ক্ষেপলে তাকে আর থামানো যায় না।
বউদি এটা কিন্তু আপনি অন্যায় বললেন, সুশান্ত বোকা না, শান্তশিষ্ট।
বাঃ, বাঃ এত তাড়াতাড়ি তো বেশ ভালোবাসা জম্মেছে।
বউদি বলল, সে চিন্তা তোমার নেই প্রিয়ন্তী কারণ সে কোনদিন তোমার হাড় গুঁড়া করবে না তবে কারো কারো হাড় গুঁড়া করার মতো তো কাউকে চাই।
তোমরা বসো আমার একটু কাজ আছে, বলে প্রতিবেশী বউদি চলে গেল।
বউদি পাশে থেকে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, তুমি কিছু মনে করো না প্রিয়ন্তী ও সব সময় সুশান্তর সঙ্গে একটু খোঁচা মেরে কথা বলে তো। অভ্যাসটাই এরকম।
প্রিয়ন্তী মৃদু হেসে বলল, না আমি কিছু মনে করিনি বউদি।
তোমরা বসো, গল্প করো, আমি চা নিয়ে আসছি, বলে বউদি চলে গেল।
সুশান্ত বলতে শুরু করল, বউদির বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো তো তাই একটু অহংকারী। আসলে বউদি আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না কারণ আমি কোন দোষ পেলে মুখের ওপর ষ্পষ্ট করে বলি।
সুশান্ত ষ্পষ্ট কথা বলা ভালো কিন্তু অনেক সময় ষ্পষ্ট কথা বিপদ ডেকে আনে।
বউদি চা নিয়ে এলো।
তুমি কীভাবে এসেছ প্রিয়ন্তী?
ভ্যানে।
কেন তুমি ঠাকুরপো’কে মোবাইল করলে তো পারতে?
প্রিয়ন্তী কিছু বলল না।
সুশান্তর মুখে যেন একটা আনন্দের আভা ফুটে উঠল।
বউদি বলল, সুশান্ত তুমি কিন্তু প্রিয়ন্তীকে নামিয়ে দিয়ে এসো।
সুশান্ত বলল, ঠিক আছে।
প্রিয়ন্তী সুশান্তর মোটর সাইকেলে উঠল। সে মাত্রক’দিন আগে মোটর সাইকেল চালাতে শিখেছে, কখনো মোটর সাইকেল যাচ্ছে দ্রুত গতিতে আবার কখনো হঠাৎ ব্রেক কষছে। তারওপর প্রিয়ন্তীর মতো সুন্দর মেয়েকে মোটর সাইকেলে চড়াতে পেরে সে যেন নিজেকে নায়ক ভাবতে শুরু করেছে। কিছুদুর যাওয়ার পর সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী চল না কয়েকটা পূজা মণ্ডপ ঘুরে দেখি?
রাত হয়ে যাবে না তো?
না রাত হবে কেন? আমি তোকে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাড়িতে রেখে আসবো।
প্রিয়ন্তী আর কিছু বলল না।
সুশান্ত আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। দ্রুত গতিতে মোটর সাইকেল চালাতে লাগল। প্রিয়ন্তী একবার বলল, সুশান্ত একটু আস্তে চালা।
তুই আমার ওপর ভরসা রাখ, কিছু হবে না।
দু’জনে কয়েকটা পূজা মণ্ডপ দেখার পর সুশান্ত যখন মোটর সাইকেল নিয়ে প্রিয়ন্তীর বাড়ির কাছে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে এসে প্রিয়ন্তী বলল, তুই যা সুশান্ত আমি এটুকু রাস্তা একাই যেতে পারবো।
আমি তোকে বাড়িতে দিয়ে আসি?
প্রিয়ন্তী কিছুটা রাগান্বিত স্বরেবলল, সুশান্ত আমি গতকাল তোকে কী বলেছিলাম?
ঠিক আছে প্রিয়ন্তী তুই বাড়িতে পৌঁছে আমাকে রিং দিস।
তুই মোটর সাইকেলে থাকতে আমি তোকে রিং দিব না সুশান্ত, তুই বাড়িতে গিয়ে আমাকে রিং দিস, তুই কিন্তু ভালো মোটর সাইকেল চালাতে পারিস না, সাবধানে যাবি।
আচ্ছা।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।