আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যন্ত্রের-যন্ত্রণা ছোট গল্প



( এক ) সর্বত্র, সর্বত্র সেই একই দৃশ্য। বাসে, ট্রামে, অফিসে, বাজারে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র তাকালেই দেখতে পাবে। একটা হাত কানে চেপে বিড়বিড় করতে করতে সব চলেছে। অনেকটা ঠিক যেন ওস্তাদি ঢঙ্গে সুর ভাঁজা বলে মনে হয়। ক্রমশ কাছে এগোতে এগোতে শুনি, নাঃ, একোন সুর ভাঁজা-টাজা নয়।

এহোল গিয়ে কথার কচকচানি। দিনেদিনে এই দৃশ্যটার আরও একটু উন্নতি হয়েছে। সেদিন দেখি একজন দুটো-হাতই পকেটে গলিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একা একা কথা বলে চলেছে। আগে হলে মানুষ নির্ঘাৎ পাগল ভেবে পাশ কাটিয়ে যেত। কিন্তু এখন নাকি এটাই লেটেষ্ট।

জানিনা অর্থাৎ আমার মাথায় ঠিক আসে না-----সর্বক্ষন কি এত জরুরী কথা সবাই বলে?-------সত্যি মানুষ যে এখন কি অসম্ভব ব্যস্ত, কি প্রচন্ড দরকারী হয়ে গেছে তা এদের না দেখলে আমার বোঝাই হোত না। সে হিসেবে আমার মত এমন একজন নিশ্চিন্ত, বেদরকারী মানুষ না থাকলে এদের এসব ঠাঁট-বাট দেখতই বা কে? স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো পর্যন্ত সকলের হাতেই এই এক খেলনা। ( দুই ) মিথ্যে বলব না, দেখে দেখে এক সময় এই যন্ত্রটার প্রতি আমিও একটু আকৃষ্ট হয়েছিলাম। বাব্বাঃ, উচ্চারণ করা মাত্র আমার ছেলে, মেয়ে, স্বামী একেবারে এক কথাতেই নাকচ করে দিল। কারণ?---------আমার নাকি বুকে পেস-মেকার বসান, সুতরাং কথা বলাতো দূরের কথা, ওটা নাকি ধরাও আমার বারণ।

এটাও বুঝি না, পেস-মেকার বাদে এখন আর কজনার হৃদয়ই-বা একা সব সামাল দিতে পারে? সেও তো শুনি অনেকেরই বুকে বসান। আমার একারই শুধু নয়। যাইহোক, এসব নিয়ে তর্কাতর্কির মধ্যে গিয়ে কোন কাজ নেই। আমার ভালর জন্যই তাদের এই সতর্কতা। সুতরাং চেয়ে না পেয়েও মনের কোনায় আবছা ভালবাসার যে পরশটা পাই, সেটাও নেহাৎ মন্দ নয়।

( তিন ) আজ হঠাৎ করে এই দুঃখটা চাগাড় দিয়ে ওঠারও একটা কারণ আছে। আজ দুপুরের ট্রেনে ওরা ভাই-বোন দুজনেই বরদার দিকে রওনা হয়েছে। বরদাতে আদিত্যর একটা ইন্টারভিউ আছে আর চিল্কিরও ওখানে একটা আর্ট-এক্সজিবিসনে কিছু ছবি পাঠাবার কথা ছিল। তাই ভাবল, দাদা যখন ওদিকে যাচ্ছেই, এই সুযোগে ওর সাথে গিয়ে, একেবারে হাতে হাতে দিয়ে আসাই ভাল। অনেকদিন থেকেই এটা নিয়ে কথা হচ্ছিল, কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে কাজটা আর হয়ে ওঠেনি।

যাক্, ভালই হল। দু ভাই-বোন একসাথে গেলে আমার চিন্তাটাও একটু কম হয়। আজকালতো রাস্তাঘাটে বেরোলে না ফেরা পর্যন্ত আর শান্তি নেই। ওর বাবাতো আর এক কাজ পাগল মানুষ। ওরা বেরোবার পর পরই উনিও অফিসের দিকে রওনা দিলেন।

