এক্সট্রা এনার্জি এক্সচেঞ্জার
ভয়াবহ দরপতনের পর এবার শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক উত্থানের চমক দেখলেন বিনিয়োগকারীরা। এক দিন আগে যেখানে বাজারের ধস ঠেকাতে লেনদেন বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে, সেখানে গতকাল মঙ্গলবার দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই মূল্যসূচক বাড়ার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল সাধারণ মূল্যসূচক আগের দিনের চেয়ে এক হাজার ১২ পয়েন্ট বা ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়ে সাত হাজার ৫১২ পয়েন্টে এসে ঠেকেছে। দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এ হারে মূল্যসূচক বাড়তে দেখেননি কেউ। এর আগে ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর গ্রামীণফোনের তালিকাভুক্তির প্রথম দিন ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ৭৬৫ পয়েন্ট বেড়েছিল।
আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) গতকাল সার্বিক সূচক দুই হাজার ৬৮২ পয়েন্ট বেড়ে ২১ হাজার ৮৯৫ পয়েন্ট হয়েছে। মূল্যসূচকের এ উল্লম্ফনকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, যেভাবে বাজারকে ঠেলে ধাক্কিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল ভালো হবে না।
সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, অলিম্পিকে অনেকে প্রতিযোগী যেমন জয় লাভ করার জন্য ‘ড্রাগ’ নেয়, দেশের শেয়ারবাজারকেও সেভাবে ড্রাগ দিয়ে তরতাজা রাখার চেষ্টা চলছে। এভাবে কৃত্রিম উপায়ে বাজারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা টেকসই হবে না।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক দিনের অস্বাভাবিক দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে সূচকের এ আচরণই ছিল স্বাভাবিক। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, টানা দরপতনে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর শেয়ার কেনা দামের নিচে চলে গিয়েছিল। কিন্তু দরপতন ঠেকাতে নেওয়া সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তনের ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী হয়ে ওঠেন। এ কারণে গতকাল বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই শেয়ার হাতছাড়া করতে চাননি। আবার যাঁরা দরপতনে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলেন, একই ধরনের প্রত্যাশা থেকে তাঁদের অনেকেই শেয়ার কিনতে চেয়েছেন।
এ ছাড়া যাঁরা চাঙা বাজারে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলেন, তাঁরাও ছিলেন ক্রয়মুখী। এসব কারণে শেয়ার বিক্রির চাপের চেয়ে ক্রয়ের চাপ ছিল অনেক বেশি।
মূলত এরই প্রভাবে লেনদেন কম হলেও মূল্যসূচক বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ২৪৩টি কোম্পানির মধ্যে ১৯৫টি ছিল বিক্রেতাশূন্য। অর্থাৎ, এসব কোম্পানির শেয়ার বেড়ে যে দামে পৌঁছেছিল সেই দামে বিনিয়োগকারীরা তা বিক্রি করতে চাননি।
চলতি বছরের দ্বিতীয় লেনদেন দিবস থেকেই শেয়ারবাজারে দরপতন শুরু হয়। আর দরপতনের জন্য দায়ী করা হয় তারল্য-ঘাটতিকে। গত দুই-তিন দিনে পতনের হার এতটায় বেশি ছিল যে পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
এ কারণে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বাজারকে স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বেশ কিছু নীতি শিথিল করার ঘোষণা দেয়।
আর এসইসি শেয়ার ঋণের অনুপাত ১: ১.৫ থেকে ১: ২ পর্যন্ত বাড়ানোসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেকোনো উপায়ে বাজারে ধস ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেমন—সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) বাজার থেকে শেয়ার কেনার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী উল্লিখিত সবগুলো প্রতিষ্ঠানই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। একইভাবে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনানুষ্ঠিকভাবে শেয়ার কেনার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
যোগাযোগ করা হলে আইসিবির মহাব্যবস্থাপক ইফতেখার-উজ-জামান প্রথম আলোকে বলেন, আইসিবি ও তার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে প্রায় ১৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে। তবে গ্রাহকদের শেয়ার কেনার হিসাব ধরলে এটি হবে ৫৩ কোটি টাকার মতো। তিনি বলেন, ‘বাজারকে সমর্থন দেওয়ার মতো প্রস্তুতি আমাদের ছিল। কিন্তু শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেটার খুব বেশি প্রয়োজন হয়নি। ’
জনতা ব্যাংক পরিচালিত মার্চেন্ট ব্যাংক জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর মিয়া জানান, তাঁদেরও শেয়ার কেনার প্রস্তুতি ছিল।
কিন্তু ৬০-৭০ লাখ টাকার বেশি শেয়ার তাঁরা কিনতে পারেননি। নজিরবিহীন দরপতনের পর বাজারে বিক্রেতা কম থাকায় এমনটি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
একই ধরনের অবস্থা ছিল সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ক্ষেত্রেও।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও ক্ষুদ্র সব ধরনের বিনিয়োগকারীই ছিলেন ক্রেতার ভূমিকায়। গতকালের লেনদেনের ৭৩ শতাংশ সংঘটিত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে।
অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানে লেনদেনের বড় অংশই করেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে, এসইসির নতুন করে বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ হারে গতকালও ঋণ দিতে পারেনি বেশির ভাগ মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস। এ কারণে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, আইডিএলসি, ট্রাস্ট ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাঁদের তোপের মুখে আল-আরাফাহ্ ও আইডিএলসিতে লেনদেন বন্ধ রাখা হয়। পরে ঋণ অনুপাত কিছুটা বাড়িয়ে আবার লেনদেন চালু করা হয়।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা আগে কম দামে শেয়ার কেনার উদ্দেশ্যেই তাঁদের ঋণ দিচ্ছে না।
এ ব্যাপারে মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ মর্তুজা আহমেদ বলেন, বিনিয়োগকারীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে বেশির ভাগ মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস ইতিমধ্যে ঋণের অনুপাত অনেকখানি বাড়িয়েছে। কিন্তু অনেক হাউসে তারল্য-সংকট থাকায় তারা হয়তো বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী এখনো ঋণ দিতে পারছে না। তবে বিনিয়োগকারীদের এটাও মনে রাখতে হবে, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর নিজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা ঋণ দেবে। এসইসির বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সীমা অনুযায়ী তারা ঋণ দিতে বাধ্য নয়।
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এভাবে প্রতিদিন বাজারে হস্তক্ষেপ আমি সমর্থন করি না। এর মাধ্যমে সরকার বিনিয়োগকারীদের বার্তা দিয়েছে যে তোমরা ঝুঁকি নিতে থাকো। এরপর বাজার পড়ে যেতে থাকলে রাস্তা অবরোধ করে দু-একটা গাড়ি ভাঙচুর করো। আমি তোমাদের পাশে এসে দাঁড়াব। এটা তো কোনো স্বাভাবিক বাজারের লক্ষণ নয়।
[প্রথম আলো]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।