আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এটম বোমা আবিস্কারের ইতিহাস ( পর্ব-৭)

হ্যানিম্যান

নীলস বোর আইনস্টাইনের মত জগতজোড়া খ্যাতি লাভ করতে পারেন নি । তার খ্যাতি সীমাবদ্ধ ছিল ইউরোপ এবং তৎকালীন বিজ্ঞানী মহলে । কিন্তু তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানে তিনি যে একজন উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক সেটা প্রায় তর্কাতীত । হান ও স্ট্রসম্যান কর্তৃক ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়াস বিভাজনের পর বোর এই বিভাজনের যে তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন প্রধানত তারই ভিত্তিতে পারমানবিক বোমা তৈরি সম্ভব হয়েছিল । এটা জানা ছিল যে ইউরিনিয়ামের তিনটি বিভিন্ন আইসোটোপ এমন মিশ্রিত অবস্থায় বিদ্যমান যে তাদেরকে আলাদা করা প্রায় দু:সাধ্য ।

এই মিশ্রণে শতকরা ৯৯ ভাগ হল ইউরিনিয়াম-২৩৮ । এক হাজার ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়র মধ্যে সাতটি হল ইউরিনিয়াম-২৩৫ । বোরের সংখ্যা অনুযায়ী এই দুস্প্রাপ্য ইউরিনিয়াম – ২৩৫ আইসোটোপই বিদারণীয় । একটা নিউট্রন ইউরিনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপের মত বিজোড় ভর সংখ্যা যুক্ত নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করলে সেটা জোড় ভর সংখ্যায় পরিনত হবে এবং ভেঙ্গে দু’খন্ড হবে । অবরুদ্ধ নিউট্রন যদি জোড় ভর সংখ্যাকে বিজোড় ভর সংখ্যায় পরিনত করে তাহলে ঐ নিউট্রনটি নিউক্লিয়াসের মধ্যেই রক্ষিত হবে এবং নিউক্লিয়াস সহজে ভাঙ্গবে না ।

বোরের এই তাত্ত্বিক ভবিষৎবাণী অচিরেই পরীক্ষার দ্বারা সমর্থিত হল । এটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল যে দুস্প্রাপ্য ইউরিনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপই প্রধানত নিউট্রনের সাহায্যে বিদারণীয় । পরমাণু ভাঙ্গনের ওপর বোরের এই তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে । তখনও বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়নি । যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে ।

১৯৪০ সাল থেকেই তিনি ব্রিটেন ও আমেরিকায় অনুষ্ঠিত পারমানবিক অস্ত্র সংক্রান্ত সব রকম উদ্যোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন । ১৯৪৩ সালের প্রথম দিকে নাৎসী অধিকৃত স্বদেশে ডেনীয় প্রতিরোধীদের মাধ্যমে তিনি একটি পত্র পেলেন । এই পত্রটি ছিল ইংল্যান্ডের ছাদউইক কতৃক লিখিত একটি আমন্ত্রণ পত্র । ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছাদউইক এই পত্রটি লিখেছিলেন । তিনি বোরকে ইংল্যান্ডে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ।

ছাদউইক লিখেছিলেন যে পৃথিবীতে আপনার মত কোন দ্বিতীয় বিজ্ঞানী নেই যিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ মানুষের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হবেন । কয়েকটি বিষয়ে বোরের জ্ঞান যে তাদের কাজে লাগতে পারে এমন ঈঙ্গিতও ঐ চিঠিতে ছিল , যদিও বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় নি । বোর জানালেন যে তিনি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অপারগ । কারণ হিটলারের কবল থেকে বেরিয়ে এসে যে সব বিদেশী বিজ্ঞানী তার এখানে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের রক্ষার জন্য তার দেশে থাকা একান্ত প্রয়োজন । কিন্তু চিঠিতে উল্লেখিত বিষয়গুলি স্বরুপ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ।

তিনি ছাদউইককে জানিয়েছিলেন ‘ সর্বোপরি , আমার জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী আমি নিশ্চিত যে পারমাণবিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক বিস্ময়কর আবিস্কারগুলির ভবিষৎ সম্ভাবনা উজ্বল হলেও তার আশু কোন ব্যবহার দু:সাধ্য । ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে সাবধান করে দেওয়া হল যে তাকে এবং তার পরিবারকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে । ডেনীয় প্রতিরোধীরা সে রাতেই তাকে সুইডেনে পার করে দিল । ব্যাপারটা ব্রিটেনকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল । পরবর্তীতে তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এসে সুরক্ষিত এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অবস্থায় রাখা হল ।

সেখানেই তাকে গত দুই বছরের পারমাণবিক বোমা তৈরীর অগ্রগতির বৃত্তান্ত জানানো হয় । বর্তমান যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রভাবের ওপরই অধিকাংশ বিজ্ঞানী রাজনীতিবিদ ও সামরিক ব্যাক্তিদের চিন্তা ভাবনা কেন্দ্রীভূত ছিল । বোরের প্রতিক্রিয়া হল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের । পারমাণবিক অস্ত্রের দীর্ঘ মেয়াদী ফলাফল বোর সবার আগে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন । মিত্র শক্তি যদি পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে সাফল্যের দোর গোড়ায় উপনিত হয়ে থাকে তাহলে এই সাফল্য বর্তমান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে ।

এ ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে আলোচনা করার কিছু নেই । কিন্তু বোরের প্রশ্ন পরে কি ঘটবে ? রাশিয়ানরাও ঐ একই অস্ত্র তৈরীর জন্য তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করবে । বোরের অভিমত হল রাশিয়ানদের এখনই এই অস্ত্র তৈরির উদ্যোগের কথা জানানো উচিত , অবশ্য খঁটিনাটি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ না করে । অন্যথায় যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে পারস্পরিক সন্দেহ থেকে অবধারিতভাবে শুরু হবে পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।