বাড়ীতে আমি একা। বারবার বলে দিয়েছি, ষ্টেশনে পৌঁছেই একটা ফোন করিস। ল্যান্ড-ফোন একটা বাড়ীতে আছে আর ওদের সবার হাতেতো মোবাইল একটা আছেই। সুতরাং খবর দিতেতো কোন অসুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন ফোন এল না কেন? স্থির হয়ে একটু বসতেও পারছিনা।

সারাটা বেলা ছটফট করে শুধু এঘর-ওঘর করে কাটিয়েছি। বসার ঘরে ফোনটা রাখা আছে, দূরে সরছি না, কিজানি রিং হলে যদি শুনতে না পাই? যদি বেজেবেজে কেটে যায়? এক পাক ঘুরেই আবার ফোনটা তুলে দেখি, ঠিক মত রাখা হয়েছেতো? কিজানি আবার ডেড হয়ে গেল নাতো? মানে চিন্তার সূত্রের অভাব নেই। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া মাথায় উঠেছে। ভাবছি, একটা খবর পেলে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসব। একে চিন্তা, সাথেসাথে রাগও আবার মনে ভয়ও হচ্ছে।

কি হোল? কেন করল না? তবে কি ট্রেন লেট আছে? আবার নিজেই নিজেকে আস্বস্ত করি। হয়ত ট্রেন ছাড়লে পরে করবে। তাই-বা কেন? ওরাতো জানে আমার অবস্থা। এরকম তো কখনও করেনা। তবেকি ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে? ওরা উঠতে পারেনি? নাকি আদিত্য উঠে গেছে চিল্কি নীচে রয়ে গেছে? নাকি কাগজ-পত্র, টাকা-পয়সা সব হারিয়ে ফেলেছে।

মোবাইল চুরি হয়ে যায়নিতো? উঃ, আমি আর ভাবতে পারছিন। ---------------------কি যে করি? ভাবতে ভাবতে মনটা খুব ভারী হয়ে যায়। আচ্ছা, আমিওতো পারি একটা ফোন করতে? কিন্তু কেন করব? সেখানেও রাগ, অভিমান দুজনে এসে সংঘাত ঘটায়। একবার ফোনটা তুলি, দুটো নম্বর ডায়ালও করি, নাঃ করব না। আবার রেখে দি।

( চার ) আর ওই যে একটা মানুষ? সেই যে ওদের পেছন পেছন রওনা দিল, আর একবার খবর নেওয়ারও প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করে না। ------------আমি মানুষটা কি মরে আছি না বেঁচে আছি? বেশ সুখেই আছে। কোন চিন্তা নেই, ভাবনা নেই। সর্বক্ষন ব্যাস্ত-বাগীষ। -"মুখেন মারিতং জগৎ"- ওকেতো কিছু জিজ্ঞাসা করাই বৃথা।

আরও দশ কথা শুনিয়ে দেবে। --উপযুক্ত ছেলে-মেয়ে বাইরে কাজে গেছে , যা ভাল বোঝে করবে। এত ভাববার কি আছে?-------সত্যিই এত ভাবার কি আছে? সে তুমি কি করে বুঝবে?------ সারাক্ষন ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে, শেষে বসার ঘরে সোফার ওপর একটা বালিশ নিয়ে মাত্র মাথাটা লাগিয়েছি, ওমনি ফোনটা বেজে ওঠে। এতক্ষনে হুঁস হয়েছে, নিশ্চয়ই ওদের, ছুট্টে গিয়ে ধরি,--------------------যত্তসব ফালতু কথা। -" অন্জ্ঞলি-জুয়েলার্স -" থেকে কি এক স্পেশাল অফার দেবে সেটা নিয়ে বকবক করতে শুরু করল।

ছেড়ে দিয়ে আবার শুতে এলাম। আবার ফোন। এবার বোধহয় ওদের, ধরি. নাঃ, আবার সেই বাজে কথা। সেই কবে -" ওয়াটার- ফিল্টার-" একটা কেনার কথা হয়েছিল। দোকানে গিয়ে একবার দেখেও এসেছিলাম।

সেই তারাই উদ্যোগী হয়ে জানতে চাইছে, কি খবর? মধ্যবিত্তের যা হয় আর কি? প্রথমে দেখা, তারপর কথা, তারপর আলোচনা---------অবশেষে চাপা। ( পাঁচ ) কি আর করবে? মানুষের তুলনায় দোকান হয়ে গেছে বেশী। সুতরাং দোকানে , নেমন্তন্ন করে করে খদ্দেরকে ডাকতে হয়। আগে বছরে একবার হালখাতা উপলক্ষ্যে দোকানদাররা নেমন্ত্রণ পত্র দিত। তাও সব দোকানও নয়, সব খদ্দেরকেও নয়।

