আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেন লিখতাম, কেন লিখি, কেন লিখব

সহজ আলোয় দেখা...

লেখালেখি আর জীবনদর্শন নিয়ে আমার জীবনের একটা বিস্ময়কর সময় কাটিয়েছি। জীবনের সকল উচ্চাশা তুচ্ছ করে বেছে নিয়েছিলাম বিচিত্র একটা ভবঘুরে জীবন। সবে হাইয়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছি। পত্রিকায় ফিচার লিখে পকেট খরচ চালাই। সারাদিন পথে পথে ঘুরি আর জীবনকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখার চেষ্টা করি।

দিন শেষে একেকদিন বসি একেক রকম বই নিয়ে। এই হলো আমার “লেখক হতে চাওয়ার” নিত্যকার রুটিন। “কেন লিখব” – অনেক ভেবে ভেবেও এই প্রশ্নটার কোনও সুরাহা করতে পারিনি। লেখক কি নিজের জন্যে লেখেন, নাকি পাঠকের জন্যে? যদি দু’টোই সত্যি হয়, তাহলে নিজের জন্য কতটুকু, পাঠকের জন্য কতটুকু – এই নিয়ে ছিল ব্যাপক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। এই নিয়ে পত্রিকায় ভারি ভারি প্রবন্ধও লিখে ফেলেছি।

কিন্তু পুরোপুরি গ্রহনযোগ্য উত্তর বের করতে পারিনি। নানাকারণে শেষ পর্যন্ত লেখক হয়ে ওঠা হয়নি আমার। “কেন লিখব” – এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়াটাও বোধ হয় তার মাঝে একটা। যন্ত্রের মাঝে কাব্য লেখাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি, যেটা কম রোমাঞ্চকর নয়। নইলে পুরো একটা যুগ এটা দখল করতে পারতো না আমার ধ্যানযোগ।

তবে লেখালেখি ছেড়ে দেবার বহুদিন পরে, রাত্রিদিন প্রযুক্তির বিস্ময়কর উৎকর্ষতার মাঝে যেতে যেতে হঠাৎ হঠাৎ অভাব বোধ করি মানব অনুভূতির সূক্ষ তান। এভাবে মানবজীবনের রূপ-রস-রহস্যের কথা ভাবতে ভাবতে “কেন লিখব” এই প্রশ্নটার একটা উত্তর পেয়ে যাই কোনও একদিন। একজন লেখক তখনই লিখেন যখন তার বলার কিছু থাকে। মানুষ পুরোপুরি একা থাকতে পারেনা। কাউকে না কাউকে সে তার মনের কথাগুলো বলতে চায়।

জগতের রূপ-রস-রহস্য তার মাঝে যে তীব্র আলোড়ন তৈরি করে, সেই ব্যাকুলতাই সৃষ্টি করে একজন লেখকের। সাহিত্যিক হিসেবে একজন লেখকের বেড়ে ওঠা ব্যাপৃত হয় সে কার জন্যে লিখছে তার উপর নির্ভর করে। হ্যাঁ, একজন মানুষ শুধুমাত্র নিজের জন্যেই লিখতে পারে, আর সেক্ষেত্রে একটা সুবিধা হলো, পাঠকের অভিজ্ঞতার মাপে বিষয়বস্তুর বিস্তৃত বর্ণনা না দিলেও চলে। লেখক তার নিজস্ব ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নেবার একটা সুযোগ পায় এখানে। যে বিষয়গুলো তাকে আলোড়িত করছে, নিজেরই আরেকটা সত্ত্বার কাছে সেগুলোকে উদ্ভাসিত করে নতুন করে দেখার একটা সুযোগ মেলে।

এই আনন্দটা, শিল্পী সত্ত্বার বেড়ে ওঠার এই সৌন্দর্যটা তুচ্ছ করার মতো কিছু নয়! কিছু কিছু কথা আছে, গল্প আছে মানুষ যা বলতে চায় তার প্রিয়জনদের, বন্ধুদের, পরিচিতদের – যারা তাকে চেনে বা চিনতে চায়, যারা তাকে বোঝে বা বুঝতে চায়। এই কথাগুলোর কিছু কিছু আছে যা সামনা-সামনি বলা যায় না, বা বলতে পারা যায় না, কিন্তু কাগজের ওপর ফুটিয়ে তোলে সম্পর্কের অনবদ্য কাব্য। নিজস্ব কথা প্রকাশের এই ভারমুক্তি একই সাথে লেখককে ধাবিত করে অমোঘ এক কৌতুহলের দিকে। লেখক খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতে চায়, শুনতে চায়, পড়তে চায় পাঠকের প্রতিক্রিয়া। চিঠি এ ধরনের লেখার একটা চমৎকার উদাহরণ, আর এর আধুনিক সংস্করণ হলো, ফেসবুক স্ট্যাটাস।

সাহিত্যিক বলতে আমরা যে লেখকদের চিনি, তাঁরা সবার জন্যে লেখেন, অন্তত তার পাঠকদের প্রায় পুরো অংশের সাথেই থাকেনা তার কোনো ব্যক্তি পরিচয়। কোনো কোনো লেখকের কাছে পাঠকের সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারো কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগী সিরিয়াস পাঠক, তা যে সংখ্যারই হোক না কেন। এই লেখাগুলিতে লেখকের ব্যক্তিগত পরিচয়ের ঘাটতিটা পূরণ করে দিতে হয় আনুষংগিক ব্যাখ্যা দিয়ে, রং-রূপ আর ঢং দিয়ে। নিজের অনুভূতির সাথে অচেনা মানুষের এই সংযোগের আকাঙ্ক্ষার পেছনে একেক লেখকের কাজ করে একেকরকম উদ্দীপনাঃ কারো কাছে পেশা, কারো কাছে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার, কারো কাছে নিতান্তই আত্মশ্লাঘা। যতোক্ষণ পর্যন্ত লেখকের মূল প্রেরণা তার স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির তাড়না, ততোক্ষণ পর্যন্ত লেখালেখির পুরো প্রক্রিয়াটি আশীর্বাদের মতোই হয়।

কোনো কোনো দুর্ভাগা লেখক এইটা বুঝতে পারেন না, চরম আত্মশ্লাঘায় মোহগ্রস্ত হয়ে হারিয়ে ফেলে সৃষ্টিশীলতার স্ফূরণ। পৃথিবীতে সৌভাগ্যবান যত সম্প্রদায় আছে, লেখকরা তাদের মাঝে সম্ভবত উপরের দিকেই আছে। একজন লেখকের আশেপাশে যা কিছু ঘটে, যা কিছু আসে, তা যত অকিঞ্চিতকর হোক না কেন, একরকম অর্থ নিয়ে আসে, লেখকের অনুভূতির স্রোতে পাল তুলে দেয়। মানবজীবনের, জগতের এই আশ্চর্য রূপ, রস, রহস্য লেখকের মুগ্ধ দৃষ্টির বাহনে বাকী সকল মানুষের মাঝে সঞ্চারণ করার এই প্রক্রিয়া বোধ হয় স্রষ্টার অনেক পছন্দের! আপনার লেখালেখির পেছনে কি প্রেরণা কাজ করে বলতে পারেন এখানে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।