আর এখন? ওরা পারলে বাড়ীতে বয়ে এসে নিমন্ত্রন করে যায়। তাতেও শান্তি নেই। রিসেপসান কাউন্টারে সুন্দরী একটাকে সর্বক্ষন বসিয়ে রাখে ,---------------- শুধু উইশ করার জন্য। কার কবে বার্থ-ডে, কার কবে ম্যারেজ-ডে এসব উপলক্ষ্যে উইশ করার জন্য। জানিনা, মাথায় আসে না, এটাও নাকি কাজের মধ্যেই পড়ে, এবং এর জন্য নাকি তাদের ভাল স্যালারিও দেওয়া হয়।

তা দেবে না? এতবড় সব হিতাকাঙ্খী! চিন্তা নেই, চিন্তা নেই, আর কিছুদিন পর বোধহয় বাড়ীতে গিফটও পাঠাবে। সত্যি মানুষকে পাগল করার জন্য চারপাশে যে কত রকমের ফাঁদ পেতে রেখেছে সে আর বলার নয়। ইচ্ছে হয় ডাক ছেড়ে কাঁদি। নাঃ , আর শোব না। সকাল থেকে পেপারটাও দেখা হয়নি।

পেপারটা খুলে বসতেই বেজে ওঠে কলিং-বেল। দরজা খুলেই আবার মাথা গরম। -" কি, কি খবর?-" - " বার্ষিক হরিসভার উৎসবের জন্য কিছু সাহায্য। -"---একেবারে বুকের কাছে বিলবুক আর কলম হাতে নিয়ে লেখার জন্য তৈরী। একে মনটা অস্থির, মথার ঠিক নেই।

নিজের জ্বালায় নিজে মরছি। তার ওপর যত্তসব উটকো অশান্তি। দি কয়েক কথা শুনিয়ে। -" তা এতই যদি হরির সেবার জন্য উৎসব করার আগ্রহ, নিজের গাঁটের পয়সা দিয়েই করুন না। -"---------ঠাস করে, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যাই।

প্রায় দুটো বাজে, ঠিক সময় মত ট্রেন ছাড়লে ওরা এতক্ষন খড়গপুর ছাড়িয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে হাঁপিয়ে উঠেছি। ছেলে-মেয়ের বোধ-বুদ্ধি ভেবে ভেতরটা হু-হু করে উঠছে। এটাই বোধহয় সন্তানদের কাছ থেকে শেষ পাওনা। আচ্ছা, এরা এতখানি স্বার্থপর হয় কি করে? এত যে চিন্তা, এত যে উদ্বিঘ্নতা সামনে এলে তাও বলা চলবে না।

উল্টে আমাকেই সকলে মিলে দুষবে। মা হওয়ার কি এক আধটা বিপদ? ওদের মতে আদর্শ মা মানে,-------নো-চিন্তা, নো-ভাবনা, নো-জিজ্ঞাসা। আচ্ছা এটাকি কখনও হয়? উঃ, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। মাথারই বা কি দোষ? এইটুকুতো মাথা, এত চাপ কি সে নিতে পারে? ( ছয় ) আজ খাওয়ার আর দরকার নেই। যাই একটু চা করি।

মাত্র চায়ের জলটা চাপিয়েছি, ওমনি দুদিক থেকে দুটো বেজে ওঠে। একদিকে কলিং-বেল আর একদিকে ফোন। কোনরকমে তালাটা খুলে ফোনটা ধরি। -" মা, কি করছ?-" -" কেন, কি দরকার? এতক্ষনে মার কথা মনে পড়েছে? তোদের ভাই-বোনের কাছ থেকে অন্তত আমি এটা আশা করিনি। -" -" কেন, বাবা তোমায় জানায়নি?- -"কি? ও আবার কি জানাবে?-" -" আমরাতো ট্রেনে উঠেই বাবাকে ফোন করেছি।

বাবাইতো বলল ঠিক আছে, আমি তোমাদের মাকে জানিয়ে দিচ্ছি। -" -"তোরা মনে হয় তোদের বাবাকে আজ নতুন দেখছিস?-" ওমনি চোখের সামনে মূর্তিমান এসে হাজির। -"দাও, দাও, আমায় ফোনটা দাওতো। -----হ্যাঁরে মা, আমি না ফোন করতে একদম ভুলেই গেছিলাম। তারপর ভাবলাম, তাড়াতাড়িই যখন বাড়ী ফিরছি, তখন আর ফোন করার কি দরকার?-" -" সত্যি বাবা, এটা তোমার ভীষণ অন্যায়।

তুমি ভুলেই যাও যে সকলে তোমার মত নাও হতে পারে। মা যে সারাদিন কিভাবে কাটিয়েছে, তা আমি এখান থেকেই বেশ বুঝতে পারছি। যাক্, দাও , এখন মাকে ফোনটা দাওতো। -" -" মা, তুমি রাগ কোরনা মা। সত্যিই আমাদের ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে।

আসলে আমরা ভেবেছি, বাবাকেতো জানিয়ে দিলাম ট্রেন ঠিক সময় মত ছেড়েছে, আবার কিছুদূর গিয়ে তোমার সাথে কথা বলব। কি হোল? কিছু বলছ না কেন? বললামতো সরি,-------সরি--------সরি। -" -" কি আর বলব? ভালমত যাস। সাবধানে থাকিস। আদিত্যর ইন্টারভিউ কেমন হয় জানাতে ভুলিস না।

-" ( সাত ) -"দেখলি দাদা, বাবার কান্ডটা দেখলি?-" -"কেন? কি হয়েছে?"- -"কি আর হবে? বাবা, মাকে কোন খবরই দেয়নি। অফিস থেকে ফিরেই খবর দেবে এই ভেবে। এইমাত্র বাবা অফিস থেকে ফিরেছে। মা, সারাদিন কি টেনশনে কাটিয়েছে ভাবতে পারছিস?-" -"বেশ পারছি। এসবই হয়েছে তোমার পাকামির জন্য।

-" -"কেন? আমি আবার কি করলাম?-" -"আমি বারবার বলিনি মাকে ফোন করতে? বাবাতো ওরকম জানিসই। তুইই -তো বললি, না এখন বাবাকে জানিয়ে দি, কিছুদূর গিয়ে আবার মার সাথে কথা বলব। এখন বোঝ। -" -"আচ্ছা বাবা যে এরকম করবে, আমি কি করে বুঝব?-" -"না বোঝার কিছুই নেই। এসব আমাদের অনেক দেখা, অনেক জানা।

এখন চুপ করতো, কানের কাছে এক কথা নিয়ে ঘ্যান-ঘ্যান করিস না। ----------আর মারই-বা এত চিন্তার কি আছে?-" -"ওরমভাবে বলিসনা-----------------------" ( আট ) ফোনটা রেখে দু-পেয়ালা চা নিয়ে টেবিলে এসে বসি। -"আরে তুমি এত বিরক্ত হচ্ছ কেন? আমিতো অনেকক্ষন হয় অফিস থেকে বেরিয়েছি। জ্যামে না পড়লে, সেই কখন আমি বাড়ী চলে আসতাম। -" -"কেন, তোমার মোবাইল সঙ্গে ছিল না? প্রয়োজনে কেউ গাড়ীতে বসে ফোন করে না?-" -"আরে সেটাইতো ঘটিয়েছে যত বিপদ।

ফোন করতে গিয়ে দেখি ভ্যালিডিটি শেষ হয়ে গেছে, আর আউট গোয়িং কল হবে না। -" -"ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন আর আমার এসব নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগছে না। এখন কি খাবে বল?-" -"ওরে বাব্বাঃ, আমার ঘাড়ে কটা মাথা? এখন আর আমি খাওয়ার কথা বলি?-------------------তুমিওতো সারাদিন কিছু খাওনি। যাই বরং -সুগার অ্যান্ড স্পাইস - থেকে গরম গরম কিছু খাবার নিয়ে আসি।

দুজনেই খাওয়া যাবে। -"-"সে তোমার যা ইচ্ছে হয় আন গিয়ে। আমি কিচ্ছু খাব না। -" -"ঠিক খাবে। খেতেই হবে।

-" বলে হাসতে হাসতে, লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে পড়ে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।